Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

তুলা-ফসলের-আধুনিক-বালাই-ব্যবস্থাপনা

তুলা ফসলের আধুনিক বালাই ব্যবস্থাপনা
অসীম চন্দ্র শিকদার
বর্তমান সময়ে তুলা একটি লাভজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ মাঠ ফসল। তুলা এবং তুলা উৎপাদনের উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই তুলা উৎপাদনের জন্য আমাদের কৃষক ভাইদের অধীক যত্নবান ও আধুনিক কলাকৌশল গ্রহণ করতে হবে। তুলা চাষের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে বালাই ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিবেশকে দূষণমুক্ত রেখে আধুনিক সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) পদ্ধতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। তুলা চাষে আধুনিক বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) ৫টি ধাপ নিয়ে নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
তুলার উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী সংরক্ষণ : লেডি বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, মাকড়সা, ড্যামসেল ফ্লাই এবং কালো পেঁচার মতো কিছু পাখি তুলার ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে তুলা ফসল রক্ষা করে। তাই এদের তুলার উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী বলা হয়। এরা তুলার ক্ষতিকর পোকামাকড়-এর মথ, লার্ভা, ডিম খেয়ে তুলা ফসল রক্ষা করে। তাই এই সকল উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। লেডি বার্ড বিটল-এর কীড়া একদিনে ২৫০ থেকে ৩০০টি তুলার জাবপোকা বা এফিড খেয়ে থাকে। উপকারী বোলতা ক্ষতিকর কীড়া বা লার্ভার উপর ডিম পারে। পরে ডিম ফোটে কীড়া বেড় হয়ে ক্ষতিকর লার্ভা/কীড়া খেয়ে থাকে। তাই কীটনাশক স্প্রে করার আগে ফসলে ক্ষতিকর পোকা ও উপকারী পোকার সংখ্যা নির্নয় করে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় স্কাউটিং। যখন ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা অর্থনৈতিক দারপ্রান্ত অতিক্রম করবে তখনই কীটনাশক/বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ তুলাচাষিদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
বালাই সহনশীল জাতের চাষাবাদ : তুলার কোন জাত জ্যাসিড প্রতিরোধী, কিছু জাত বোলওয়ার্ম প্রতিরোধী। এছাড়া বিটি কটন প্রায় সকল প্রকার পোকামাকড় প্রতিরোধী। আবার কিছু কিছু জাত রোগ প্রতিরোধী। হাইব্রিড জাতের তুলাতে সাধারণত রোগ ও পোকার আক্রমণ কম দেখা যায়। তাই জমির প্রকৃতি ও অবস্থান বিবেচনা করে জাত নির্বাচন করতে হবে। এ ব্যাপারে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণের নিকট হতে সাহায্য পাওয়া যাবে। 
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যবহার :  আধুনিক চাষাবাদ বলতে পরিচ্ছন্ন ও নিয়মতান্ত্রিক চাষাবাদ বুঝায়। যেমন- গভীর, ঝুর ঝুরা করে জমি চাষ করা, জমি ভালোভাবে আগাছা মুক্ত করা, প্রয়োজন হলে মাটি শোধন করা ইত্যাদি। এ ছাড়া সুস্থ সবল এবং ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করা বীজ ব্যবহার,  সঠিক দূরত্বে বীজ বপন, পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম সার ব্যবহার, সময়মতো আগাছা দমন, সময়মতো চারা পাতলা এবং গ্যাপ পূরণ, সময়মতো রাসায়নিক সার পার্শ প্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ প্রয়োগ, পাতা কর্তন ও অঙ্গছাঁটাই ইত্যাদিও আধুনিক চাষাবাদ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। জমির অবস্থান ও প্রকৃতি অনুসারে আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের তুলা বীজ নির্বাচন করতে হবে। বন্যাপ্রবণ অথবা চর অঞ্চলে আধুনিক জাতের তুলা চাষ করা বাঞ্ছনীয়। আর বন্যামুক্ত উর্বর  জমিতে হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করাই উত্তম।  
তুলা জমিতে প্রয়োজনের বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। আবার ফসফেট বা পাটাশ সার প্রয়োজনের চেয়ে কম ব্যবহার করলেও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে এবং ফলনও কম হবে। তাই তুলা ফসলে সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা জরুরি। জৈবসার মাটি ও তুলা ফসলের জন্য ভালো। এতে তুলার আঁশের মান উন্নত হয়। তাই যতটা সম্ভব তুলা জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতো হবে। তুলা ফসলের জন্য পটাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সার; তাই চাহিদা মোতাবেক পটাশ সার প্রয়োগ এবং পটাশ সারের ফলিয়ার স্প্রে নিশ্চিত করতে হবে। সময়মতো জমিতে সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘন ঘন জমি পরিদর্শন করতে হবে। এতে তুলা জমির তাৎক্ষণিক অবস্থা সহজে নজরে আসে এবং সে মতো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। এতে ফসলের সাথে কৃষকের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে।
যান্ত্রিক দমন পদ্ধতি : তুলা ফসলে জ্যাসিড ও সাদা মাছির  আক্রমণ হলে আঠালো সাদা ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করে দমন করা যায়। আঠালো পদার্থ হিসেবে সাধারণত মবিল ব্যবহার করা হয়। সাদা মাছির ক্ষেত্রে আঠালো হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। বিঘা প্রতি ৪টি হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাখি বসার জন্য তুলা জমিতে ডাল, বাঁশের কনচি পুঁতার ব্যবস্থা করতে হবে, অথবা হাতে প্রস্তুত ডেড পার্চিং ব্যবহার করতে হবে। এ সব ডালে বা পার্চিং-এ পাখি বসে সহজেই তুলার ক্ষতিকর মথ ও কীড়া খেয়ে ফসলের ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনে। আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে ক্ষতি কর পোকামাকড় দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। আঁচা পোকার মথ প্রথমে পাতার নিচে ডিম পারে, ডিম ফোটে কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ঝাঝরা করে ফেলে, পরে কুড়ি, ফুল ও ফলে আক্রমণ করে। হাত বাছাই করে আক্রান্ত পাতা  সংগ্রহ করে দমন করতে হবে। রৌদ্রের সময় তুলা গাছের কচি ডগা ঢলে পড়লে বুঝতে হবে বোলওয়ার্মের আক্রমণ হয়েছে। লক্ষণ দেখা মাত্র ডগা চিরে হাত দ্বারা কীড়া সংগ্রহ করে দমন করতে হবে। হাতজাল ব্যবহার করেও ক্ষতিকর পোকার মথ ধরে দমন করা যায়। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে আঁচাপোকা ও বোলওয়ার্ম দমন করা যায়। সময়মতো পাতা ছাঁটাই ও অঙ্গ ছাঁটাই করলেও অনেক রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়। কারণ এতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ফসলের জমিতে প্রবেশ করতে পারে। 
রাসায়নিক দমন ব্যবস্থা : পোকার আক্রম অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা অতিক্রম করলেই কেবল রাসায়নিক দমনব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ জ্যাসিডের অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা হলো গড়ে প্রতি পাতায় ২টি নিম্ফ এবং বোলওয়ার্মের ক্ষেত্রে  প্রতি চারটি গাছে গড়ে ১টি লার্ভা; এর বেশি হলেই কীটনাশক ব্যবহার করে দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বালাই দমনের সর্বশেষ ব্যবস্থা হলো কীটনাশক/বালাইনাশক ব্যবহার করে বালাই দমন। তুলা ফসলের রোগের মধ্যে চারা গাছের রোগ, ঢলে পড়া রোগ, পাতায় দাগ পরা রোগ, বোল রট, স্টেম রট, এ্যানথ্রাকনোজ, ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট ইত্যাদি দেখা যায়। তুলা ফসল রোগে আক্রান্ত হওয়া মাত্র আক্রান্ত গাছ বা অংশ জমি থেকে তুলে ধ্বংস করতে হবে এবং ছত্রাক/ব্যাকটেরিয়ানাশক নির্ধারিত মাত্রায় ফসলে স্প্রে করতে হবে যাতে বাকি ফসল আক্রান্ত হতে না পারে। 
তুলা গাছের এক থেকে দেড় মাস বয়সে জ্যাসিড ও এফিডের আক্রমণ ঘটে থাকে। 
প্রাথমিক অবস্থায়  সাবান পানি স্প্রে করে দমন করা যায়। আক্রমণ সীমা অতিক্রম করলে যে কোন সিস্টেমিক জাতীয় কীটনাশক নির্ধারিত মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচে ও গাছের ডগায় স্প্রে করে ঐ সকল পোকা দমন করতে হবে। মনে রাখবেন জ্যাসিড ও এফিড-এর আক্রমণ কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। আঁচা পোকা ও বোলওয়ার্মের ক্ষেত্রে কন্টাক্ট কীটনাশক নির্ধারিত মাত্রায় বিকেলের দিকে জমিতে স্প্রে করে করে দমন করতে হবে। কীটনাশক সব সময় মৃদু রৌদ্রে এবং বিকেলের দিকে প্রয়োগ করতে হবে।   
রাসায়নিক ব্যবহারে সতর্কতা : বালাইনাশক ব্যবহারের পূর্বে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের নির্দেশিকা পড়তে হবে এবং তা মেনে চলতে হবে। নিরাপত্তামূলক পোশাক পরিধান এবং নাকে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। চোখে চশমা ব্যবহার করতে হবে। খালি পেটে স্প্রে কাজ করা যাবে না এবং কীটনাশক প্রয়োগের সময় পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ব্যবহারের পর সাইন বোর্ড/লাল কাপড়/বালাইনাশকের প্যাকেট/বোতল টাঙিয়ে দিতে হবে। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। স্প্রে-মেশিন ব্যবহারের পর মুক্ত জলাশয়ে ধৌত করা যাবে না। স্প্রে-কাজ করার পরই সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করবেন। মনে রাখবেন বালাইনাশক একধরনের বিষ। বালাইনাশক ফসলকে রক্ষা করলেও মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সঙ্গে উপকারী পোকামাকড়ও মারা যায়। তাই বালাইনাশক ব্যবহারের পূর্বে স্কাউটিং করে নেয়া জরুরি।
সঠিকভাবে আধুনিক বালাই ব্যবস্থাপনার  সকল ধাপ কৃষক ভাইরা যদি পালন করেন তবে তুলা ফসলের বালাই নিয়ন্ত্রণে সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ক্ষতি যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি কৃষি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কমবে আর উৎপাদন খরচও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। 
চাষির মঙ্গল তুলা চাষে
দেশের মঙ্গল বস্ত্রশিল্পে

লেখক : কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, মোবাইল নং ০১৫৫২-৩৬২৯০১, ১০৪/১ (বি-২), শেরেবাংলা রোড (কাটাসুর), জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭।