প্রাণিজ খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
কৃষিবিদ ডক্টর এস. এম. রাজিউর রহমানবাংলাদেশে খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর বর্তমান অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ খাত এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে, কারণ এটি দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জীবিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দুধ, মাংস, ডিম এবং অন্যান্য প্রাণিসম্পদজাত পণ্যের মান উন্নত করে জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অবদান রাখছে। তবে এই খাতের অগ্রগতির জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাণিস্বাস্থ্য, সঠিক খামার ব্যবস্থাপনা, এবং পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা অপরিহার্য। দেশের দারিদ্র্য হ্রাস, পুষ্টি উন্নয়ন এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, জাতিসংঘের তিনটি প্রধান লক্ষ্য জিরো হাঙ্গার (ক্ষুধামুক্তি), জিরো প্রভার্টি (দারিদ্র্যমুক্তি) এবং জিরো নিঃসরণ (শূন্য কার্বন নিঃসরণ) বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থায় একটি কার্যকর নীতি ও পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে। তিন জিরো তত্ত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনকে টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুধামুক্তির জন্য কৃষি পণ্য ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা, দারিদ্র্যমুক্তির জন্য কৃষকদের আয় বাড়ানো এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্যক্রম সীমিত করা প্রয়োজন। এর ফলে, বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে কাজ করবে।
বৈশ্বিকভাবে ৬৯০ মিলিয়ন মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নেই এবং প্রায় ৩ বিলিয়ন মানুষ সুষম খাবার থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশে অপুষ্টি এখনও একটি বড় সমস্যা, বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর উচ্চমাত্রায় অপুষ্টির চিত্র হলো খর্বতা ২৪%, কৃশতা ১১%, কম ওজন ২২%। যা প্রধানত প্রোটিন এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতির কারণে হয়ে থাকে। প্রাণিজ আমিষ যেমন দুধ, মাংস, এবং ডিম, অপুষ্টি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ এগুলো উচ্চ মানের প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, এবং ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। অপুষ্টির সমস্যাকেও সমাধান করতে হলে প্রাণিজ উৎস খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বাংলাদেশে প্রাণিজ খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতে আর্থিক প্রণোদনা, খাদ্য ও সার রপ্তানির বিধি-নিষেধগুলো তুলে নেওয়া, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, প্রযুক্তি বিনিময়, খাদ্য অপচয় রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ প্রয়োজন। এখানে বাংলাদেশে প্রাণিজ খাদ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সাপ্লাই চেইন এবং অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ
প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে সাপ্লাই চেইন এবং অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা লক্ষ্য করা যায় যে জীবন্ত মুরগির মার্কেট/কসাইয়ের দোকানে অপর্যাপ্ত স্যানিটারি পরিদর্শন করা হয় এবং প্রাণিচিকিৎসক বা অন্যান্য পরিদর্শকদের এই বিষয়ে পরিদর্শন পদ্ধতিতে ভূমিকা রাখার খুব কম সুযোগ রয়েছে। লাইভ বার্ড মার্কেট এবং কসাইয়ের দোকানে পরিচ্ছন্নতা এবং কার্যকরী জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত কার্যকরী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন; যা একটি নিয়ন্ত্রক কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে হতে পারে। তাই বাংলাদেশে দুধ, মাংস, এবং ডিমের সরবরাহ শৃঙ্খল এখনও সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা মানদ- অনুসরণ না করায় খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর জীবাণু, রাসায়নিক পদার্থ, ও অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত দুধ ও মাংসের ক্ষেত্রে চেইন অবকাঠামো যেমন খামার থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ, ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা, এবং বাজারজাতকরণে উত্তম অনুশীলনের অভাব; সংক্রামক রোগ এবং খাদ্যবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এই কারণে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি যাতে ভোক্তারা নিরাপদ এবং পুষ্টিকর পণ্য গ্রহণ করতে পারে।
কোল্ড চেইন লজিস্টিকসের বিকাশ বিশেষত হিমাগার সুবিধার প্রাপ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, পচনশীল পণ্য যেমন- মাংস ও দুগ্ধজাত দ্রব্য, সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে খাদ্য বর্জ্য কমবে এবং খাদ্য পণ্যের গুণমান ও নিরাপদতা উন্নত হবে। এ ছাড়া রেফ্রিজারেটর ভ্যান, কসাই এবং মিষ্টির দোকানের জন্য ডিসপ্লে রেফ্রিজারেটরসহ অন্যান্য কোল্ড চেইন সরঞ্জামের সহজলভ্যতা খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। গরু, হাঁস-মুরগির মাংসের জন্য আধুনিক কসাইখানা স্থাপন এবং হিমায়িত মাংস ও দুধের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ভোক্তাদের মধ্যে হিমায়িত খাবারের নিরাপদতা ও উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় উন্নত অবকাঠামো ও দ্রুত পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে খামার উৎপাদনের এবং সংগ্রহের পরে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে বাজারে পণ্য পৌঁছানো সহজতর করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে সঠিক অবকাঠামো ও কোল্ড চেইন প্রযুক্তির উন্নতি খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টেকসই প্রাণিপালনকে উৎসাহিত করা
টেকসই কৃষিকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক এবং পরিবেশবান্ধব অনুশীলনের প্রয়োজন রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কৃষকদের খরা, লবণাক্ততা এবং বন্যা-প্রতিরোধী ফসল ও সবুজ ঘাস চাষে উৎসাহিত করা জরুরি। একইসঙ্গে, জল-দক্ষ সেচ ব্যবস্থা এবং জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক প্রাণিশেড উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাণি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। কৃষি বনায়ন প্রযুক্তির প্রবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ, যা মাটির উর্বরতা ও বায়ুম-লের কার্বন শোষণে ভূমিকা রাখতে পারে। সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব, যেখানে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে টেকসই কৃষি অনুশীলন প্রচার করা হয়। জলবায়ু-স্মার্ট পদ্ধতিতে প্রাণিসম্পদের খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং আবাসনের উন্নয়ন করা হয়, পাশাপাশি জলবায়ু-স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকরা টেকসইভাবে বেশি দুধ, মাংস এবং ডিম উৎপাদন করতে সক্ষম হন, যা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক হয় এবং খাদ্য ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
প্রাণি খাদ্যে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রোটিন বেশি মিথেন তৈরি করে যা গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণ হয়। তাই মিথেন নির্গমন কমাতে গবাদি পশুদের জন্য ব্যালেন্স খাদ্যে সরবরাহ করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ধরনের পদ্ধতিগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমায়। এর মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাওয়াতে সহায়ক।
খাদ্য নিরাপদতা এবং ট্র্যাসেবিলিটি উন্নত করা
খাদ্য নিরাপদতা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করা এবং উত্তম কৃষি অনুশীলন (এঅচ), ভাল প্রাণিপালন চর্চা (এঅঐচ), এবং ভাল উৎপাদন অনুশীলন (এগচ) মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। প্রাণিজ খাদ্যের ক্ষেত্রে, যেমন (দুগ্ধ ও মাংস) ট্র্যাসেবিলিটি সিস্টেমের বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এর মাধ্যমে খামার থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়, যা দূষণ ও সংক্রমণের উৎস দ্রুত শনাক্ত করতে এবং পণ্যের গুণমান বজায় রাখতে সহায়ক। বিশেষত, বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা নির্দেশ করে যে ভালো মানের প্রাণিপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের অভ্যাসগুলো অনুসরণ করলে ভোক্তার আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমে। উদাহরণস্বরূপ, দুগ্ধ ও মাংস শিল্পে শীতলীকরণ শৃঙ্খল, সঠিক লেবেলিং এবং উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখসহ ট্র্যাসেবিলিটি ব্যবস্থা চালু করা ভোক্তাদের সুরক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
বৈচিত্র্যময় এবং পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের প্রচার
সরকার, বেসরকারি খাত এবং এনজিওগুলো একসাথে কাজ করে কৃষকদের উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন ফসল চাষে ও পশুপালনে উৎসাহিত করছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনের প্রদর্শনী প্লট বা খামার এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রচারাভিযান খাদ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য একটি সমাধান হতে পারে। টেকসই প্রাণিসম্পদ ও হাঁস-মুরগির পালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং বায়োসিকিউরিটি পদ্ধতি অনুসরণ করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে নিয়মিত টিকা এবং ডি-ওয়ার্মিং, উন্নত হাউজিং ও স্যানিটেশনের অভাবে দুগ্ধজাত পণ্যের মান ও নিরাপদতা কমে যায়, যা কৃষকদের পণ্যের বাজারমূল্যও প্রভাবিত করে। এ ছাড়াও অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে মহিষ ও গবাদিপ্রাণির খামারগুলোতে নিবন্ধন ও পর্যবেক্ষণের অভাবের কারণে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ও নীতি বাস্তবায়ন, বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থার প্রয়োগ এবং সরকারি সহযোগিতা কৃষি উৎপাদন এবং প্রাণিজ খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ।
সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ
ক্ষুদ্র কৃষক ও কৃষি ব্যবসায়িক উদ্যোক্তাদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং ব্যবসা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তাদের উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের গুণমানের উন্নয়ন সাধন করে এবং বাজারে তাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে শক্তিশালী করে। আধুনিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকদের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের শ্রমিক এবং মালিকদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, লেবেলিং এবং নিরাপদ খাদ্য হ্যান্ডলিংয়ের ওপর শিক্ষামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, সঠিক লেবেলিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের উৎস, উপাদান, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ জানা যায়, যা ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়ায়। খামারের কর্মীদের স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে কোনও জুনোটিক রোগ, প্রাণী ও মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে। খামারের শ্রমিক ও মালিকদেরকে প্রাণী কল্যাণ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং তাদের কল্যাণ সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রাণীদের সঠিকভাবে পরিচর্যা না করলে তাদের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খামার কর্মীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমানো এবং খাদ্য সুরক্ষার মান বৃদ্ধি সম্ভব। এই উদ্যোগগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে সঠিক প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তার মাধ্যমে খামার ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটগুলো আরও দক্ষ ও নিরাপদ হতে পারে।
বাজারব্যবস্থা এবং কৃষকের প্রবেশাধিকার উন্নত করা
উন্নত বাজারব্যবস্থা কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে, যার ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ে। এর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষকের আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের প্রান্তিক অবস্থান থেকে মূলধারায় আনা সম্ভব হয় যা সার্বিকভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের স্থায়িত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে। কৃষিখাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর কার্যক্রম এবং ফিল্ড ভিজিটের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, সমবায় গঠনের মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাজারে সহজ প্রবেশের সুবিধা পাচ্ছে। প্রোডাকশন গ্রুপ গঠন এবং গ্রাম পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ ছাড়া, কৃষক আউটলেট তৈরি করে কৃষি পণ্যের সরাসরি বিপণন নিশ্চিত করা হচ্ছে। আধুনিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বাজারের তথ্য এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস সহজলভ্য করার মাধ্যমে কৃষকরা আরো সঠিক এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং উৎপাদনশীলতার উন্নয়নে সহায়ক। মাঠ অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাজার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ তাদের জীবিকা ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার সুবিধা
খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ খাতে। ক্ষুদ্র কৃষক, মহিলা এবং যুবকদের কৃষি ও কৃষি ব্যবসায় আরও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভর্তুকি এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রদানকারী নীতিমালা বাস্তবায়ন একটি কার্যকর পদক্ষেপ। এটি তাদের উৎপাদনশীলতা এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ বাড়ায়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সরকারি, বেসরকারি খাত, এনজিও এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করে উদ্ভাবন ও বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে পারে, যা প্রাণিজ খাদ্য খাতের প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক। আঞ্চলিক সহযোগিতা যেমন- ফুডব্যাঙ্ক স্থাপন, নদীর পানি বণ্টন, বন্যার পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদান, কৃষকদের জন্য টেকসই সমাধান প্রদান করতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রাণিসম্পদ শিক্ষা ও গবেষণায়; ন্যানো-টেকনোলজি, বায়ো-ইনফরমেটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা ব্যবহার এবং উন্নত প্রাণিসম্পদ প্রযুক্তিকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো একত্রে প্রাণিসম্পদ খাতের খাদ্য ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটাতে পারে, যা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
পরিবেশগত স্থায়িত্বকে সম্বোধন করা
প্রাণিসম্পদ খাতে পরিবেশগত স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, কৃষিতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস করার জন্য প্রাণি খাদ্য ব্যবস্থাপনা, চারণভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং গবাদি প্রাণির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অনেক খামারেই বর্জ্য, যেমন গোবর বা অন্যান্য উৎপন্ন বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপিত হয় না যার ফলে মাটি এবং পানির দূষণ ঘটে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সঠিক গোবর ব্যবস্থাপনা, যেমন- বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের মাধ্যমে বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা, পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি সার উৎপাদনে সাহায্য করতে পারে, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি খামারগুলোর উৎপাদনশীলতাও বাড়ানো সম্ভব।
সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, প্রাণিজ খাদ্য ব্যবস্থার এ ধরনের রূপান্তর কেবলমাত্র উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। এটি দেশের কৃষি খাতকে আরও স্থিতিশীল ও টেকসই করে তুলবে যা জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
লেখক : পরামর্শক (প্রাণিসম্পদ ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ), আইআরজি- বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, কুল চেইন প্রকল্প। মোবাইল : ০১৭১৭৯৭৯৬৯৭, ই-মেইল :smrajiurrahman@yahoo.com