Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

লবণাক্ততাসহিষ্ণু গমের জাত বিনাগম-১

এদেশে যখন গমের প্রথম যাত্রা হয়েছিল তখন কিন্তু গমের গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম ছিল। সময়ের বিবর্তনে গম এখন সার্বজনীন হয়ে গেছে। সবাই জানেন গম এখন আদর্শ খাবারের একটি। সুস্থ কিংবা অসুস্থ সবার জন্য গম উপকারী। আমাদের দেশে গমের পরিচিত জাতগুলোর মধ্যে আছে কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী, প্রতিভা, সৌরভ, গৌরব, প্রদীপ, শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ। উঁচু ও মাঝারি দো-আঁশ মাটি গম চাষের জন্য বেশি উপযোগী। লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয়। গমের উচ্চফলনশীল জাতগুলো বপনের উপযুক্ত সময় হলো কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ অর্থাৎ নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত। যেসব এলাকায় গম কাটতে ধান কাটতে ও জমি তৈরি করতে বিলম্ব হয় সে ক্ষেতে কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী প্রতিভা ও গৌরব বপন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম খাওয়ার উপযোগী গমের আটায় যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান আছে তাহলো আমিষ ১২ গ্রাম, শ্বেতসার ৭০ গ্রাম, চর্বি ১.৭ গ্রাম, খনিজ ২.৭ গ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.৪৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ ০.২৯ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ১১.৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৯ মাইক্রোগ্রাম, খাদ্যশক্তি ৩৪১ কিলোক্যালরি। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি মতে, গমের মূল্য অনেক বেশি।
অনেক জমিতে বোরো আমন ধান কাটার পর চাষ মই দিয়ে জমি পুরোপুরি তৈরি করে গম বীজ বোনার সময় থাকে না। এক্ষেত্রে বিনাচাষে গম আবাদ প্রযুক্তি অবলম্বন করা যায়। যেসব এলাকায় ধান কাটার পর জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ হাঁটলে পায়ের দাগ পড়ে এমন অবস্থায় বিনাচাষে গম আবাদ সম্ভব। জমিতে রস না থাকলে ধান কাটার পর পরই হালকা সেচ দিয়ে জো আসলে বীজ বুনতে হয়। বীজ বোনার পর ১৫ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাখির উপদ্রব কমানো এবং রোদে শুকিয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য বীজ গোবরে গুলানো অবস্থায় রাখার পর উঠিয়ে শুকাতে হবে। এতে বীজের গায়ে গোবরের প্রলেপ লেগে যায়। এ পদ্ধতিতে গম আবাদে রাসায়নিক সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করা যায়। প্রথমত বীজ ও সার একই সময়ে ছিটানো যায় অথবা গম বোনার ১৭ থেকে ২০ দিনের মধ্যে জমিতে প্রথম সেচ দেয়ার সময় সব সার প্রয়োগ করা যায়। বীজ বোনার ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করা প্রয়োজন। এছাড়া স্বল্পচাষে গম আবাদের জন্য দেশি লাঙল দিয়ে গম বীজ বোনা যায়। এক্ষেত্রে ধান কাটার পর জমিতে জো আসার সাথে সাথে চাষ দিতে হবে। যদি জো না থাকে তবে সেচ দেয়ার পর জো আসলে চাষ করতে হবে। প্রথমে চাষ দিয়ে মই দিতে হবে। দ্বিতীয় চাষ দেয়ার পর সব সার ও বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। অথবা দ্বিতীয় চাষের সময় লাঙলের  পেছনে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে বীজ বোনা যায়। বপনের ২১ দিনের মাথায় হালকাভাবে প্রথম সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচের সময় ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। স্বল্পচাষে গম আবাদ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি।  
বিনাগম-১ উদ্ভাবনের ইতিহাস
বিনাগম-১ এর মিউট্যান্ট সারি নং L-880-43 বিনার সাবেক মহাপরিচালক ড. এ এ হাছান পাকিস্তানের
Nuclear Institute for Agriculture and Biology (NIAB) থেকে L-880 নামক একটি Segregating মিউট্যান্টের বীজ সংগ্রহ করেন যা থেকে জন্মানো গাছগুলোর প্রতিটি থেকে সবচেয়ে ভালো শীষটি বাছাই করে পরবর্তী বছর প্রত্যেকটি শীষ থেকে প্রাপ্ত বীজগুলো আলাদা আলাদা সারিতে বপন করা হয় এবং চেক জাতের চেয়ে বেশি ফলন দিতে সক্ষম এ রকম ১৮টি সারি নির্বাচন করা হয়। এ ১৮টি সারি পরবর্তিতে মাঠপর্যায়ে লবণাক্ত এবং অলবণাক্ত উভয় মাটিতে পরীক্ষা করে ৩টি মিউট্যান্ট সারি নির্বাচন করা হয়। সর্বশেষে, এ ৩টি মিউট্যান্টের মধ্যে L-880-43 মিউট্যান্টটি লবণাক্ত এবং অলবণাক্ত এলাকার গবেষণা মাঠ ও কৃষক মাঠে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখা যায় যে, এ মিউট্যান্টটি অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় থেকে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত প্রতি মিটারে ১২ ডেসি সিমেন লবণাক্ততায়ও চেক জাত বারিগম-২৫ অপেক্ষা শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। এ কারণে ৯ অক্টোবর ২০১৬ জাতীয় বীজ বোর্ডের ৮০তম সভায় L-880-43 নামক মিউট্যান্টটি বিনাগম-১ হিসেবে লবণাক্ত ও অলবণাক্ত এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন পায়।
শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য
বিনাগম-১ এ আধুনিক উফশী জাতের প্রায় সব গুণ বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। লবণাক্ত মাটিতে পুনর্বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৬৭ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং অলবণাক্ত মাটিতে পুনর্বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৮-১০৪ সেন্টিমিটার। গোলাপি  রঙের এবং গাছের কাণ্ড, পাতা ও শীষ মোমের আস্তরণযুক্ত। এর জীবনকাল ১০৫ থেকে ১১০ দিন। দানা মাঝারি ও বাদামি (অসনবৎ)  রঙের। ১০০০ দানার ওজন ৩৬.৬ গ্রাম। লবণাক্ত মাটিতে ফলন প্রতি হেক্টরে ২.২ থেকে ৩.৫ টন ও গড়ে প্রতি হেক্টরে ২.৯ টন এবং অলবণাক্ত মাটিতে ফলন প্রতি হেক্টরে ৩.২ থেকে ৪.২ টন ও গড়ে প্রতি হেক্টরে ৩.৮ টন।
প্রচলিত জাতের তুলনায় এর বৈশিষ্ট্য
বিনাগম-১ প্রচলিত লবণসহিষ্ণু গমের জাত বারিগম-২৫ অপেক্ষা উচ্চতায় সামান্য লম্বা। কা-, পাতা ও শীষে মোমের আস্তরণযুক্ত। সপ্তাহ খানেক পরে ফুল এলেও একই সঙ্গে পরিপক্ব হয়। এর ফলন চেকজাত, বারিগম-২৫ এর তুলনায় হেক্টরপ্রতি শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশি। দানা মাঝারি ও  বাদামি (Amber) রঙের।
চাষাবাদ পদ্ধতি
গমের এ জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী গম জাতের মতোই। এ জাতের বীজ অঞ্চলভেদে নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ডিসেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যায়। জমিতে বীজ বপনের সময় মাটির লবণাক্ততা প্রতি মিটারে ৫ ডেসি সিমেন এর অধিক না হওয়া ভালো। ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করে ১২ ইঞ্চি (৩০ সেন্টিমিটার) দূরে দূরে সারিতে গম বপন করতে হবে। সারির মধ্যে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২ ইঞ্চি (৫ সেন্টিমিটার) রাখতে হবে। লবণাক্ত মাটিতে প্রতি হেক্টরে ২২০ থেকে ২৬০ কেজি ইউরিয়া, ১২৫ থেকে ১৫০ কেজি টিএসপি, ১২০ থেকে ১৪০ কেজি এমওপি, ৬৫ থেকে ৮৫ কেজি জিপসাম, ৬.০ কেজি করে জিঙ্ক সালফেট ও বরিক এসিড এবং অলবণাক্ত মাটিতে প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি বাড়িয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেকসহ পুরো রাসায়নিক সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার  বপনের ২০ থেকে ২৫ দিন পরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও প্রতি হেক্টর জমিতে ৫.০ টন হারে পচা গোবর সার-কম্পোস্ট ব্যবহার করা ভালো। গোবর সার-কম্পোস্ট ব্যবহার করলে গোবর সারে যে পরিমাণ বিভিন্ন খাদ্য উপাদান থাকে তা হিসাব করে সে অনুযায়ী রাসায়নিক সারের পরিমাণ কমিয়ে ব্যবহার করতে হবে। গোবর সার জমি তৈরির ২ সপ্তাহ আগে প্রয়োগ করতে হবে। বৃদ্ধি পর্যায়ে ৮০ মিলিমিটার বা তার চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলে কোনো সম্পূরক সেচ না দিলেও চলে। বৃষ্টিপাত ৮০ মিলিমিটারের চেয়ে কম হলে বা সময়মতো না হলে দুইটি সেচ দিতে হবে প্রথমটি বপনের ২১ থেকে ২৫ দিন পরে ও অপরটি ফুল আসা শুরু হলে।
রোগবালাই ও পোকামাকড়
এ জাতটি কাল দাগ
(Black point) ও পাতা পোড়া (Leaf blotch) রোগ সহনশীল। যখন বাতাসের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে তখন জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিলে যে কোনো স্পর্শ বিষ প্রয়োগ করলে ভালো ফল আসবে।
শস্য পর্যায়
গমের সঙ্গে সমন্বিত শস্য পর্যায় হলো
গম-বোনা আউশ/পতিত-রোপা আমন (লবণাক্ত জমি)
গম-নাবি বোরো ধান বা আউশ ধান-রোপা আমন (অলবণাক্ত জমি)
গম-গ্রীষ্মকালীন মুগ-রোপা আমন (অলবণাক্ত জমি)
আঞ্চলিক উপযোগিতা
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় লবণাক্ত এলাকা পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও খুলনা। এছাড়াও দেশের সব অলবণাক্ত এলাকা রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী এসব এলাকায় গম উৎপাদনের উপযোগী।
সতর্কতা : লবণাক্ত এলাকায় বীজ বপনের সময় মাটির লবণের মাত্রা প্রতি মিটারে ৪ থেকে ৫ ডেসি সিমেনের অধিক হওয়া যাবে না।

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ*
মো. কামরুজ্জামান**

*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও **বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২