তালের চিনি ও গুড় তৈরির আধুনিক কৌশল
ড. মো. শরিফুল ইসলাম১, ড. মো. শামসুল আরেফীন২
তাল চাষ গ্রামীণ অর্থনীতি, কর্ম সংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তালগাছ বাংলাদেশের সকল এলাকায় অযত্ন অবহেলায় জন্মে থাকে। এ গাছ পানি ছাড়াই দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। আবার গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়ালেও সহজে মারা যায় না। তালগাছ রাস্তার ধারে, বাড়ির আশে-পাশে, জমির আইলে, পুকুরপাড়, রেললাইন ইত্যাদি পরিত্যক্ত স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মাতে দেখা যায়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করে এ দেশে তাল চাষ হয় না। তালগাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা আলাদাভাবে জন্মায়। ফুল না আসা পর্যন্ত স্ত্রী ও পুরুষ গাছ চেনা যায় না। তালগাছের পুরুষ গাছ হতেই সাধারণত রস সংগ্রহ করা হয়। তবে কোন কোন এলাকায় স্ত্রী গাছ হতেও রস সংগ্রহ করা হয়।
তালগাছ হতে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদন কৌশল
গাছ নির্বাচন
তালগাছ হতে রস সংগ্রহের জন্য কমপক্ষে ১০-১২ বছর বয়সের সুস্থ গাছ নির্বাচন করা উচিত। যেসব গাছ দেখতে সুস্থ সবল সেসব গাছ নির্বাচন করলে অধিক রস আহরণ করা সম্ভব।
তাল বাগান
প্রয়োজনীয় উপকরণ
ধারালো দা, মাটির পাত্র বা হাঁড়ি, লোহার বা স্টিলের কড়াই, চুলা, জ্বালানি, হাতা, ছাঁকনী, একটি বাঁশ গিড়াসহ ও দড়ি।
রস সংগ্রহ পদ্ধতি
পুরুষ ও স্ত্রী উভয় গাছ হতে রস সংগ্রহ করা যায়। মার্চের শেষ সপ্তাহে (চৈত্রের ২য় সপ্তাহে) পুরুষ তালের পুষ্পমঞ্জরি বড় হয়। নরম পুষ্পমঞ্জরিকে প্রথম ৩ দিন প্রতিদিন আধা ঘণ্টা হাত দিয়ে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত এক হাতে ধরে অপর হাতের তালুর চাপের মাধ্যমে উপর থেকে নিচে হালকাভাবে সকালে ও বিকেলে প্রায় ৪৫-৫০ বার হালকাভাবে টানতে হবে। জোরে আঘাত করা যাবে না। পুষ্পমঞ্জরি একটু শক্ত হলে পুষ্পমঞ্জরির ২ পার্শ্বে ২টি কঞ্চি/বাঁশের বাতা দিয়ে উপর থেকে নিচে ২-৩ দিন সকাল ও বিকেলে ২০-২৫ বার টানতে হবে। এরপর পুষ্পমঞ্জরির শেষ প্রান্তে ধারালো দা দিয়ে সোজা করে কাটতে হবে।
পুরুষ তালগাছের পুষ্পমঞ্জরি
পুরুষ তালগাছের পুষ্পমঞ্জরি
কাটা অংশ দিয়ে মিষ্টি রস পড়তে থাকে। রস সংগ্রহের জন্য মঞ্জরিদ-ের কাটা অংশের নিচে হাঁড়ি বেঁধে দিতে হবে। রস ভাল রাখতে হলে প্রতিদিন ৩ বার রস সংগ্রহ করা উচিত। সকাল ৬টা, দুপুর ১২টা ও বিকাল ৬টা। রস সংগ্রহের সময় পুষ্পমঞ্জরি ও হাঁড়ি পাটের চট/মোটা সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। একটি পুরুষ তালগাছে ৬-৭টি হাঁড়ি লাগানো যেতে পারে। প্রতিটি হাঁড়িতে ৪-৫ পুস্পমঞ্জরি রেখে বাকীগুলো কেটে ফেলতে হবে। মার্চ থেকে মধ্য জুলাই (আষাঢ় মাস) পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। পূর্ণ বয়স্ক একটি পুরুষ তালগাছ হতে প্রতিদিন ২৫-৩০ লিটার পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়।
স্ত্রী তালগাছ : মে মাসে ফলের মঞ্জরিদ- বেড় হলে ধারালো দা দিয়ে কাটতে হয়। এই কাটা অংশ দিয়ে ফোটায় ফোটায় মিষ্টি রস পড়তে থাকে। রস সংগ্রহের জন্য মঞ্জরিদ-ের কাটা অংশের নিচে মাটির হাঁড়ি লাগানো হয়।
স্ত্রী তালগাছের রস সংগ্রহ পদ্ধতি
তালের গুড় উৎপাদন কৌশল
স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তালের গুড় উৎপাদনের জন্য রস সংগ্রহের পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে রস ছেকে চুলার উপর বসানো লোহার বা স্টিলের কড়াইতে ঢালা হয়। চুলার উপর কড়াই বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কড়াই ও চুলার মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে। আরও খেয়াল রাখতে হবে যেন চিমনি থেকে ফ্লু গ্যাসের সাথে বের হয়ে যাওয়া ছাই কড়াইয়ের রসের সঙ্গে মিশতে না পারে। রস জ্বাল দেয়ার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে যে গাদ বা ফেনা ভেসে উঠে তা যত দ্রুত সম্ভব ছাঁকনি বা হাতা দিয়ে উঠিয়ে ফেলে দিতে হবে। গাদ বা ফেনা উঠাতে দেরি হলে তা রসের সাথে মিশে জটিল অপরিশোধনযোগ্য অবস্থায় চলে যাবে। ফলে গুণগতমান সম্পন্ন গুড় উৎপাদন করা সম্ভব নয়। রস ঘনীভূত হয়ে সিরাপের মতো হলে কড়াইয়ের ফুটন্ত ঘনীভূত রস বা সিরাপ হাতলের সাহায্যে লাগাতারভাবে নাড়াত হবে এবং খুব দ্রুত চুলার তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। এই অবস্থায় কড়াইয়ের চার ধারে কিছু গাদ সৃষ্টি হয়, যা লাগাতারভাবে তুলে ফেলতে হবে। চুলা থেকে গুড় নামানোর সময় নিশ্চিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে সামান্য গুড় অর্থাৎ এক চিমটি পরিমাণ গুড় ২০০ মিলি ঠা-া পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। গুড় পানিতে দ্রুত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে চুলা থেকে গুড় নামানোর উপযোগী হয়েছে এবং দ্রুত চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে ফেলতে হবে।
তালের রস
মাটির হাঁড়িতে তালের গুড়
তালের পাটালি
তালের চারা উৎপাদন, রস সংগ্রহ, রস বিক্রয়, গুড় তৈরি, গুড় পরিবহন, গুড় বাজারজাতকরণ এবং গুড় ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ বিরাট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের দুর্যোগ প্রতিরোধ, খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকার পরিবেশ উন্নয়নসহ দেশের সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শারীরতত্ত্ব ও চিনি রসায়ন বিভাগ, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ^রদী-৬৬২০, পাবনা। মোবাইল-০১৭১৫১৩৯২২১; ই-মেইল :sharifbsri75@gmail.com