Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বোরো-মৌসুমে-ধান-চাষের-আধুনিক-উৎপাদন-প্রযুক্তি

বোরো মৌসুমে ধান চাষের আধুনিক 
উৎপাদন প্রযুক্তি
মাহাজুবা তাসমিন১ ড. মাসুদ রানা২
ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ লোকের প্রধান খাদ্য ভাত। ঘনবসতিপূর্ণ  বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে অপরদিকে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৩ মৌসুমে ধান চাষ হলেও সবচেয়ে বেশি ফলন আসে বোরো মৌসুমে। বোরো মৌসুমের  জাতগুলোর কোনো আলোক-সংবেদনশীলতা নেই। এ মৌসুমে বীজতলায় অতিরিক্ত  ঠা-ায় চারা নষ্ট হয়ে যেতে পারে আবার ফুল আসার সময় নিম্ন তাপমাত্রা (১৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার কম হলে) ও উচ্চ তাপমাত্রায় (৩৪ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার বেশি হলে) ধান চিটা হতে পারে। তাই এ সময়ে বিশেষ বিশেষ উন্নত প্রযুক্তি, বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জাত ব্যবহার ও সাবধানতা কৃষকের মুখে আনবে সফলতার হাসি ও আমাদের দেবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। 
বীজতলা তৈরিতে বিবেচ্য বিষয়সমূহ
া বীজ তলার জমি উঁচু ও উর্বর হতে হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রচুর আলো- বাতাস পায় এমন জায়গা বাছাই করতে হবে। 
া বীজতলার আকার হবে ১০মি. ী ১.২৫ মি.; ৫-৬ সেমি. সেচসহ জমি ভালোভাবে ২-৩টা চাষ দিয়ে থকথকে কাদাময় করে তৈরি করতে হবে; জমির একপাশ থেকে দৈর্ঘ্য বরাবর ১- ১.২৫ মি: চওড়া করে বীজতলা করতে হবে; দুই বীজতলার মাঝে ৫০ সেমি. ফাকা জায়গা রেখে এবং এই ফাঁকা জায়গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে দুইপাশের বীজতলাকে উচু করে দিতে হবে; বীজতলায় জৈব সার প্রতি বর্গমিটারে ১-১.১৫ কেজি এবং বীজ হার প্রতি বর্গমিটারে ৬০-৮০ গ্রাম প্রয়োজন।
া শৈত্যপ্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে দিতে হবে। তবে, দীর্ঘসময় ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকলে সেখানে দিনে এবং রাতে সবসময় পলিথিন দিয়ে চারা ঢেকে রাখতে হবে এবং বীজতলার উভয়পার্শ্বে পলিথিন আংশিক খোলা রাখতে হবে।
া বীজতলায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নলকূপের পানি ব্যবহার করা ভালো। 
া বীজতলায় পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে। 
া প্রতিদিন সকালে জমা করা শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে।
া চারা পোড়া বা ঝলসানো রোগ দমনের জন্য রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার অ্যাজোস্কিস্ট্রোবিন বা পাইরাক্লোস্টবিন জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজতলায় বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
া চারা রোপণকালে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলে কয়েক দিন দেরি করে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে চারা রোপণ করতে হবে ।
া রোপণের পর শৈত্যপ্রবাহ হলে জমিতে ৬-৭ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে ।
া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণাতে দেখা গেছে প্রচলিত বীজতলার থেকে সবসময় পলিথিন দিয়ে ঢেকে দুইপাশে আংশিক খোলা রাখলে চারা সাদা বা হলুদ হয় না, সুস্থ ও নিরোগ হয়।
বীজতলায় সাধারণ পরিচর্যা
বীজতলায় সবসময় নালাভর্তি পানি ধরে রাখতে হবে। বীজ গজানোর ৪-৫ দিন পর বেডের ওপর ২-৩ সেমি. পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার ব্যবহারের পর ও চারা সবুজ না হলে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম পরিমাণ জিপসাম সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগের পর জমিতে অবশ্যই পানি ধরে রাখতে হবে।
জমি তৈরি 
চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে চাষদিয়ে জমি ভিজিয়ে রাখতে হবে। ১ম চাষের অন্তত ৭ দিন পর্যন্ত জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। ফলে আগাছা, পূর্বের ফসলের গোড়া, পাতা জমিতে পচে ও মিশে জৈবসারে পরিণত হবে এবং রাসায়নিক সার কম লাগবে। মাটির প্রকারভেদে ৩-৫ বার চাষ ও মই দিলে ভালো ফসল হয়। চাষের গভীরতার ওপর চারা লেগে যাওয়া ও সারের কার্যকারিতা নির্ভর করে। সিংগেল বোরো এলাকায় শুধু আগাছা সরিয়ে জিরো টিলেজ এ চারা রোপণ করা যায়। সিংগেল বোরো এলাকায় যদি আগাছার প্রকোপ বেশি হয় তবে হার্বিসাইড প্রয়োগ করে আগাছা দমন করা যায়। শেষ চাষের সময় অনুমোদিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সময়মতো বীজ বপন ও চারা উৎপাদন
বোরো মৌসুমে নভেম্বর ১৫-৩০ তারিখ বীজ বপনের উপযুক্ত সময় জানুয়ারি ১৫-৩০ রোপনের উপযুক্ত সময়। ঠা-াপ্রবণ এলাকায় একটু বিলম্ব হয় এবং একক বোরো এলাকায় একটু আগাম হয়। ধানের বীজ বপন ও রোপণের উপযুক্ত তাপমাত্রা ১৭-৩৪ ডিগ্রি সে.। বোরোতে চারা রোপণে বিলম্ব করলে বন্যার কবলে পড়তে পারে; বোরোতে আগাম রোপণ করলে ফুল ফোটা ঠা-ার মধ্যে পড়লে চিটা বেশি হবে।
রোপণ সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ 
চারার বয়স বোরোতে ৩৫-৪০ দিন সবচেয়ে ভালো। চারার বয়স যত বেশি হবে ফলন তত কম হবে। প্রতি গুছিতে চারার সংখ্যা ২-৩ টিই যথেষ্ট; বেশি চারা ব্যবহার করলে ছড়া কম হবে এবং প্রতি ছড়ায় ধান কম হয়ে ফলন কম হবে। চারা রোপণ গভীরতা ২-৩ সেমি. এর বেশি হওয়া ঠিক নয়। গভীরতা বেশি হলে গোছায় কুশি কম হবে এবং ফলন কম হবে। রোপণ দূরত্ব  ২০ ী ২০ সেমি. এবং নাবিতে ১৫ ী২০ সেমি. উত্তম।
বোরো মৌসুমে মেকানিক্যাল ট্রান্সপ্লান্টারের জন্য ট্রেতে  চারা উৎপাদন
শীতকালে চারা উৎপাদন করা বেশ কঠিন। ট্রেতে ৭৫% মাটি ও ২৫% ধানের তুষ ব্যবহার করে চারা তৈরি করলে উন্নতমানের চারা পাওয়া যায়। কারন ধানের তুষ  শিকড়ের তাপমাত্রা ধরে রাখে। যখন তাপমাত্রা অনেক কমে যায় (<১০ ডিগ্রি) তখন চারাগাছ তার শারীরবৃত্তিয় কাজ সম্পন্ন করতে পারেনা ও সাদা হয়ে যায়। তাই ১০০% মাটির পরিবর্তে ৭৫% মাটি ও ২৫% ধানের তুষ ব্যবহারে চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। রোপণের সময় চারার বয়স ও সার উপরিপ্রয়োগ সারণি দ্রষ্টব্য।
সার ব্যবস্থাপনায় বিশেষভাবে লক্ষণীয় 
মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সারের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া যে জাত ব্যবহার করা হবে সেটার উপর সার গ্রহণ ক্ষমতা ও জীবনদৈর্ঘ্য বিবেচনা করতে হবে; প্রতি হেক্টর জমিতে ১-২ টন পচা গোবর সার কিংবা পোলট্রি বিষ্ঠা প্রয়োগ করলে নির্ধারিত মাত্রার অর্ধেক ইউরিয়া সার  দিলেই চলবে; দানাদার ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে সারের অপচয় কম হয় এবং সারের কার্যকারিতা বাড়ে; ইউরিয়া সার কয়েকবারে ভাগ করে (সাধারণত তিন ভাগে) দেওয়া হয়। প্রথম ভাগ রোপণের পর চারা যখন দাড়িয়ে যায়, ২য় ভাগ যখন গাছ দ্রুত কুশী ছাড়তে থাকে এবং শেষ ভাগ কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে; ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার যেমন টিএসপি/ডিএপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট শেষ চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। প্রতি কেজি ডিএপি সারের জন্য ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া সার কম ব্যবহার করা লাগবে; জিংক সালফেট ফসল চক্রের কোনো একটিতে ব্যবহার করলে তা পরবর্তী একটি বা দুটি ফসলে প্রয়োগ না করলেও চলে; যে জমিতে সালফার বা দস্তার অভাব আছে সে জমি তৈরির সময় সালফার ও দস্তা ব্যবহার করতে হবে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের পর ও ধানগাছ যদি হলদে থাকে এবং বাড়-বাড়তি কম হয় তবে জমি থেকে পানি সরিয়ে বিঘাপ্রতি ৮ কেজি জিপসাম সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। যদি ধানগাছ মাঝে মধ্যে খাটো হয়ে বসে যায় এবং পুরনো পাতায় মরচে পড়া বাদামি রঙ থেকে কমলালেবুর রং ধারণ করে তখন বিঘাপ্রতি ১.৫ কেজি দস্তা সার ব্যবহার করতে হবে; জৈবসার বীজ অথবা চারা রোপণের কমপক্ষে ৭-১০ দিন পূর্বে প্রয়োগ করা হয় এবং মাটির সাথে ভালোভাবে মিশানো হয়।
ধান শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রধান ফসলই নয় গোলাভরা সোনালী ধান প্রত্যেক কৃষকের সুমধুর স্বপ্ন। বোরো ধানের ফলন বাড়ানোর জন্য শুধুমাত্র আধুনিক জাত ব্যবহারই যথেষ্ট নয়, যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক ও ঘাতসহনশীল উপযুক্ত জাত বাছাই, সময়মতো ও সঠিকভাবে চারা রোপণ, সঠিক সার, পানি ও আগাছা ব্যবস্থাপনা, কৃষকদের মুঠোফোনে বিশেষ আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিশেষ সময়ে কৃষি বিভাগ থেকে প্রেরণ ও কৃষিভিত্তিক অ্যাপ ব্যবহার ইত্যাদি নিশ্চিত করলে কাক্সিক্ষত ফলন আসবে এবং বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
 
লেখক :  ১অতিরিক্ত কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল নম্বর: ০১৮৬২৫৫৩০১২, ইমেইল আড্রেস: সধযধলঁনধঃধংসরহ@মসধরষ.পড়স ২সিনিয়র সায়েন্টফিক অফিসার, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর। মোবাইল নম্বর: ০১৭১৯৫২৯১৭৮, ইমেইল  masudrana.brri@gmail.com