বারি নেগি অনিয়ন-১ পেঁয়াজের বিকল্প
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ মো. মুশফিকুর রহমান২ রুম্পা সরকার৩
নেগি অনিয়ন এক বর্ষজীবী ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। এ প্রজাতির পেঁয়াজের উৎপত্তি স্থল পূর্ব এশিয়া (উত্তর-পশ্চিম চীন, জাপান এবং সাইবেরিয়া)। বর্তমানে জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। নেগি অনিয়ন বাংলাদেশের জন্য নতুন ফসল। এ প্রজাতিটি ২০২০ সালে জাপান থেকে এ দেশে প্রবর্তন করা হয়। প্রদেশীয় আবহাওয়ায় নেগি অনিয়ন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বছরব্যাপী এ পেঁয়াজ চাষ করা যায়, তবে রবি মৌসুমে এর ফলন বেশি হয়। এ প্রজাতিটি সারা বছরই ছাদ বাগান, বসতভিটাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাষ করা যায়। কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্য এ ফসলটি বারি নেগি অনিয়ন-১ নামে জুন ২০২৪-এ অনুমোদিত হয়েছে। পেঁয়াজের বিকল্প ছাড়াও এর বহুমুখী ব্যবহার আছে বিধায় নতুন ফসলটি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বারি নেগি অনিয়ন-১ এর বৈশিষ্ট্য
সাধারণ পেঁয়াজের মতো বারি নেগি অনিয়ন-১ এ কন্দ উৎপাদন হয় না। কন্দের পরিবর্তে পাতার শিরাগুলো পরপর আচ্ছাদিত হয়ে একটি লম্বা ও মোটা সাদা সিউডোস্টেম উৎপন্ন হয়। সিউডোস্টেমের গঠন নরম ও রসালো হয়। মূল বাদে সিউডোস্টেম ও পাতা এর ভক্ষণযোগ্য অংশ। এর স্বাদ, গন্ধ ও ঝাল সাধারণ পেঁয়াজের মতো, বিধায় নেগি অনিয়ন পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাছে ফুল আসার পূর্ব পর্যন্ত সিউডোস্টেম খাওয়া হয়। গাছে ফুল দ- উৎপন্ন হওয়ার পরে সাদা সিউডোস্টেম তুলনামূলকভাবে শক্ত হয়ে যায়। এর পাতা ও ফুল দ- ফাঁপা থাকে। এর ফুল দ- ও পাতার মতো। সাধারণ পেঁয়াজের পাতার তুলনায় এর পাতা খুবই বড়, নলাকার ও গাঢ় সবুজ হয়ে থাকে। বারি নেগি অনিয়ন-১ এর পাতার আকৃতি প্রায় গোলাকার, তাই এর পাতার প্রস্থচ্ছেদ দেখতে “ঙ” (গোলাকার) আকৃতির। কিন্তু সাধারণ পেঁয়াজ পাতার এর গাছের দিকের অংশ সমান এবং অন্য তিন দিকের অংশ গোলাকার, তাই এর পাতার প্রস্থচ্ছেদ দেখতে “উ” আকৃতির। এ প্রজাতির পেঁয়াজের গাছের উচ্চতা ৭০-৭৫ সেমি. এবং প্রতিটি সাদা সিউডোস্টেমের দৈর্ঘ্য ও ওজন যথাক্রমে ২৫-৩০ সেমি. ও ৮০-১০০ গ্রাম হয়ে থাকে। এ ফসলটিতে শুধুমাত্র বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার হয়ে থাকে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে গাছে ফুল ধরা শুরু হয়।
বারি নেগি অনিয়ন-১ এর ব্যবহার
পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন মাছ, মাংস, শাকসবজি, খিচুড়ি রান্নায় ব্যবহার ছাড়াও ইহা সালাদ, আচার, সস, সুপ, অমলেট, নুডলস, পিজা, স্যান্ডউইচসহ বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় (ঐধর, ২০১৫ ধহফ)। এর গাঢ় সবুজ পাতা ও কা- সবজি হিসেবেও খাওয়া যায়। সিউডোস্টেম দ্বারা তৈরি ভর্তা খুবই সুস্বাদু। নেগি অনিয়নের সাদা সিউডোস্টেমটি আগুনে ঝলসিয়ে খেতেও খুবই মজাদার।
পুষ্টি ও ঔষধি গুণাবলী
নেগি অনিয়নে কার্বোহাইড্রেট, আঁশ, পটাশিয়াম, কপার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২, ভিটামিন বি-৩, ভিটামিন বি-৫, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি-৯, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে ইত্যাদি পুষ্টিতে ভরপুর (জাপানের শিক্ষা, সংস্কৃৃতি, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ২০১৫ এবং ইউএসডিএ, ২০২৩)। জাত ও চাষ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ তারতম্য হতে পারে। নেগি অনিয়নে ফুরানিওল, ডাইমিথাইল ট্রাইসালফাইড, অ্যালাইল মিথাইল ট্রাইসালফাইড, মিথাইল প্রোপাইল ট্রাইসালফাইড ইত্যাদি সুগন্ধি থাকে (ডধহম বঃ ধষ., ২০২৩)। প্রতিরোধী ও এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে (ঈৎুংঃধষ বঃ ধষ., ২০০৩)। ইহা হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, সাধারণ ঠা-াজনিত রোগ, জ¦র, মাথাব্যথা, ক্ষত, শরীরের স্থুলতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। নেগি অনিয়ন শরীরের বিপাকীয় কার্যকারিতা এবং দৃষ্টিশক্তির উন্নতি করে (ঐধর, ২০১৫)।
মাটি ও আবহাওয়া
বারি নেগি অনিয়ন-১ বিস্তৃত জলবায়ু এবং পরিবেশগত পরিস্থিতির সাথে ভালোভাবে অভিযোজিত। তাই এ প্রজাতিটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এবং উষ্ণ/অব-উষ্ণ অঞ্চলে জন্মাতে পারে। রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় ভালো নিষ্কাশনযুক্ত এটেল-দো-আঁশ থেকে বেলে-দো-আঁশ এবং ৫.৭-৭.৫ ঢ়ঐ মাটিতে এ ফসল সুন্দরভাবে জন্মে থাকে। তবে গাছের বৃদ্ধির জন্য ১৫-২২ক্ক সেলসিয়াস তাপমাত্রা উত্তম। এ প্রজাতিটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
জমি তৈরি
কমপক্ষে ২৫-৩০ সেমি. গভীর পর্যন্ত জমিতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরে করে প্রস্তুত করা হয়। শিকড়ে নেমাটোডের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মূল জমি তৈরির সময় প্রতি বিঘা জমিতে ৪ কেজি (৯ গ্রাম/৩ বর্গ মিটার, ৩০ কেজি/হেক্টর) রাগবী ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। আগাছাসহ অন্যান্য আবর্জনা ভালোভাবে পরিস্কার করতে হবে। পরে জমিতে ১ মিটার চওড়া এবং ৩ মিটার দৈর্ঘ্য (আদর্শ বেডের পরিমাপ) অথবা সুবিধামতো দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে অনেকগুলো উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। একটি বেড থেকে অন্য বেডের মাঝখানে কমপক্ষে ৫০ সেমি. নালার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পানি নিষ্কাশন ও অন্যান্য আন্তঃপরিচর্যার কার্যক্রম সহজ হয়। নালার মাটি বেডের উপর দিতে হবে যাতে বেড উঁচু হয়। প্রয়োজন মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া ছাদ বাগান, বিভিন্ন পাত্র, বসতভিটাসহ বিভিন্ন পতিত জায়গায় চাষ করা যায়। বারি নেগি অনিয়ন-১ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় বর্ষা মৌসুমে উপরোল্লেখিত জায়গাসহ নিষ্কাশন যোগ্য যে কোন উঁচু স্থানে উৎপাদনের জন্য উপযোগী।
বীজ বপন
বারি নেগি অনিয়ন-১ সারা বছর চাষযোগ্য, তাই যে কোনো মাসে এর বীজ বপন করা যায়। তবে মধ্য জুলাই (শ্রাবণের প্রথম) মাস থেকে বীজ বপন শুরু করলে এর ফলন বেশি হয়। রোপণ দূরত্ব ২০ সেমি. দ্ধ ২০ সেমি. বজায় রেখে নেগি অনিয়ন উৎপাদন করলে প্রতি বিঘা জমিতে ৪০০-৫৩৫ গ্রাম (১ গ্রাম/৩ বর্গ মিটার, ৩-৪ কেজি/হেক্টর) বীজের প্রয়োজন হয়। বপনের পূর্বে বীজ প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি বা অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউ ডিজি ছত্রাকনাশকের (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক) মাধ্যমে শোধন করা ভালো।
চারা রোপণ
বীজ বপনের ৩৫-৪০ দিন পর চারা উত্তোলন করে মূল জমিতে রোপণ করা হয়। নেগি অনিয়নের উচ্চতা বেশি হওয়ায় প্রস্তুতকৃত জমিতে তুলনামূলকভাবে মাটির গভীরে চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. বজায় রেখে প্রতি সারিতে ২০ সেমি. পরপর চারা রোপণ করা হয়। প্রতি ৩ বর্গ মিটার বেডের জন্য ৭৫টি চারার প্রয়োজন হয়। রোপণের পূর্বে চারার গোড়া রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি দ্রবণে (২ গ্রাম/লিটার পানি) শোধন করতে হবে। চারার উচ্চতা বেশি হলে ডগা থেকে কিছু অংশ কেটে দেওয়া উচিত, তাতে চারা সহজেই মাঠে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বারি নেগি অনিয়ন-১ এ কন্দ হয় না, তাই এ ফসলের জমিতে ফসফরাস সার কম প্রয়োজন। সিউডোস্টেম ও পাতার বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন সার তুলনামূলক বেশি দরকার হয়। জমির অবস্থা বুঝে সারের মাত্রা কম-বেশি হয়ে থাকে। এ ফসলের জমিতে বিঘাপ্রতি ৪০০-৬৫০ কেজি পচা গোবর সার, ৩০-৩৩ কেজি ইউরিয়া, ১৬-২০ কেজি টিএসপি, ২০-২৩ কেজি এমওপি, ১৬-২০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করতে হয়। সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং এক চতুর্থাংশ ইউরিয়া জমি তৈরির সময় দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া উৎপাদন মৌসুমে তিন কিস্তিতে সমানভাবে চারা রোপণের ২৫-৩০, ৫০-৬০ এবং ৮০-৯০ দিন পর প্রয়োগ করতে হয়।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
বারি নেগি অনিয়ন-১ এ সাধারণত পার্পল ব্লচ রোগ হয় না, তবে মাঝে মাঝে পাতার অগ্রভাগে স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগের কারণে পাতার অগ্রভাগ কালো বর্ণ ধারণ করে। অধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত আক্রান্ত গাছ, বায়ু ও গাছের পরিত্যক্ত অংশের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগ দমনের জন্য ছত্রাকনাশক অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউপি বা প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক) দ্বারা শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। জমিতে এ রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক, রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি (২ গ্রাম/লিটার পানি), এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি (১ মিলি/লিটার পানি), লুনা সেনসেশন (১ মিলি/লিটার পানি) ১০ দিন পরপর পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে। বারি নেগি অনিয়ন-১ এ কোনো থ্রিপসের আক্রমণ হয় না। তবে কখনও কখনও কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা যেতে পারে, যা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। লার্ভা নেগি অনিয়নের পাতা ছিদ্র করে এবং পাতা খেয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতার ভেতর লার্ভার মল দেখা যায়। লার্ভা দমনের জন্য নেগি অনিয়নের জমিতে কীটনাশক এবামেকটিন বেনজয়েট (প্রোক্লেম/বেল্ট) স্প্রে (১ মিলি/লিটার পানি) করতে হবে। পূর্ণবয়স্ক পোকা দমনের জন্য বিঘা প্রতি ৫টি ফেরোমন ফাঁদ (ঝঢ়ড়ফড়-খঁৎব) ব্যবহার করতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা
বারি নেগি অনিয়ন-১ এ সময়মতো আগাছা নিড়াতে হবে ও পানি সেচ দিতে হবে। গাছের উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে রোপণের এক মাস পর থেকে মাঝে মাঝে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
সংগ্রহ ও ফলন
বীজ বপন সময়ের উপর বারি নেগি অনিয়ন-১ এর জীবনকাল নির্ভর করে। জুলাই (শ্রাবণের প্রথম) মাসে বীজ বপন করলে এ ফসলের জীবনকাল ২৬০-২৭০ দিন (বীজ হতে বীজ সংগ্রহ) হয়। এ মাসে বীজ বপন করলে ১০০-১৮০ দিনের মধ্যে যে কোনো সময়ই সিউডোস্টেম সংগ্রহ করা যায়। এ সময় সিউডোস্টেমের গঠন নরম ও রসালো হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে গাছে ফুল ধরা শুরু হলে সিউডোস্টেম তুলনামূলকভাবে কিছুটা শক্ত হয়ে। হাত দিয়ে সম্পূর্ণ গাছটি সংগ্রহের পর এর থেকে মূল এবং পুরাতন পাতাসহ পাতার শিরা (পত্রফলকের নিচের অংশ) ফেলে দিয়ে ২-৩টি নেগি অনিয়ন (সিউডোস্টেমসহ পাতা) লম্বা পলিথিন মোড়কের মধ্যে ঢুকিয়ে বাজারজাত করলে নেগি অনিয়ন তাজা থাকে। বারি নেগি অনিয়ন-১ (পাতাসহ সিউডোস্টেম) এর ফলন বিঘাপ্রতি ২.৫-৩.৩ মে. টন (২০-২৫ মে. টন/হেক্টর)। নেগি অনিয়ন পলিথিনের ভেতরে রেখে এক মাস পর্যন্ত রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা যায়। বীজের ফলন হেক্টর প্রতি ১৫০-১৭০ কেজি। বীজের ফলন রোপণ দূরত্ব, প্রতি গোছায় ফুল দ-ের সংখ্যা এবং অন্যান্য পরিচর্যার উপর ভিত্তি করে কমবেশি হতে পারে। বারি নেগি অনিয়ন-১ এর ১০০০টি বীজের ওজন ২.০০-২.৫০ গ্রাম।
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২-৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর। মোবাইল : ০১৭১১-৫৭৩৩৬১, ই-মেইল :khanalauddinsrsc@gmail.com