Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মাটিতে-জৈব-পদার্থের-ঘাটতি-পূরণে- গোবর-সার-ও-পোল্ট্রি-ম্যানিওর

মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণে 
গোবর সার ও পোল্ট্রি ম্যানিওর
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল এবং কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিরও বেশি। দেশের প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল (বিশ^ব্যাংক, ২০১৭)। আর কৃষি উৎপাদনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত মাটির গুণাগুণ। আমাদের দেশের মাটিতে জলবায়ুগতভাবেই জৈব পদার্থের পরিমাণ কম এবং দিন দিন এর পরিমাণ আরও কমে যাচ্ছে, ফলে হ্রাস পাচ্ছে মাটির উর্বরতা। বাড়ছে মানুষ, সাথে সাথে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে খাদ্যের চাহিদা। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফসল উৎপাদন। কৃষিনীতি, কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা, গবেষণা, সম্প্রসারণ সর্বোপরি কৃষকের পরিশ্রমের ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ক্রমবর্ধমান ফসল উৎপাদন করতে বাড়ছে ফসলের নিবিড়তা, বাড়ছে সার, সেচ ও কীটনাশকসহ নানা প্রকার রাসায়নিকের প্রয়োগ। এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ, বাড়ছে মাটির অম্লত্ব, মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। 
মাটির উর্বরতা হারানোর অন্যতম কারণ হলো মাটিতে জৈবসার ও সবুজ সারের কম ব্যবহার। একই জমিতে বছরে একের অধিক ফসল চাষের ফলে ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে না পচিয়ে জমি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া দেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ব্যবহৃত জৈবসার বা ফসলের অবশিষ্টাংশ খুব দ্রুত পঁচে যায়। যার ফলে জমিতে ব্যবহৃত জৈবসারও জমিতে বেশি দিন থাকে না বা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বারবার জৈব সার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। আর দেশের প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে বারবার অর্থ খরচ করে সার ক্রয় করাও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে জমিতে জৈব পদার্থের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে গবাদিপশুর গোবর এবং পোল্ট্রি ম্যানিওর। 
মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণে গোবর সার 
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং জমিতে জৈব পদার্থের উৎস হিসেবে এদেশে আবহমানকাল থেকে গোবর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবাদিপশুর খাবারের প্রায় ৫৫ শতাংশই গোবরে পরিণত হয়। সুতরাং, গোবর একটি উৎকৃষ্ট যৌগ যাতে কৃষি কাজের উপযোগী এবং ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি রয়েছে। কিন্তু মোট উৎপাদিত গোবরের তুলনায় এর ব্যবহার খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২.৫ কোটি গরু রয়েছে (বিবিএস, ২০১৯) এবং প্রতিদিন গড়ে ২৩০ মিলিয়ন কেজি গোবর উৎপাদন হয় (ওখগগ চড়ষরপু, ২০১৫)। প্রতি কেজি গোবর হতে ৫০-৫২% কেঁচো সার উৎপাদন করা যায়, সে মোতাবেক দৈনিক এক লাখ পঞ্চাশ হাজার মেট্রিক টন কেঁচো সার পাওয়া সম্ভব। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গরু হতে প্রতিদিন গড়ে ৬-১২ লিটার মূত্র পাওয়া যায়, সে হিসেবে দেশের ২.৫ কোটি গরু হতে প্রতিদিন প্রায় ২২.৫ কোটি লিটার গোমূত্র  উৎপাদিত হচ্ছে।  প্রতি লিটার গোমূত্রে ২.৫% ইউরিয়া থাকে, সে হিসাবে দৈনিক ৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া উৎপাদন করা যেতে পারে। দেশে প্রতি বছর ২৯ মেট্রিক টন ইউরিয়া চাহিদা থাকলেও উৎপাদিত হয় ৭ লক্ষ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। সুতবাং গোবর ও গোমূত্রের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সারের চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও গোবরের এরূপ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নির্গমন কম হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব কমে যায়। উল্লেখ্য, গোখাদ্যের উচ্ছিষ্ট বর্জ্যও একটি নির্দিষ্ট স্থানে পচিয়ে গোবরের সাথে মিশিয়ে কেঁচো সার উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। একটি গরু দিনে গড়ে প্রায় ২.৫ কেজি খাবার নষ্ট করে যা বর্জ্য হিসেবে থেকে যায়। সুতরাং উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে সৃষ্ট বর্জ্যরে পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজার টন। এসব বর্জ্য থেকে উৎপাদিত কেচো সার কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহারের সুযোগ আছে। রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে শুধু মাটির গুণাগুণই নষ্ট হয় না, উক্ত রাসায়নিক পদার্থের অবশিষ্টাংশ নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদিতে মিশে পানি দূষিত করে। ফলে মাছসহ জীব-বৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে উৎপাদিত গোবরকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে কেঁচো সার উৎপাদন করে জমিতে ব্যবহার করলে তা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধিসহ পরিবেশ সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখবে। 
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রি ম্যানিওর 
গোবরের পাশাপাশি পোল্ট্রি ম্যানিওর জৈবসারের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। আমাদের দেশে হাজার হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এসব খামার থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পোল্ট্রি ম্যানিওর উৎপন্ন হয়। এসব পোল্ট্রি ম্যানিওর জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, ফলে মাটির উর্বরতাও বাড়বে। পোল্ট্রি ম্যানিওর একটি উৎকৃষ্ট মানের জৈবসার। মাটিতে পোল্ট্রি ম্যানিওর প্রয়োগ করলে মাটির অম্লত্ব দূর হয় বিধায় অম্ল মাটিতে চুন প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। আর অম্লত্ব দূর হওয়ার কারণে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান গ্রহণেও ফসলের সুবিধা হয়।
পোল্ট্রি ম্যানিওর-এ উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এগুলো হলো, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিংক, ক্লোরিন, বোরন, আয়রন, এবং মলিবডেনাম। পোল্ট্রি ম্যানিওর প্রয়োগ করলে জমিতে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস সার যোগ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যদি জমিতে বছরে হেক্টরপ্রতি ১-১.৫ টন বা প্রতি শতাংশ জমিতে ৪-৬ কেজি পোল্ট্রি ম্যানিওর প্রয়োগ করা হয় তবে সে জমিতে আর বাড়তি টিএসপি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া এ পরিমাণ পোল্ট্রি ম্যানিওর ব্যবহারে হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ কেজি ইউরিয়া জমিতে যোগ হয়। অর্থ্যাৎ পোল্ট্রি ম্যানিওর নাইট্রোজেনেরও একটি ভাল জৈব উৎস। 
প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার মাটি অম্লীয়। বিভিন্ন কারণে মাটিতে অম্লত্ব দেখা দেয়। যেমন, দীর্ঘদিন যাবৎ জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, চাষাবাদের নিবিড়তা বৃদ্ধি, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল আবাদ, অতি বৃষ্টি, মাটির বুনট, জৈব পদার্থের পচন এবং প্রাকৃতিক কিছু কারণেও মাটিতে অম্লত্ব দেখা দিতে পারে। মাটির অম্লত্ব বেড়ে গেলে গাছ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে না। অম্ল মাটিতে পরিমিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করেও কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। মাটির অম্লত্ব দূর করার জন্য প্রচুর পরিমাণ চুন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। আর পোল্ট্রি ম্যানিওরে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম বা চুন জাতীয় পদার্থ থাকায় এ জৈবসারের প্রয়োগ মাটির অম্লত্ব দূর করে।
অনেকের ধারণা, পোল্ট্রি ম্যানিওর-এ হেভি মেটাল বা দূষক পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে। যার ফলে জমিতে পোল্ট্রি ম্যানিওর ব্যবহারে উৎসাহ দেখান না। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ পোল্ট্রি ম্যানিওর হেভি মেটাল বা দূষক পদার্থের পরিমাণ সরকার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কম। লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল: ০১৮১১-৯৮৬৬০৫, ইমেইল:smmohibullah@gmail.com