বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিও কৃষি। বর্তমান সরকার কৃষক ও কৃষিবান্ধব সরকার। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জমি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের জন্য এবং পাশাপাশি কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছেন বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এরই ফলে দানাজাতীয় শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি খাদ্যশস্য রপ্তানিও করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভৌগলিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেশি। তবে এত প্রতিকূলতার মাঝেও কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় প্রতি বছর কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর মাঠ থেকে শুরু করে ফসল কর্তনের পরেও গুদামজাত অবস্থায় বা গোলায় তোলার পরও ক্ষতি করে। সুতরাং ইঁদুর আমাদের ফসলের এমন একটি অনিষ্টকারী বালাই যা সর্বাবস্থায় আমাদের ক্ষতি করতে সক্ষম। ইঁদুর শুধু যে ফসলের ক্ষতি করে তা নয় মানুষেরও ব্যাপক ক্ষতি করে এবং রোগজীবাণুর বাহক হিসাবে কাজ করে। তাই কৃষকদের ফসলের মাঠে সময়মতো ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতি বছরই ইঁদুর নিধন কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে।
কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার খায় তার চেয়ে বেশি কেটেকুটে নষ্ট করে। ক্রমবর্ধমান হলেও বর্ধনশীল জনসংখ্যার খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে মাঠে একাধিক ফসলের চাষ হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে ১০-১২ লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে থাকে। একটা ইঁদুর প্রতিদিন তার দেহের ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য গ্রহণ করে এবং সমপরিমাণ কেটেকুটে নষ্ট করে। ইঁদুর ছোট প্রাণী হলেও এর ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক বেশি। ইঁদুর শুধু ফসলের ক্ষতিই করে না এটা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর মলমূত্র ও লোম আমাদের খাদ্য দ্রব্যের মিশে টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগ, কৃমিসহ ৩৩ প্রকারের রোগ ছড়ায়। মারাত্মক প্লেগ রোগের বাহকও এই ইঁদুর। ইঁদুর মাঠের ও ঘরের ফসল নষ্ট করা ছাড়াও বৈদ্যুতিক তার কেটে আগুনের সূত্রপাত ঘটায়, টেলিফোনের তার কেটে টেলিফোন অচল করে দেয়, কম্পিউটারসহ ঘরের কাপড়চোপর, কাগজপত্র কেটে নষ্ট করে। এছাড়া রাস্তা, বাঁধ ও রেললাইনে গর্ত করার ফলে বৃষ্টি বা বন্যার সময় পানি ঢুকে রাস্তা, বাঁধ ও রেললাইন ভেঙে যায়।
ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তারকারী প্রাণী। একজোড়া ইঁদুর এক বছরে ৩০০০টি বংশধরের সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ইঁদুর নিধন করা অত্যাবশ্যক। এক জরিপ অনুযায়ী ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমের শতকরা ৪-১২ ভাগ, গোল আলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ, আনারসেশতকরা ৬-৯ ভাগ এবং সেচ নালার পানি ৭-১০ ভাগ ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। বাংলাদেশে ইঁদুর নিধনঅভিযান ১৯৮৩ সন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি অভিযানের কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞ দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে এবং ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী অভিযানের কার্যক্রম কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। ইঁদুর নিধন অভিযানের ফলে প্রতি বছর ইঁদুরের আক্রমণের হাত থেকে ফসল রক্ষার পরিমাণ বেড়েছে। ইঁদুর নিধনের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। কেননা শুষ্ক মৌসুমে ইঁদুর মাটির গর্তে বা উপয্ক্তু পরিবেশে দ্রুত বিচরণ করতে পারে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে খোলা পানিতে আবদ্ধ থাকে বিধায় দ্রুত বিচরণ করতে পারে না। তাই বর্ষায় ইঁদুর নিধন সহজ হয়। এক সময় প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুর নিধন হতো। কেননা সাপ, পেঁচা, ঈগল, চিল, বিড়াল, কুকুর ইঁদুর নিধনকারী প্রাণী। এসব পরভোজী প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় উপযুক্ত পরিবেশে ইঁদুর দ্রুততার সাথে বংশবিস্তার করে চলছে। ইঁদুর নিধন কার্যক্রমকে জোরদার করার ফলে ইঁদুরের আক্রমণের হাত থেকে ফসলের একটা বড় অংশ রক্ষা পাবে বলে আশা করা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত ছয় বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে কি পরিমাণ আমন/বোরো ফসল রক্ষা পেয়েছে তার হিসেব এখানে দেয়া হলো। (উপরের ছক দেখুন)
বছর |
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক, ছাত্রছাত্রী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/ কর্মচারীর সংখ্যা |
নিধনকৃত ইঁদুরের সংখ্যা |
ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষাকৃত ফসলের পরিমাণ (মে. টন) |
২০০৯ |
৪৯৪৫১৭৫ |
৮৭৮৬৫০২ |
৭১৩৬৪ |
২০১০ |
৬০৭৩৭৪৩ |
১০৭৩৯৩৫৭ |
৮০৫৪৫ |
২০১১ |
৬০৮৪৯৫৪ |
১১৩৭২৫৫৭ |
৮৫২৯৮ |
২০১২ |
৫৫০৩৪৬১ |
১৩৬২২০৯৫ |
১০২১৬৯ |
২০১৩ |
৮৩,৮৭,৮৭২ |
১,৩৯,৩৯,৯৮৬ |
১,০৪,৫৪৯.৮৯৫ |
২০১৪ |
৬৪,৩৯,৫৮৯ |
১,২৮,৯২,৯৩৩ |
৯৬,৬৯৬.৯৯ |
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৫-এর উদ্দেশ্য
* কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহসহ সর্বস্তারের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা।
* ইঁদুর দমনের লাগসই প্রযুক্তি কৃষিকর্মীরা মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
* ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস-মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
* আমনফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কম রাখা।
* গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধকরা।
* রাস্তাঘাট ও বাধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগনকে উদ্বুদ্ধ করা।
* ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।
ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান : ইঁদুর নিধনের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। যারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। বিগত অভিযান বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রাথমিকভাবে অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক যাচাই করার পর জাতীয় পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে যাচাই করে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
উপসংহার : ইঁদুর দমনপদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক স্থানে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না। একা ইঁদুর মারলে দমনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে থাকে। এজন্য পাড়া প্রতিবেশীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একই দিনে ও একই সময়ে ইঁদুর নিধন করা প্রয়োজন (মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও গনচীনে নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট সময়ে এভাবে ইঁদুর নিধন করা হয়)। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিকসংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাতার ব্লকের ৬০০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। এ বছর ১৫,০০০ কর্মসূচি পুস্তিকা ও ১০০০০ পোস্টার মুদ্রণ করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি পুস্তিকায় ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজিত করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ইঁদুরনাশক (ল্যানিরাট, ব্রমাপয়েন্ট ও ২% গম মিশ্রিত জিংক ফসফাইড) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ইঁদুর সমস্যা দীর্ঘদিনের এ সমস্যা পূর্বে যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং অংশীদারিত্ব। একা ইঁদুর নিধন করার সাথে সাথে অন্যদের ইঁদুর নিধনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। একা ইঁদুর নিধন করলে সাময়িকভাবে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে, তবে অল্পকিছু দিনপরই আবার অন্য স্থানের ইঁদুর এসে সমস্যার সৃষ্টি করবে। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগির খামার, অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতানির্ভর করে সর্বস্থরের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর।
মো. আবুল কালাম আজাদ*
* পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা