Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট

ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট বলতে দুধকে বিশেষ ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার গাঁজানো প্রক্রিয়া দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীকে বুঝায়। ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট সাধারণত দুধ বা দুধের উপজাত দ্রব্য থেকে তৈরি করা হয়।
বিশ্বের মানবজাতির জন্য ১০টি মারাত্মক চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে ক্ষুধা এবং অপুষ্টি সপ্তম স্থানে রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের চাহিদা আমাদের অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের প্রজন্ম দুর্বল ও মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। দেশের এ বিশাল পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দেশেই উৎপাদিত দুধ, দই ও অন্যান্য ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
 
যত দূর জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০ বছর আগে থেকেই মানুষ গাভীর দুধ খেতে শুরু করে এবং দুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এজন্য গাভীকে মানবজাতির পালক মাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পাঁচ শতাব্দী আগে হিপোক্রিটস দুধকে ওষুধের পিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভারত বর্ষে আগে থেকে প্রচলন ছিল বা আছে, বিয়ের পর মেয়ে জামাইকে গাভী উপহার দেয়ার। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি হলো- মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনির মেধা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা।
 
দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্যের উপকারিতা
১. দুধে ল্যাকটোজ মানব ব্রেনের খাদ্য, যা মেধাকে সমৃদ্ধ করে; ২. দুধে থাকা ক্যালসিয়াম মানুষের হাড় বা অস্থি গঠনে সহায়তা করে; ৩. দুধের প্রোটিন, ক্যাসিইন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ও ঘুম বা প্রশান্তি আনতে সহায়তা করে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রাতে ঘুমানোর আগে ২৫০ মিলি. দুধ পান করা উচিত। প্রতিদিন ২৫০ মিলি. দুধ পান না করলে ৫০ বছর বয়সের পর মেরুদ- বাঁকা হয়ে যায়; ৪. দুধে থাকা চর্বি- ক. ক্যান্সার প্রতিরোধী; খ. রক্তনালির ভঙ্গুরতা বা শক্ত হয়ে যাওয়া থেকে প্রতিরোধ করে; গ. ডায়াবেটিক প্রতিরোধী; ঘ. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; ঙ. শরীরের সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে; চ. শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করে।  
 
দুধের চর্বি ও প্রোটিন হৃদরোগের কারণ নয় বরং হৃদরোগ হতে বাধা দেয়।
বাংলাদেশে যেসব ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট পাওয়া যায় তা হলো-
১. দই
২. লাচ্চি
৩. মাঠা
৪. বোরহানি
৫. এসিডোফিলাস মিল্ক
৬. ফার্মেন্টেড হে ড্রিংক (ঘোল)   
৭. পনির
১. দই : ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্টের মধ্যে দই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও প্রিয় খাদ্য। দই তৈরির সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দই একটি প্রিয় ও উপকারী খাদ্য হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের শতায়ু, দীর্ঘজীবী ব্যক্তিদের খাদ্য তালিকায় দই বা দধির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। উজবেকিস্তান ও চেকোশ্লোভিয়ার মানুষের গড়  আয়ু ১৩৫ বছর। এর  পেছনে কারণ হলো এসব দেশের মানুষ প্রতিদিন দই খায়।
 
 দই দুধের Lactic fermentation-এর ফলে তৈরি হয়। সব শ্রেণীর মানুষ দই পছন্দ করে। কেউ দই প্রতিদিন খেয়ে থাকেন। পুষ্টিমান বিবেচনায়  দই একটি সম্পূর্ণ খাদ্য। যেসব মানুষ দুধ হজম করতে পারে না তারা সহজেই দই হজম করতে পারেন। দই তৈরিতে ব্যবহৃত উপকারী ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক উৎপাদিত উপজাত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ কিছু উপকার করে। যেমন-উচ্চরক্তচাপ কমায়। রক্তের কোলস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং দেহ কোষের মিউটেশন প্রতিরোধ করে। দই খেলে মনে প্রশান্তি আসে, মেজাজ ফুরফুরে হয়। এজন্য প্রতিদিন রাতে দই খাওয়া দরকার। যে কোনো বিশেষ ভোজে দধি পরিবেশন না করলে সে ভোজের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যায়। 
 
দই তৈরি পদ্ধতি : দই সাধারণত দুই প্রকার-টক দই ও মিষ্টি দই পাকপ্রণালিতে বা সালাদে ব্যবহার করা হয়। খুব টক না হলে খাদ্যের সঙ্গে খাওয়া যায়। পক্ষান্তরে মিষ্টি দই সরাসরি খাওয়া যায়।
 
১ কেজি দই প্রস্তুত উপকরণ  
১. দুধ ১ কেজি 
২. চিনি ১২০ গ্রাম
৩. বীজ দই (আগের দিনের বানানো দই) - ২ চা চামচ                                                     
৪. মাটির হাঁড়ি/কাপ ১টি
 দই তৈরিতে যেসব ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়-
 
Streptococcus lactis
Streptococcus thermophilus
Streptococcus cremoris
Lactobacillus bulgaricus
Lactobacillus plantarum.
 
পদ্ধতি- ক. একটি সিলভারের পাতিলে দুধ ও চিনি নিয়ে চুলায় জ্বাল দিতে হবে এবং অনবরত নাড়তে হবে যাতে নিচে লেগে না যায়।
খ. দুধ ঘন হয়ে ৭০০-৮০০ গ্রাম হলে চুলা থেকে নামাতে হবে।
গ. দুধ কুসুম গরম থাকা অবস্থায় এর সঙ্গে চা চামচের ২ চামচ বীজ দই যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ঘ. দুধ গরম থাকা অবস্থাতেই একটি পরিষ্কার মাটির পাতিলে-প্লাস্টিকের কাপে দুধ ঢেলে ওই পাত্রটির মুখ ঢেকে দিতে হবে।
ঙ. কাপগুলোকে পুরনো লেপ, কাথা বা ছালা দিয়ে জড়িয়ে কোনো গরম জায়গায় রেখে দিতে হবে। যাতে দুধের তাপ বের হয়ে না যায়।
চ. শীতকালে দই তৈরি হতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগে, গরমকালে ৬-৭ ঘণ্টা এ অবস্থায় রেখে দিলেই দুধ জমে দই তৈরি হবে।
 
দইয়ের পুষ্টিমান
১. দইয়ের মধ্যে দুধের সব পুষ্টিগত গুণাগুণ বিরাজমান।
২. যারা দুধ হজম করতে পারেন না তারাও সহজেই দই খেয়ে হজম করতে সক্ষম।
৩. দই পেট ঠাণ্ডা রাখে।
৪. নিয়মিত দই সেবনে কর্মজীবনী বৃদ্ধি করে।

দই সংরক্ষণ পদ্ধতি : যদি গরম জায়গায় রাখা হয়, তবে দই জমার পরে খুব দ্রুত টক হয়ে যায়। তাই দুধ জমার সাথে সাথেই ঠাণ্ডা  জায়গায় দইয়ের পাতিল রেখে দিতে হবে। ফ্রিজে ৪-৫ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত দই ভালো থাকে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমকালে এক দিন ও শীতকালে প্রায় দুই দিন পর্যন্ত দই খাওয়ার উপযোগী থাকে।
 
২. লাচ্চি : লাচ্চি সতেজক হিসেবে খুবই উপকারী পানীয়। এটি দই, চিনির সিরাপ ও গোলাপের নির্যাস দিয়ে  তৈরি করা হয়। গরমকালে বরফ সহকারে পরিবেশন করা হয়। লাচ্চি পলিপ্যাকে সরবরাহ করা যেতে পারে। ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লাচ্চি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
 
৩. মাঠা : মাঠা  সাধারণত বাটারযুক্ত দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়। মাঠার স্বাদ টক। এতে অল্প লবণ (০.৫%) মিশানো হয়, ফলে সুস্বাদু হয়ে থাকে।
মাঠা স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। প্রতিদিন এক গ্লাস মাঠা খাওয়া প্রয়োজন।

৪. বোরহানি : বোরহানি টক দই, পানি, লবণ, বিভিন্ন মসলা ও কিছু গাছ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। বোরহানি খুবই সুস্বাদু ও উপকারী। বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। বোরহানি ঢাকা জেলার খুবই প্রচলিত পানীয়। বোরহানি তৈরির সময় অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।
 
৫. এসিডোফিলাস দুধ : এসিডোফিলাস দুধ একটি নতুন ফারমেন্টেড ফুড। স্বর ছাড়া (Skim milk)) দুধ Acidophilus দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে Strawberry এবং চকোলেট সুগন্ধি (Flavor) ব্যবহার করা হয়।
 
৬. ফারমেন্টেড হে পানীয় : ফারমেন্টেড হে পানীয়- চানা যিবু-এর সঙ্গে ৮% চিনি ও ০.৫% mixed culture মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এ পানীয় বোতলজাত করার সময় ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পাঁচ মিনিট গরম করতে হয়। পানীয়টির স্বাদ বৃদ্ধি করতে কৃত্রিম সুগন্ধি (Flavor)  ব্যবহার করা হয়।
 
৭. চিজ-পনির : বাংলাদেশে ‘ঢাকা চিজ’ একটি বিখ্যাত চিজ, যা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। এ পনির তৈরির সময় বাছুরের (Calves) Abomasum (Fourth stomach) শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়ভাবে একে মোয়া বলে। এ পনির তৈরির সময় তুলনামূলকভাবে শক্ত প্রকৃতির হয় কিন্তু ২-৩ সপ্তাহ পরে কক্ষ তাপমাত্রায় রেখে দিলে পেকে যায়। পনির স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই ফারমেন্টেড ডেইরি ফুডের চাহিদা বেড়েই চলছে। এর প্রধান কারণ ক. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি খ. মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি গ. জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানীং এসব ফারমেন্টেড ডেইরি ফুডস ওষুধ হিসেবে মূল্যায়িত বা বিবেচিত হচ্ছে। তাই ফারমেন্টেড ডেইরি ফুডস শিল্পের একটি বিশাল বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশে।
 
লেখক:
কৃষিবিদ ডা. মনোজি কুমার সরকার*
* ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, কাউনিয়া, রংপুর