Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তায় বাড়ির আঙ্গিনায় কবুতর পালন

পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তায় বাড়ির আঙ্গিনায় কবুতর পালন
ড. হোসেন মোঃ সেলিম
বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা নিরসনকল্পে হাঁস-মুরগির পাশাপাশি কবুতর পালন হয়ে উঠতে পারে একটি  উল্লেখযোগ্য উৎপাদন খাত। কবুতর খুব সহজেই যে কোন প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপখেয়ে চলতে পারে এবং সহজেই পোষ মানে। বাড়ির যে কোন স্থান বা আঙ্গিনা, বাড়ির ছাদে অল্প জায়গাতেও কবুতর পালন করা যায়। প্রাকৃতিকভাবে পালন করলে কবুতর নিজের খাদ্য নিজেই জোগাড় করতে পারে। কবুতরে তুলনামূলক রোগবালাই কম। শহরে কিংবা গ্রামে অনেক বাড়িতেই কবুতর পালন করা যায়। কবুতর পালন ও উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম এবং দ্রুত ডিম ও মাংস পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় কবুতর পালন ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক। সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্যতার কারণেই করতে উৎপাদিত মাংশ মানুষের পুষ্টির জোগানে আদর্শ ও মানসম্পন্ন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনে ও পুষ্টিহীনতা নিরসনকল্পে বাণিজ্যিকভিত্তিতে কবুতর পালন অল্প সময়ে কম মূলধনে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। কবুতর পালনে প্রথমেই যে প্রশ্নগুলো উঠে আসে তারই সমাধান আলোচনা করা হলো-
উন্নত জাতের কবুতর কোথায় পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের জলবায়ু এবং বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র কবুতর পালনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের প্রায় সকল অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রাম-গঞ্জে কবুতর পাওয়া যায়। অর্থনৈতিকভাবে লালন-পালনের জন্য বাংলাদেশে যেসব অঞ্চলে উন্নত/সৌখিনজাতের কবুতর পাওয়া যায় সেই অঞ্চলগুলো হলো- ঢাকা, নরসিংদী, ঝিনাইদহ, যশোহর, পটুয়াখালী, বরগুনা, নাটোর, রংপুর, ময়মনসিংহ, বান্দরবন ও কক্সবাজার। আবার যেসব বাজারে উন্নত জাতের কবুতর পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ঢাকার কাঁটাবন, মিরপুর-১১, জিঞ্জিরা, টঙ্গি, গাজীপুর, ঠ্যাটারি বাজার, পাবনার বাইপাসহাট এবং বিভিন্ন জেলার শহর অঞ্চলের সৌখিন মার্কেট। ইতোমধ্যে কবুতরের খামার সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন গড়ে উঠেছে যেমন- পাবনা পায়রা পালক সমিতি। আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন কবুতর পালনকারীদের ঠিকানা ও সেবার তথ্য পাওয়া যায়।
খামারে পালনের জন্য কত ধরনের কবুতরের জাত আছে?
খামারের ধরন ও কবুতর পালনের উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে কবুতরের জাতকে মোট ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।
শোভাবর্ধনকারী জাত : প্রকৃতির সৌন্দর্যবৃদ্ধি ও বিনোদনের জন্য এ জাতের কবুতর পালন করা হয় যেমন- কিং, পোটার, ক্রপার, জ্যাকোপিন, ফ্রিলব্যাক, হোমার, রান্ট, ফ্যানটেল ইত্যাদি।
রেসিংজাতের কবুতর : এ জাতের কবুতর সাধারণত দ্রুত বেগে উড়তে পারে এবং নির্দিষ্ট স্থান থেকে আবার নিজ বাসস্থানে ফেরত আসতে পারে। যেমন- রেসিং হোমার, হর্সম্যান ইত্যাদি।
ফ্লাইং জাতের কবুতর : বার্মিংহোম রোলার, ফ্লাইং হোমার, হাম্বলার, কিউমুলেট ইত্যাদি।
মাংস উৎপাদনকারী জাত : মাংসের জন্য অর্থাৎ স্কোয়াব উৎপাদনের জন্য এ জাতের কবুতর পালন করা হয়। যেমন- দেশী জাতের কবুতর- সিরাজী, জালালী, গিরিবাজ, লোটন, বোম্বাই, বাংলা ইত্যাদি।
সুস্থ কবুতরের বৈশিষ্ট্যগুলো কী হতে পারে?
সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন চঞ্চল ও সজীব হবে। পালক এবং মলদ্বার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। ঠোঁট বা মুখ থেকে কোন প্রকার লালা বা মিউকাস পড়বে না। যে কোন ধরনের আঘাতমুক্ত হতে হবে।
খামারের জন্য কবুতর নির্বাচনে/ক্রয়ের সময় কী কী সতর্কতা নেয়া দরকার?
বাণিজ্যিকভাবে খামারে পালনের জন্য কবুতর অবশ্যই পরিচিত খামার থেকে সংগ্রহ করতে হবে। বাজার থেকে কবুতর সংগ্রহ করে খামার স্থাপন না করাই ভালো। নতুন খামারের জন্য দেখে শুনে কবুতরের বাচ্চা, পুলেট কবুতর, কম বয়সী/পূর্ণবয়স্ক কবুতর, উন্নত জাতের কবুতর কেনার অর্ডার দিতে হবে। সংগ্রহের সময় কবুতর জোড়া হিসেবে কিনতে হবে। অপরপক্ষে মাংস ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কবুতর দেশের হাটবাজার বা যারা পালন করে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। কবুতর পরিবহনের সময় বাক্স বা ঝুড়ি ব্যবহার করা উচিত। ঝুড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করে কবুতর পরিবহন করতে হবে। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন ঝুড়িতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের সুযোগ থাকে যাতে কবুতর ভালোভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে পারে। কোন অবস্থাতেই কবুতরের পাখা বেঁধে পরিবহন করা যাবে না। কারণ এতে পাখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কবুতর শারীরিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কবুতরের বাসস্থান কী ধরনের হবে?
কবুতর পালনের উদ্দেশ্য, কবুতরের জাত, বয়স, মূল্য ও কবুতর খামারের ধরনের উপর ভিত্তি করে কবুতরের বাসস্থানকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো- প্রচলিত বা গতানুগতিক ও অপ্রচলিত বা আধুনিক।
প্রচলিত বা গতানুগতিক বাসস্থান : এ ধরনের বাসস্থান সাধারণত গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চল পর্যন্ত প্রাচীনকাল থেকে অদ্যবধি বিদ্যমান। এ ধরনের বাসস্থান সচরাচর বাঁশ, কাঠ, টিন বা মাটির পাত্র দিয়ে তৈরি করা হয়। ঘরের র্দৈঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা ৯ী৩.৭৫ী৩ ফুট হয়ে থাকে। বাঁশের খাঁচায় কবুতরের ঘর পাশাপাশি ও বহুতল বিশিষ্ট হতে পারে। প্রতি জোড়া কবুতরের জন্য ৩০ সেমি. র্দৈঘ্য, ৩০ সেমি. প্রস্থ ও ৩০ সেমি. উচ্চতা বিশিষ্ট খোপ বানাতে হবে। প্রতি তলায় খোপের সামনে ১০-১২ সেমি. বারান্দা এবং প্রতি খোপে ১০ সেমি.ী১০ সেমি. মাপের একটি দরজা রাখতে হবে। 
অপ্রচলিত বা আধুনিক : কবুতরের ঘর ১৫ী১২ী৮ ঘনফুট বিশিষ্ট একতলার সঙ্গে ১৩ ী ১২ বর্গফুট খোলা জায়গা তারের নেট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। যাতে অবসর সময়ে কবুতর ঘোরাফেরা ও উড়তে পারে। কবুতরের রোগবালাই হতে রক্ষা করার জন্য ঘরগুলো উত্তর দক্ষিণমুখী হওয়া ভালো। 
কিভাবে কবুতরের খাদ্য ব্যবস্থাপনা করা দরকার?
কবুতরের বাচ্চার খাদ্য : ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার কমপক্ষে ৪-৫ দিন পর কবুতরের বাচ্চার চোখ ফোটে। এ জন্য এ সময়ে বাচ্চাগুলো কোনো দানাদার খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। বাচ্চাগুলো যখন বড় হতে থাকে তখন স্ত্রী এবং পুরুষ কবুতর উভয়েই দানাদার খাদ্যের সংগ্রহ করে ঠোঁট দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাচ্চা বড় হয়ে নিজের খাদ্য গ্রহণ না করা পর্যন্ত এভাবে খাবার খাওয়াতে থাকে। 
প্রাপ্ত বয়স্ক কবুতরের খাদ্য : কবুতরের জন্য তৈরিকৃত খাদ্যে শর্করা, আমিষ, খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন, চর্বি এবং খনিজ লবণ সম্পন্ন সুষম খাদ্য হতে হবে। কবুতর দানাদার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে। ছোট আকারের কবুতরের জন্য ২০-৩০ গ্রাম, মাঝারি আকারের জন্য ৩৫-৪০ গ্রাম এবং বড় আকারের কবুতরের জন্য ৫০-৬০ গ্রাম খাদ্য প্রতিদিন দিতে হয়। দানাদার জাতীয় খাদ্যের মধ্যে গম, ধান, ভুট্টা শতকরা ৬০ ভাগ, লেগুমিনাস বা ডালজাতীয় খাদ্যের মধ্যে সরিষা, খেসারি, মাষকলাই শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ সরবরাহ করতে হয়। কবুতরের ভিটামিন সরবরাহের জন্য বাজারে প্রাপ্ত ভিটামিন ছাড়া সবুজ শাকসবজি, কচি ঘাস সরবরাহ করা প্রয়োজন। প্রতিদিন ২ বার খাদ্য সরবরাহ করা ভালো। তাছাড়া কবুতরকে দিনে ৩ বার পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি সরবারহ করা উচিত। কবুতর যেহেতু ঠোঁট প্রবেশ করিয়ে ঢোক গেলার মাধ্যমে পানি পান করে সেহেতু পানির পাত্র গভীর বা খাদ বিশিষ্ট হওয়া উচিত। 
কবুতরের কী কী রোগব্যাধি হতে পারে এবং তা প্রতিকারের উপায় কী?
আমাদের দেশের কবুতরের যে সকল রোগ দেখা যায় তা হলো-কবুতরের রাণিক্ষেত, পক্স, নিউমেনিয়া, ডায়রিয়া, ক্ল্যামাইডিয়া/সিটাকোসিস, অরনিথোসিস, ক্যাংকার/ক্রপ ক্যাংকার ট্রাইকোমোনিয়াসিস, রোপ, টিবি, ম্যালেরিয়া, সালমোনেলা/প্যারাটাইফয়েড, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এডিনো ভাইরাস টাইপ-১, পিজিয়ন হারপোস ভাইরাস ইত্যাদি। তা ছাড়া কবুতর কিছু মারাত্মক অন্তঃপরজীবী ও বহিঃপরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই সময়মতো রোগের টিকা দিতে হবে এবং ক্রিমিনাশক খাওয়াতে হবে। তবে অসুস্থ হলে বিশেষজ্ঞের  পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে । 
স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা করার সময় কী কী বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে?
খামার হতে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা খামারের জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বেশির ভাগ রোগই খামার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খামার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় অন্য দিকে তেমনি মানসম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদন হবে এবং অধিক লাভবান হওয়া যাবে। স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনার জন্যে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা দরকার তা হলো-
সঠিকভাবে ঘর তৈরি করতে হবে যেন পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ এবং বায়ু চলাচল করতে পারে। প্রতি জোড়া কবুতরের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। কবুতর উঠানোর আগে খামারসহ ব্যবহার্য সকল যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। সুস্থ সবল কবুতর সংগ্রহ করতে হবে। নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করাতে হবে। জীবাণুমুক্ত খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। খাবার যাতে কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত আর্দ্রতাযুক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কবুতরের ঘর, দানাদার খাদ্য ও খনিজ মিশ্রণ সরবরাহের পাত্র, পানির পাত্র ও গোসলের পাত্র এবং কবুতর বসার স্ট্যান্ড নিয়মিত পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। খামারে মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতিবার খামারে প্রবেশ করার পূর্বে এবং খামার থেকে বের হওয়ার সময় হাত ও পা অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করতে হবে। খামারে যাতে বন্যপ্রাণি ও ইঁদুরজাতীয় প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খাঁচা পদ্ধতিতে কবুতর পালনে প্রতিদিন মলমূত্রের ট্রে পরিষ্কার করে খামারের ভেতরের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে। কবুতর অসুস্থ হলে দ্রুত আলাদা করে রাখতে হবে। অসুস্থ বা মৃত কবুতর অভিজ্ঞ প্রাণী চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে কারণ জেনে অন্যান্য জীবিত কবুতরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খামারে সমস্যা দেখা দিলে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সমাধান করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, কবুতর পালন বাংলাদেশের জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কবুতর পালন করা হলে কবুতর পালন লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে যা দেশের দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক : উপপরিচালক, পরিকল্পনা শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯৪৬৯৫২০১১, ইমেইল: hmsalim72@yahoo.com