Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কেন ফুলের চাষ করেন খন্দকার পারভীন সুলতানা

ফুলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই ফুলের চাষ করে যাচ্ছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কান্দিরা গ্রামের গৃহবধূ খন্দকার পারভীন সুলতানা। ফুলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা না থাকলে কেউ ফুল চাষ করতে এগিয়ে আসেনা এটাই সত্য। গৃহবধূ খন্দকার পারভীন সুলতানা শুধু গৃহবধূই নন তিনি একজন শিক্ষিকা ও একজন পরিশ্রমী আদর্শ নারী। ফুলের প্রতি ভালোবাসায় বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে স্বামীর স্মৃতি। তার স্বামী শুরু করেছিলেন গোলাপসহ বিভিন্ন ফুলের চাষ। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন পারভীন সুলতানা। পারভীন সুলতানার স্বামী খন্দকার মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুই পারভীন সুলতানার দায়িত্ব এসে যায় সংসারের ও মরহুম মাহবুবুর রহমানের ফুলচাষ কার্যক্রম। মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুকালে ২ ছেলে এক মেয়ের দায়িত্ব রেখে যায় পারভীন সুলতানের ওপর। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারাযান মাহবুবুর রহমান খান। শিশু কন্যাও পুত্রের দায়িত্ব, গোলাপ বাগানের দায়িত্ব, গোলাপ সমিতির র্কাযক্রম পরিচালনা এসব নিয়ে গৃহবধূ পারভীর সুলতানা হয়ে পরেন দিশেহারা। কান্দিলা গ্রামের খন্দকার বাড়ীর গৃহবধূ পারভীন সুলতানা স্কুলের শিক্ষিকাও বটে। স্বামী হারা পারভীন সুলতানা তিন সন্তানের জননী। নিজেকে দাঁড়াতে হবে, সংসার পরীক্ষায় পাস করে সমাজের অন্যদের মতো বেঁচে থাকতে হবে। মনের একনিষ্ঠ দৃঢ়তাকে পুঁজিকরে সংসারের হাল ধরেন পারভীন সুলতানা। ছেলেমেযের লেখাপড়া ভরণপোষণ ও সংসার পরিচালনায় উপার্জনশীল ব্যক্তি একাই পারভীন সুলতানা। কোনো দায়িত্বই ছোট করে দেখার  অবকাশ নাই তার। তাই স্বামীর চলমান ফুল বাগান পরিচর্যা ও যত্নের মাধ্যমে ফুলে ফুলে খুঁজে পান স্বামীর সাহচর্য। প্রতিদিন নানা ফুল ফোটে মাহবুবুর রহমানের ফুলের বাগানে। সকাল-সন্ধা-ফুল বাগানে ঘুরে ঘুরে স্বামীর স্মৃতি, সুখ আনন্দ, বেদনাকে পুঁজি করে মনের দিক থেকে সুদৃঢ়ভাবে ফুল ও বাগানকে বেছে নেন স্বামীর অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেও অবসর সময় সংসার ও সন্তানদের দেখাশোনা আর ফুলবাগান ও ফুলচাষ নিয়ে শুরু করেন জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার নতুন কর্মজীবন। স্বামী মাহবুবুর রহমানকে ফুলচাষ,গোলাপ বাগানও গোলাপ প্রদর্শনী, পুষ্প মেলা উদযাপনে সব সময় সহযোগিতা করতেন  পারভীন সুলতানা। উৎসাহ দিতেন স্বামীকে ফুলচর্চায়। পারভীন সুলতানা ও স্বামী মাহবুবুর রহমান কয়েকবারই টাঙ্গাইলসহ ঢাকা পর্যন্ত পুষ্প মেলায় অংশগ্রহণ করতেন একত্রে একে অপরের সহযোগী হিসেবে। স্বামী মাহবুবুর রহমান ছিলেন একজন পুষ্পপ্রেমিক উদ্যোগী মানুষ। দীর্ঘদিন গোলাপফুল নিয়ে নিজ নার্সারিতে গোলাপচাষ করতেন। অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রচুর। মাহবুবুর রহমান এক সময় পরিচিত ছিলেন ফুল মাহবুব হিসেবে। তার নিজ বাগান কান্দিলাতে ছিল প্রায় শতাধিক জাতের গোলাপফুল। তিনি নিজে বাগানে কাজ করতেন কলম করতেন, চারা উৎপাদন করতেন এবং ফুলচাষ সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে প্রচেষ্টা চালাতেন। টাঙ্গাইল জেলায় কয়েকবার করেছেন গোলাপ প্রদর্শনী ও পুষ্প প্রদর্শনী। মাহবুবুর রহমান জীবিতকালে টাঙ্গাইলে গড়েছিলেন গোলাপ সমিতি। ফুলচাষ ও নার্সারিকে কেন্দ্র করেই তার সাথে গড়ে উঠে আমার সখ্যতা। আমি ১৯৮৭ হতে ১৯৯২ পর্যন্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলে উদ্যান বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। মাহবুবুরের নার্সারিকে কেন্দ্রকরেই তার বাড়ি যাওয়া, পরিবারের সাথে পরিচিতি, আমাদের বাসায় যাতায়াত  এ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে থেকেছে মাহবুবুর রহমান। আমিও মহিবুবের বাসায় থেকেছি অনেক সময়। সেই সূত্রেই পারভীন সুলতানা ভাবীর সাথে আমার পরিচিয়। সুদীর্ঘদিন বিভিন্ন স্থানে চাকুরির সুবাদে ভাবীর সাথে আর সাক্ষাৎ হয়নি আমার। মাঝে মধ্যে কথা হয় ফোনে। কৃষি বিপ্লব ১-১৫ বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যায় পারভীন সুলতানার ছবিসহ কে এস রহমান শফি টাঙ্গাইল কর্তৃক লিখিত জারবেরা ফুলের চাষ করেন খন্দকার পারভীন। এই প্রতিবেদনটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। পারভীন ভাবীর ছবিটি দেখে ও প্রতিবেদনটি পড়ে আমি মুগ্ধ হই। তাই আমি টাঙ্গাইলে গিয়ে ভাবী পারভীন সুলতানার সাথে সাক্ষাত করি এবং বর্তমান ফুল চাষ পর্যবেক্ষণ করি। কেন ফুল নিয়ে পারভীন সুলতানা আজও নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। কারণ-
 
ফুল পবিত্র। ফুল শুভ্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। তাই ফুলের প্রতি আকর্ষণ মানুষের চিরন্তন। জর্জ বার্নাডশ বলেছেন, ‘ঈশ্বর খোঁজার সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে বাগানের মধ্যে তাকে খোঁজা। তুমি সেখানে তার জন্য মাটি খুঁড়ে তাকে খুঁজতে পারো’। ফুল যুগে যুগে পৃথিবীতে মানুষের নিত্য সঙ্গী। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটে সৌরভ ছড়ায়। আবার ঝরে পড়ে। সুরভি ছড়ানোই যেন ফুলের সার্থকতা। সুরভি ছড়াতে ছড়াতে ঝড়ে পড়া এ যেন ফুলের মহান আদর্শ। আর ফুলের সুঘ্রাণের প্রতি মানুষের রয়েছে এক তীব্র আকর্ষণ। পুষ্পপ্রীতি আমাদের সংস্কৃতিরই অঙ্গ। ফুলের জলশায় মনের উন্নতি ও সংষ্কৃতি রোধের বিস্তার ঘটালে সমাজ থেকে অবক্ষয় ও হতাশা দূর হবে। ফুল হচ্ছে পৃথিবীর হাসি। এ হাসির উৎকর্ষ নিবারণের জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত। পৃথিবীর বহুদেশে গোলাপসহ বিভিন্ন ফুলের গবেষণা ও প্রসার হয়েছে। বিচিত্র রঙের মনোলোতা ফুল ও হৃদয়গ্রাহী সুঘ্রাণ পুষ্পপ্রেমিকদের মনের চাহিদা মেটায় যুগে যুগে। ফুল আজ শিল্পে পরিণত হচ্ছে। অর্থকরী ফসল হিসেবেও ফুলের চাষ ও ফুল নিয়ে ভাবনার দিন এসেছে।
 
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেন, ‘যেখানে ফুল বিলপ্তি হতে থাকে, সেখানে মানুষ বাস করতে পারে না।” আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় ফুল চাষের উপযোগী। কিন্তু পরিশ্রম করে বাগান করার অভ্যাস আজও সীমিতপর্যায়ে রয়েছে। রয়েছে মানুষের মনের সঙ্কির্ণতা। আজও অনেকের হৃদয়ে ফুল স্ফুটিত হয় নি। ফুল ফুটেনি মনের বাগানে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাগজের মালা ব্যবহার ও ড্রইং রুমে ফুলদানীতে কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজানোর ঘটনা প্রায়ই চোখে পড়ে অনেকের বাড়িতে। বিদেশ থেকে কৃত্রিম ফুল এসেছে ও আসছে, যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কৃত্রিম ফুল সুভাস ছড়াতে পারে না, এ ফুল মন ভরাতে পারে না। এ যেন নিজের মনের সাথেই প্রতারণা করা হচ্ছে।
 
গোলাপসহ বিভিন্ন ফুল অতীতের বহু সভ্যতার সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে। ফুলকে জীবনের নামান্তরে নানা রূপে রহস্যের প্রতীকরূপে কবি ও সাহিত্যিকগণ ব্যবহার করে এসেছেন। বিভিন্ন দেশের লোকজ সংস্কৃতিতেও শুভ, অশুভ ফুলের নিদর্শন পাওয়া যায়। পদ্ম, গোলাপ, ডালিয়া, ভায়োলেটস, পপি প্রভৃতি ফুলকে কেন্দ্র করে নানা কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়েছে। ওয়াটার লিলি বা শালুক ও পদ্ম প্রাচীন রোম শহরের রাজশক্তির প্রতীক রুপে রূপায়িত। ভারতে জবা, আকন্দ ও অপরাজিতা যথাক্রমে কালী, শিব ও দূর্গার প্রতীক। হিন্দু, বৌদ্ধদের কাছে পদ্মফুল পরম পবিত্র।
 
গাঁদা বা মেরিগোল্ড ক্যাকটাস ফুল প্রেম ও আনুগত্যের প্রতীক। অপর দিকে ভারতীয়দের কাছে কমলা ও মেহেদী ফুল মিলন এবং বিবাহ পরবর্তী সুখী ও দাম্পত্য জীবনের প্রতীক। জাপানিদের কাছে চন্দ্রমল্লিকা সমৃদ্ধির প্রতীক। প্রাচ্যে অতসী ফুল পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। গ্রিকদের কাছে মোরগ ফুল অমরতার স্মারক। চীন ও গ্রিসদেশে হায়াসিন্থ বিষণ্নতার এবং সাইপ্রেসফুল মৃত্যু ও শোকের প্রতীক। বাসন্তিফুল দেশে বিদেশে নবীন যৌবনের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। ক্যামেলিয়া অসুস্থতার প্রতীক রূপে নিন্দিত। ড্যাফোডিলস ব্যর্থ প্রেমিকদের প্রতীক বলে মানুষের বিশ্বাস। ডেইজীফুল গ্র্রাম্য সরলতার প্রতীক টিউলিপফুল হল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক। এই ফুল সাহসের প্রতীক। সূর্যমুখী ভক্তি ও নিষ্ঠার প্রতীক। রজনীগন্ধা বাংলাদেশে অভ্যর্থনার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত।
 
ফরগেটমিনট ফুলটি একটি প্রেমের প্রতীক। প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগ থেকে সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে ফুল একটি গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। খ্রিষ্টের জন্মের আড়াইহাজার বছর আগে সিন্দু সভ্যতার পরিচয়বাহী মৃৎপাত্রে ফুটন্ত ফুলের নক্সা রয়েছে। সম্ম্রাট নিরোর আমলে রাজপ্রাসাদের চারপাশে নিবিড়ভাবে গোলাপের চাষ হতো। মিসরের মক্ষীরাণী ক্লিউপেট্টা গোলাপের খুবই ভক্ত ছিলেন। মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান গোলাপ পাপড়ী থেকে আতর তৈরির সূত্র সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন। গ্রিক কবি স্যাফো তার কবিতায় গোলাপকে প্রথম “ফুলের রাণী” বলে বর্ণনা করেন। গোলাপ এমন একটি ফুল যা অতীতের সভ্যতার সঙ্গে নিজকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। হিন্দু পুরানে ব্রহ্মা পদ্ম ফুলকে শ্রেষ্ঠ ফুল হিসেবে জানতেন কিন্তু বিষ্ণুর আমন্ত্রণে বৈকণ্ঠে এসে হালকা রঙের সুগন্ধি গোলাপকে সৃষ্টির সেরা ফুল হিসেবে স্বীকার করেছেন।
 
তাহলে দেখা যায় প্রাগ-ঐতিহাসিককাল থেকেই ফুলের সামাজিক আধ্যাতিক এমনকি অর্থনৈতিক পরিব্যপ্তির কারণে ফুল সবার কাছে সমাদৃত।
 
আজও আমরা আমাদের আঙ্গিনায় ও বাগানে ফুলের চাষ করে মনকে তৃপ্ত করে তুলতে পারি। ফুলের সুবাসে ভরিয়ে দিতে পারি আমাদের পরিবেশকে। এ জন্য শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের। টমাস উইলসন বলেছেন, “ফুলের আয় কত স্বল্প কিন্তু সেই স্বল্প আয়ই জীবন পরিধি কত মহিমাময়।”
প্রমথ চৌধুরী তার কবিতায় বলে ছিলেন- ‘মোর পাশে ফুটো তুমি হে- রজনীগন্ধা।
তাই আসুন নানা বর্ণের ফুল ফুটাতে কুসুম বাগে বাগে
 
বনের ফুলকে মনের মাঝে ফুটাই সবার আগে’
বর্তমানে খন্দকার পারভীন সুলতানা জারবেরা ফুল চাষ করে টাঙ্গাইলে আজ সমাদৃত। তিনি আমাকে জানান ফুল চাষ লাভজনক ব্যবসায় হলেও টাঙ্গাইলে ভালো বিক্রয় হয় না। উৎপাদিত ফুল প্রতিদিন ঢাকা পাঠাতে হয়। ফুল পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও বাগান পরিচর্যাসহ উৎপাদন খরচ দ্রুত বাড়ছে। তবুও এ ফুল চাষে তিনি আনন্দ পান মরহুম স্বামী মাহবুবুর রহমানকে স্মৃতিতে স্মরণ রাখতে। তিনি জারবেরাসহ গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা ও অন্যান্য ফুল চাষ করে আনন্দে সংসার পরিচালনা করছেন। তিনি বড় মেয়েকে সুপাত্রে বিবাহ দিয়েছেন। বড় ছেলে উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকুরিরত রয়েছে। ছোট ছেলেকে সুশিক্ষিত করাই তার বর্তমান দায়িত্ব। তাই তার বাড়ির পাশেই বিভিন্ন বাগানে নানা ফুলের চাষ সমৃদ্ধ করে নিজেকে পরিচালনা করতে চান মরহুম স্বামী খন্দকার মাহবুবুর রহমান সাহেবকে স্মৃতির অনুভূতিতে জীবিত রাখতে।

 
 
দুলাল চন্দ্র সরকার*
* কৃষি পরামর্শক (সজাগ) ও প্রাক্তন পরিচালক (ডিএই), খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৫৮১৪৩০৯