Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মাছের-আঁইশ-সম্ভাবনাময়-রপ্তানি-পণ্য

মাছের আঁইশ সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য 
এ. এম. ফরহাদুজ্জামান১ 
মোঃ সুজন খান২ 
মেহেদী হাসান ওসমান৩
পৃথিবীতে যেসব দেশ মাছ উৎপাদনে এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের মধ্যে ৫ম (জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট-২০২২)। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৭.৫৯ লক্ষ মে. টন মৎস্য উৎপাদন হয়েছে এবং সে অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য মিলিয়ে ৭৪ হাজার মে. টনের কিছু বেশি পরিমাণ রপ্তানি করা হয় (জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৩ সংকলন, মৎস্য অধিদপ্তর)। অর্থাৎ উৎপাদিত সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ বাজারের ভোক্তার চাহিদা মিটিয়েছে। একসময় জলাশয় থেকে মাছ ধরে বা বাজার থেকে কিনে এনে বাসা-বাড়িতে কুটে ধুয়ে রান্না করে খাওয়া আমাদের দেশে খুবই সাধারণ চিত্র ছিল। তবে আধুনিক সমাজে মানুষের কর্মব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে বদলে যেতে শুরু করেছে এ চিত্র। শহর ও গ্রামের অধিকাংশ বাজারেই এখন বিক্রেতাই ক্রেতার মাছ কেটে দিচ্ছেন। ঘরের মতো এসব মাছ বাজারেও মাছের আঁইশ জমা করে একসময় ফেলে দেওয়া হতো। তবে ফেলে দেওয়া সেই আঁইশই এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের। ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশ হতে ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু মাছের আঁইশ রপ্তানি শুরু হলেও এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে রপ্তানিকারক পর্যায়ে মাছের আঁইশ পৌঁছাতে মাঠপর্যায়ের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকারীদের মধ্যে একটি নিবিড় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে।  
মাছের আঁইশের ব্যবহার
বিশ^ব্যাপী মাছের আঁইশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যবহার রয়েছে, যা নি¤েœ উল্লেখ করা হলো : মাছের আঁইশ থেকে কোলাজেন ও জিলেটিন তৈরি করা হয়। এসব উপাদান দিয়ে ঔষধ শিল্পে ক্যাপসুলের খোসা তৈরি করা হয়; মাছের আঁইশে গ্রাইসিন, প্রোলিন, হাইড্রোক্সিপ্রোলিন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অ্যামাইনো এসিড থাকায় এর পাউডার স্যুপের সাথে খাওয়া হয়; মাছের আঁইশ কোলাজেন সমৃদ্ধ হওয়ায় কৃত্রিম কর্ণিয়া ও কৃত্রিম হাড় তৈরিতে ব্যবহার করা হয়; প্রসাধন শিল্পে মাছের আঁইশ থেকে আহরিত গুয়ালিন যৌগ লিপস্টিক ও নেইল পলিশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়; মাছের আঁইশের নির্যাস হতে তৈরি হয় কৃত্রিম মুক্তা। মাছের আঁইশের সঙ্গে স্টোন ও ফেব্রিকস মিশিয়ে গয়না তৈরি করা হচ্ছে; চীন ও জাপানে মাছের আঁইশ ব্যবহার করে বায়ো পাইজোইলেকট্রিক ন্যানো জেনারেটর তৈরি করা হয়, যেগুলো দ্বারা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া যায়; মহিলাদের গয়না, কানের দুল, গলার মালা প্রভৃতি তৈরি হয় মাছের আঁশ থেকে এবং মাছ ও পোলট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।
মাছের আঁইশের রপ্তানি বাজার
বাংলাদেশ হতে মাছের আঁইশ মূলত জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে ১০-১২ জন ব্যবসায়ী মাছের আঁইশ রপ্তানির সাথে জড়িত। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে মোট ৩,০২২ টন মাছের আঁইশ রপ্তানি করা হয় যেখান থেকে আয় হয় ৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সাত মাস পর্যন্ত ২,৮৭৪ টন মাছের আঁইশ রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, এ খাত হতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪.২৬ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬.২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা আয় হয় অর্থাৎ প্রতি বছর মাছের আঁইশ হতে আশা জাগানিয়া হারে রপ্তানি আয় বাড়ছে। 
মাছের আঁইশ সংগ্রহ পদ্ধতি 
স্থানীয় বাজারের মাছ কাটার বটিওয়ালাদের কাছ থেকে মাছের আঁইশ সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করার পর অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন- মাছের পাখনা, লেজের অংশ, কানের অংশ, গাছের পাতা ইত্যাদি বাছাই করে ফেলে দেয়া হয়। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ২-৩ দিন রোদে শুকানো হয়। মাছে পাঁচ ধরনের আঁইশ দেখতে পাওয়া যায় যথা- কসময়েড, প্লাকয়েড, গ্যানয়েড, সাইক্লয়েড ও টিনয়েড। যেসব আঁইশ চাকতির মতো, প্রায় গোলাকার এবং কিনারা মসৃণ হয় তাদের সাইক্লয়েড আঁইশ বলে। রুই, কাতল, মৃগেল ইত্যাদি মাছে এ ধরনের আঁইশ থাকে। রপ্তানির জন্য বাজারে হতে সাধারণত এসব প্রজাতির মাছের আঁইশই বেশি সংগ্রহ করা হয়। বাজার হতে সংগ্রহের সময় ভেজা আঁইশ গড়ে ১০-১২ টাকা প্রতি কেজি এবং শুকনোর পরে এসব আঁইশ রপ্তানিকারকের নিকট ৬০-৭০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি করা হয়। প্রায় প্রতি ৩ কেজি ভেজা মাছের আঁইশ রোদে শুকানোর পর সাধারণত ১ কেজি শুকনা আঁইশ পাওয়া যায় (৩:১)। 
মাছের আঁইশ ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতাসমূহ : বেশির ভাগ পরিবার পর্যায়ে মাছের এই আঁশ উচ্ছিষ্টাংশ বা বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়, ফলে এর অর্থমূল্য মিলে না; মাছের আঁইশ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য অপ্রতুল প্রচার-প্রচারণা; মাছের আঁইশ হতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান তৈরিতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণার অভাব; সরকারি বা বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব; রপ্তানি আয়ে আলাদা খাত হিসেবে তথ্য না থাকা; রপ্তানিতে উপযুক্ত সরকারি প্রণোদনা না থাকা এবং আঁইশ প্রক্রিয়াজাতকরণে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। 
মাছের আঁইশের সম্ভাবনা 
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৫ টন মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বর্তমানে রফতানিকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন বিভিন্ন বাজার থেকে ১০ টন করে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে থাকে। এতে প্রতি মাসে ৩০০ টন মাছের আঁশ রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। তবে স্থানীয় বাজারে পাওয়া মাছের আঁশ সম্পূর্ণরূপে রফতানি উপযোগী করা গেলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রতি মাসে ৭৫০ টন। ঘরে ঘরে মাছের যে আঁশ পাওয়া যায় তা এখনো বাজারের বাইরে রয়ে গেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টারকেও এই প্রক্রিয়ার আওতায় আনা গেলে বর্জ্য হিসেবে স্বীকৃত মাছের আঁশ রপ্তানি করে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। 

লেখক : ১ব্যবস্থাপক; ২-৩উপব্যবস্থাপক; পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকা, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৯৩০৯০৬৪।