Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পরিবর্তিত জলবায়ুতে ইক্ষু চাষভিত্তিক কার্যক্রম

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা, লবণাক্ততা, অধিক তাপ, অধিক ঠাণ্ডা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির  কারণে ফসলের  ক্ষতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইক্ষু একটি  অর্থকরী খাদ্য ও শিল্পজাত ফসল, যার চাষ দিনকে দিন নিচু চরাঞ্চল, পাহাড় এবং প্রান্তিক প্রতিকূল পরিবেশপ্রবণ খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ত এলাকায় চলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) ইক্ষু চাষভিত্তিক নানাবিদ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।  
বিএসআরআই মূলত দেশের পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষ উপযোগী উচ্চফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ইক্ষু জাত উদ্ভাবন, তার চাষাবাদ প্রযুক্তি, রোগবালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি, সেচ ও পানি নিষ্কাশন, ইক্ষু ফসলকে আরও লাভজনক করার জন্য ইক্ষুভিত্তিক ফসল বিন্যাস, ইক্ষুর সাথে একাধিক সাথীফসল চাষ, মুড়ি ইক্ষু চাষ, ইক্ষু চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন, উদ্ভাবিত প্রযুক্ত সম্প্রসারণ প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অদ্যাবধি বিএসআরআই ৪৫টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় চাষাবাদ উপযোগী। এছাড়া অন্যান্য প্রযুক্তির সাথে আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে ৩০টিরও বেশি প্রযুক্তি প্যাকেজ সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ইক্ষু চাষের প্রতিকূল পরিবেশ হলো  নিম্ন তাপমাত্রা বা অধিক ঠাণ্ডা, খরা,  জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ততা। ইক্ষুর জীবনচক্রে নিম্ন তাপমাত্রা  অংকুরোদগম ও প্রাথমিক কুশি পর্যায়ে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে; খরা অংকুরোদগম ও প্রাথমিক কুশি পর্যায়ে নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে; জলাবদ্ধতা  নাবি কুশি পর্যায়, আখের বৃদ্ধি ও কখনও কখনও আখের পরিপক্ব পর্যায় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে; বন্যা আখের বৃদ্ধি পর্যায় ও পরিপক্ব পর্যায় জুন থেকে আগস্ট মাসে এবং লবণাক্ততা অংকুরোদগম থেকে আখ কর্তন পর্যায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসে ইক্ষু চাষে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
১. ইক্ষু জাত উদ্ভাবন কার্যক্রম : বিএসআরআই পরিবর্তিত জলবায়ুগত অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলে চাষের জন্য ৪৫টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। ওই ইক্ষু জাতগুলো দেশের চিনিকল এলাকার প্রায় ৯৯% এবং চিনিকল বহির্ভূত গুড় এলাকায় প্রায় ৫৭% এলাকাজুড়ে চাষাবাদ হচ্ছে। বিএসআরআই উদ্ভাবিত ইক্ষু জাতগুলোর গড় ইক্ষুর ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনের বেশি এবং আখে চিনির পরিমাণ ও ১২% এর ঊর্ধ্বে। বিএসআরআই আখ ৪১ জাতটি চিনি ছাড়াও গুড়, রস তৈরি এবং চিবিয়ে খাওয়ার জন্য বিশেষ উপযোগী। গড় ফলনও হেক্টরপ্রতি ১৫০ টনের ঊর্ধ্বে। নিম্ন তাপমাত্রায় ইক্ষুর অংকুরোদগম ভালো হওয়ার জন্য ঠাণ্ডা সহিষ্ণু ইক্ষু জাতও উদ্ভাবন করা হয়েছে। টিস্যুকালচারের মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষের জন্য বিএসআরআই আখ ৪৩ উদ্ভাবন করা হয়েছে।  
খরাপ্রবণ এলাকায় ইক্ষু চাষে করণীয় : খরা সহিষ্ণু ইক্ষু জাত রোপণ, ১৫ নভেম্বরের মধ্যে ইক্ষু রোপণ সম্পন্ন করা, ২৫-৩০ সে. গভীর নালায় ইক্ষু রোপণ, ইক্ষু রোপণের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈবসার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ইক্ষু রোপণের সময় পটাশ সারের সুপারিশকৃত মাত্রার অতিরিক্ত হিসেবে হেক্টর প্রতি ৮২ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করা, ইক্ষু রোপণের পর পরই ইক্ষুর গোড়ায় ও নালায় ১০-১৫ সেমি. পুরু করে  ট্রাস দিয়ে ঢেকে দেয়া, সেচ সুবিধা  থাকলে খরার সময় সেচ দেয়া এবং সেচ সুবিধা না থাকলে খরা চলাকালীন ইক্ষুর পাতার দুই-তৃতীয়াংশ  অংশ কর্তন করে দেয়া।
বন্যাপ্রবণ এলাকায় ইক্ষু চাষে করণীয় : বন্যা সহিষ্ণু ইক্ষু জাত রোপণ করা, আগাম ইক্ষু রোপণ করা, ইক্ষু রোপণের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিকও জৈবসার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ১৫ মে এর মধ্যে উপরি সার প্রয়োগ সম্পন্ন করা, ইক্ষু  রোপণের পর তিন মাস ইক্ষুর আগাছা দমন ও মালচিং নিশ্চিত করা, জুন/জুলাই/আগস্ট মাসে ইক্ষুর মরা ও পুরনো পাতা এবং প্রতি ঝাড়ে ৫-৬টি সুস্থ কুশি রেখে অতিরিক্ত কুশি কর্তন করা, ইক্ষুর জমি বন্যায়  প্লাবিত হওয়ার আগেই ইক্ষুর গোড়ায় মাটি দেয়া, জমিতে স্রোতের ফলে ইক্ষুর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে জমির আইল (সীমানা) বরাবর ধৈঞ্চা বপন করা, ইক্ষুর জমি হতে পানি নেমে গেলে যথাসম্ভব দ্রুত ইক্ষু কর্তন ও মাড়াই করা,
জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় ইক্ষু চাষে করণীয়
জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ইক্ষু জাত রোপণ করা, আগাম ইক্ষু রোপণ করা, ইক্ষু রোপণের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈবসার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ১৫ মের মধ্যে উপরি সার প্রয়োগ করা, ইক্ষু রোপণের পর তিন মাস ইক্ষুর আগাছা দমন ও মালচিং নিশ্চিত করা, ১৫ জুনের মধ্যে ইক্ষুর গোড়ায় মাটি দেয়া, জুন/জুলাই/আগস্ট মাসে ইক্ষুর মরা ও পুরনো পাতা এবং প্রতি ঝাড়ে ৫-৬টি সুস্থ কুশি রেখে অতিরিক্ত কুশি কর্তন করা, ইক্ষুর জমি জলাবদ্ধতা হওয়ার আগেই ইক্ষুর গোড়ায় মাটি দিয়ে বেঁধে দেয়া, ইক্ষুর জমি জলাবদ্ধতা অবস্থায় জমিতে উৎপাদিত জলজ উদ্ভিদ (ঘাস) এবং শ্যাওলা দমন করা, ইক্ষুর জমি হতে পানি কমে গেলে যথাসম্ভব  দ্রুত ইক্ষু কর্তন ও মাড়াই করা।
২. রোপা ইক্ষু চাষ (এসটিপি) প্রযুক্তি  
পরিবর্তিত জলবায়ুতে ইক্ষু চাষের জন্য রোপা ইক্ষু চাষ প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয়েছে, যা ইক্ষু চাষকে অধিক লাভজনক করতে পারে। নিম্ন তাপমাত্রা এবং মাটিতে অপর্যাপ্ত রস থাকার কারণে আখের অঙ্কুরোদগম কম হওয়া সত্ত্বেও জমিতে পর্যাপ্তসংখ্যক মাড়াইযোগ্য আখ উৎপাদনের জন্য রোপা ইক্ষু চাষ প্রযুক্তি  উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে রোপা ধানের মতো এক বা দুই চোখবিশিষ্ট বীজখ- থেকে পলিব্যাগে, পরিবেশবান্ধব ছোট্ট চটের ব্যাগে, বীজতলায় কিংবা সরাসরি গাছে চারা উৎপাদন করে সেই চারা জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপণ করা হয়।  রোপা ইক্ষু  চাষের সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলো হলো প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় মাত্র ৪০% বীজ ইক্ষুর প্রয়োজন হয়, জমিতে মাড়াইযোগ্য ইক্ষুর সংখ্যা ও ওজন বৃদ্ধি হয়। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এতে বীজ বর্ধন অনুপাত বৃদ্ধি পায় (১:৩০)। ইক্ষুর ফলন ও অর্থনৈতিক সুবিধা ৫০-৮০% ভাগ বৃদ্ধি পায়। গ্রাম এলাকায় অধিক কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গ্রামের মহিলারাও রোপা ইক্ষু চাষের জন্য চারা উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৩. সাথীফসল প্রযুক্তি
ইক্ষু একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। ফলে স্বল্পমেয়াদি ফসলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়। ইক্ষু চাষের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব বেশি হওয়ায় দুই সারির মাঝে স্বল্পমেয়াদি ফসলের চাষ করা যায়। কৃষকের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাথীফসল প্রযুক্তি এবং জোড়া সারিতে রোপণকৃত ইক্ষুর সাথে পর্যায়ক্রমিক একাধিক সাথীফসল চাষ প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয়েছে। সাথীফসলের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্যাকেজগুলো হলো এক সারি ইক্ষুর সাথে আলু/পেঁয়াজ/রসুন; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে আলু-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে পেঁয়াজ-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে রসুন-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে বাঁধাকপি-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে ফুলকপি-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে ব্রোকলি-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে পেঁয়াজ/সরিষা/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে পেঁয়াজ/মসুর/সবুজ সার। স্বল্পমেয়াদি ডাল ফসলের চাষের ফলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায় এবং আমিষের উৎস হিসেবে প্রতিদিনের খাদ্যে ব্যবহার করতে পারে।
৪. মৃত্তিকা ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা
ইক্ষুর ফলন বৃদ্ধিতে মাটির খদ্যোপাদান এবং সারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগের ফলে ইক্ষুর ফলন, চিনি ও গুড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিএসআরাই ১২টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল যেখানে ইক্ষুর চাষ হয়ে থাকে সেই সকল অঞ্চলের জন্য ইক্ষুর জন্য মুড়ি ফসলসহ সাথীফসল চাষের জন্য সারের সঠিক মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিরূপণ করে।
৫. পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
ইক্ষু ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পোকামাকড় অন্যতম। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ইক্ষুর পোকামাকড় বৃদ্ধি পায়। মার্চ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যেই বেশির ভাগ ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দেখা যায়। জুন মাসে বৃষ্টি বাদল বাড়ার সাথে সাথে ইক্ষুর ডগার মাজরা পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। ইক্ষুর কাণ্ডের মাজরা পোকার আক্রমণ ও গোড়ার মাজরা পোকার আক্রমণ পরিবর্তিত জলবায়ুগত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায় এবং তাপমাত্রা কমে গেলে আক্রমণের প্রাদুর্ভাব কমে যায়। শুধু পোকামাকড়ের কারণেই প্রতি বছর গড়ে ২০% উৎপাদন এবং ১৫% চিনি আহরণ হ্রাস পায়। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আখের ৭০টি পোকামাকড় শনাক্ত করা হয়েছে যাদের মধ্যে ৭/৮টি অতি মারাত্মক। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে কোনো কোনো বছর বিশেষ কোনো কোনো পোকার ব্যাপক আক্রমণ পরিলক্ষিত হয় এবং ফলনের ওপর সাংঘাতিকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গবেষণা কার্যক্রমের বিভিন্ন দিকের মধ্যে ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড় শনাক্তকরণ, ক্ষতিরধরন, আক্রমণের লক্ষণ,  ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে পোকামাকড়গুলোকে মুখ্য, গৌণ প্রভৃতি ভাগে ভাগ, তাদের জীবন বৃত্তান্ত ও প্রজন্ম সংখ্যা, মৌসুমি প্রাচুর্যতা প্রভৃতি নিরূপণ করা হয়। জৈবিক উপায়ে ডগার মাজরা পোকা, কাণ্ডের মাজরা পোকা এবং পাইরিলা দমন; কালচারাল ও যান্ত্রিক উপায়ে সব পোকার দমন ব্যবস্থা; রাসায়নিক প্রয়োগে ডগার মাজরা পোকা, সাদা কীড়া, উঁইপোকা, শিকড়ের মাজরা পোকা, কাণ্ডের মাজরা পোকা ও আগাম মাজরা পোকা দমন; ইক্ষুর জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সুপারিশ করা হয়েছে।
৬. রোগবালাই  দমন ব্যবস্থাপনা
পরিবর্তিত জলবায়ুগত কারণে রোগের অনুকূল আবহাওয়ায় ইক্ষুর ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ইক্ষুর রোগবিস্তার ও প্রসার লাভের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪০টি রোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় ও বিভিন্ন জাতের ইক্ষুতে লক্ষ করা গেছে। এদের মধ্যে ২২টি ছত্রাক, ৪টি ব্যাকটেরিয়া, ২টি মাইকোপ্লাজমা, ১টি ভাইরাস, ২টি কৃমি, ২টি পরজীবী আগাছা দ্বারা সংগঠিত হয় বাকি ৭টি রোগ অন্যান্য কারণে সংগঠিত হয়ে থাকে। শনাক্তকৃত ৪০টি রোগের মধ্যে ১০টি মুখ্য এবং বাকি রোগগুলো গৌণ। ইক্ষু রোগের নাম, রোগের কারণ, রোগের লক্ষণ নিরূপণ করে তার প্রতিকার ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়েছে। ইক্ষুর বীজ শোধন পদ্ধতি, রোগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বীজ আখ উৎপাদন ও ব্যবহার, সমন্বিত রোগ দমন পদ্ধতি এবং আখের রোগ পঞ্জিকা উদ্ভাবন করা হয়েছে। লাল পচা রোগের প্রকোপ কমানো ও মোজাইক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে রোগ প্রতিরোধী জাতের রোগমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বীজ ইক্ষু ব্যবহার সুপারিশ করা হয়েছে; সাদা পাতা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্দ্র-গরম বাতাসে শোধিত বীজ ইক্ষু ব্যবহার সুপারিশ করা হয়েছে; মুড়ি খর্বা ও স্মাট রোগ দমনের জন্য গরম পানিতে শোধিত বীজ ইক্ষু ব্যবহার সুপারিশ করা হয়েছে; বীজ পচা রোগ দমনের জন্য ব্যাভিস্টিন এবং বিজলি ঘাস  দমনের জন্য বিভিন্ন মাত্রায় ইউরিয়া প্রয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে।
৭. স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ গুড় উৎপাদন
গুড় প্রস্তুতে ইক্ষু রস পরিশোধনে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য হাইড্রোজের বিকল্প হিসেবে বন ঢেঁড়স ও উলট কম্বল গাছের নির্যাস ব্যবহারের মাত্রা এবং ব্যবহার পদ্ধতি সুপারিশ করা হয়েছে।   মাটির পাত্র রঙ করে গুড় ভরে মাটির পাত্রের মুখ মোম বা পলিথিন বা মাটি দ্বারা বন্ধ করে দীর্ঘদিন গুড় সংরক্ষণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাটালি গুড় এবং গুড়া দানাদার গুড় পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
৮. তাৎক্ষণিকভাবে পানি ও পুষ্টির জন্য ইক্ষুর রস ব্যবহার
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর তাৎক্ষণিকভাবে পানি ও পুষ্টির জন্য ইক্ষুর রস ব্যবহার করার লক্ষ্যে বাড়ির আঙিনায় বা বাড়িসংলগ্ন মাঠে চিবিয়ে খাওয়া আখের কয়েকটি ঝাড় লাগিয়ে উৎপাদিত আখ সারা বছর চিবিয়ে খাওয়া বা রস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
৯. উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার
সাধারণত ইক্ষু থেকে প্রাপ্ত ছোবরা চিনিকলের ব্রয়লারে ব্যবহার হয়ে থাকে। ছোবরার সামান্য অংশ ব্যবহার করা হয় কাগজ তৈরিতে, আচ্ছাদন, মাশরুম চাষ, গুড় উৎপাদনের জন্য জ্বালানি এবং গৃহস্থালি জ্বালানি হিসেবে। দুর্যোগের সময় ইক্ষুর সবুজ পাতা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ইক্ষু কর্তনের পর এর সবুজ পাতা গোখাদ্য, শুকনা পাতা জ্বালানি, আচ্ছাদন এবং পচিয়ে জৈব সার তৈরি করা হয়।
১০. টেকসই ইক্ষু গবেষণা ও সম্প্রসারণ
জাতীয় অর্থনীতির বার্ষিক জিডিপিতে ইক্ষুর অবদান ০.৭৪%। প্রতি বছর ইক্ষু হতে জিডিপিতে অবদান টাকার অংকে গড়ে ১২০০-১৫০০ কোটি টাকা। দেশে গড়ে বছরে প্রায় ৭০-৭৫ লাখ টন ইক্ষু উৎপাদিত হয়, যা থেকে বার্ষিক জিডিপি আয় প্রায় ১৫২১.৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে গুড় হতে ৮৫২.০০ (০.৪১%) কোটি, চিনি হতে ৩৬৯.০০ (০.১৮%) কোটি, ইক্ষুবীজ হতে ৯২.৬০ (০.০৫%) কোটি, পশু খাদ্য ও জ্বালানি হতে ৮২.৯০ (০.০৪%) কোটি, বাই-প্রডাক্ট হতে ৬৮.৯৪ (০.০২%) কোটি এবং চিবিয়ে খাওয়া ইক্ষু ও রস হতে ৫৬.২৫ (০.০৩%) কোটি টাকা পাওয়া যায়।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য শাকসবজি, দানাদার খাদ্য ও ফলমূলের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে ইক্ষু চাষ দিনকে দিন নিচু ভূমি চরাঞ্চলে, পাহাড়ি এলাকা ও প্রান্তিক প্রতিকূল পরিবেশপ্রবণ এলাকা যথা- খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ত এলাকায় চলে যাচ্ছে। মোট উৎপাদিত ইক্ষুর ২৩-২৭% চিনি উৎপাদনে এবং ৫৩-৫৭% গুড় তৈরিতে ব্যবহার হয়। পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষের জন্য খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধী ইক্ষু জাত উদ্ভাবন এবং চাষের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভানে বিএসআরআই কাজ করে যাচ্ছে। ইক্ষু দুর্যোগের সময় তাৎক্ষণিকভাবে জীবন রক্ষায় বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।

ড. মু. খলিলুর রহমান* ড. মো. আমজাদ হোসেন**

* মহাপরিচালক, **পরিচালক (গবেষণা) বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), ঈশ্বরদী, পাবনা