Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

গাভীর মিল্ক ফিভার : কারণ ও প্রতিকার

উন্নত জাতের গাভী এবং উচ্চ দুধ উৎপাদনে সক্ষম গাভী প্রসব করবে অথবা করেছে এমন অবস্থায় খামারিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন তার গাভী প্রসব করার পরে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন মারা গেছে, হাত-পা ছেড়ে দিয়েছে। তখন দ্রুত অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের কাছে যেতে হয়। পরে চিকিৎসায় গাভী সুস্থ হয়ে ওঠে। এই রোগের নাম মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধজ্বর । এটি এখন একটি রোগ যার নামেই ফিভার (জ্বর) উল্লেখ আছে, কিন্তু আসলে এ রোগে কোনো জ্বর দেখা যায় না।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এ রোগ খুবই পরিচিত। বিশেষত যারা উন্নত জাতের এবং ভালো মানের সংকর জাতের গাভী লালন পালন করেন। প্রতিবার প্রসবের সময় বা আগে পরে না হলেও প্রায় ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা যায়। যার কারণে কিছু মানুষ গাভী পালনে ভয় পায়। এ রোগ একটি মেটাবোলিক রোগ, যা সাধারণত ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত কারণেই হয়ে থাকে।
এটি পুষ্টি উপাদান ঘাটতিজনিত রোগ। সঠিকভাবে শরীরের কার্য সম্পাদন করতে যে পরিমাণ ক্যালসিয়াম প্রয়োজন তার অভাব হলে এ রোগ হয়।
প্রসবের সময় ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয় অনেক বেশি পরিমাণে। যার কারণে গাভী হঠাৎ পড়ে যায় এবং ঘাড়ের ওপর মাথা দিয়ে বসে থাকে।
রোগের কারণ
ক. রক্তে ক্যালসিয়াম কমে গেলে এই রোগ হতে পারে। সাধারণত ১০০ সি সি রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ থাকতে হয় ৯ মিলিগ্রামেরও বেশি। কোনো কোনো বিশেষ কারণে এই মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে, এমনকি তা ৩-৪ মিলিগ্রামে নেমে আসে। আর তখনই এই রোগের সৃষ্টি হয়।
খ. প্রসবের সময় জরায়ুতে যদি ফুল আটকে থাকে বা কোনো কারণে যদি জরায়ু বাইরের দিকে চলে আসে, কিংবা জরায়ুর কোনো স্থানে যদি বাচ্চা আটকে থাকে, তাহলেও এ মিল্ক ফিভার হতে পারে।
গ. কিছু হরমোনের বৈরী কার্যক্রমের কারণেও হতে পারে। যেমন এড্রেনালিন গ্রন্থির রস নিঃসরণের তারতম্যের কারণেও এ রোগ হতে পারে।
ঘ. গাভীর দেহে বিভিন্ন খনিজের ঘাটতির ফলে স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার জন্যও এ রোগ হতে পারে।
ঙ. প্রসবের পর পালান একবারে খালি করে দুধ দোহন করা হলেও এ রোগ হতে পারে।
গাভী গর্ভকালীন নিজের রক্ত থেকে ক্যালসিয়াম বাচ্চার (ফিটাসের) দেহে পাঠায়। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ০২৫ বা প্রতিদিন ১০ গ্রাম এবং প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় ১ গ্রাম বা সারা দিনে সর্বোচ্চ ৩০ গ্রাম ক্যালসিয়াম প্রসবকালীন দুধে বের হয়। এই কারণেই গর্ভকালীন এবং প্রসবোত্তর উপযুক্ত পরিমাণে ক্যালসিয়ামের সরবরাহ না থাকলেই এ রোগ বেশি হয়।
আরও কিছু কারণে এই ক্যালসিয়াম হ্রাস পায় যথা-
প্রথমত : গাভীর পাকান্ত্র থেকে শোষিত ও অস্থি থেকে বের হয়ে আসা ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ফিটাস ও কলোস্ট্রামের চাহিদার পরিমাণ অপেক্ষা অধিক কম হলে এ রোগ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় এবং কলস্ট্রাম পিরিয়ডে পাকান্ত্রে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত না হলে। আর যেসব কারণে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত হয় না তাহলো-
খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব
ক্ষুদ্রান্তে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম অক্সালেটের সৃষ্টি
অন্ত্র প্রদাহ
ক্যালসিয়াম ফসফরাসের অনুপাতের তারতম্য
ভিটামিন ডি-এর অভাব ইত্যাদি।
এপিডেমিওলজি
প্রি-ডিসপোজিং ফ্যাক্টরস (
pre disposing factors))
বয়স : সাধারণত বয়স্ক গাভীতে বেশি দেখা যায়। ৪-৫ বার প্রসবের পর এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। কারণ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হ্রাস, অন্য দিনে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণ হ্রাস পায়। উচ্চ ফসফরাস যুক্ত খাদ্য ভিটামিন ডি কে তার মেটাবলাইটে বাধা প্রদান করে ফলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ হ্রাস পায়।
জাত : জার্সি জাতের গাভী এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। আকারে ছোট কিন্তু বেশি দুধ দেয় বলেই এ সমস্যা হতে পারে।
পুষ্টি : একটানা ৪৮ ঘণ্টা অনাহারে বা নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করলে ক্যালসিয়ামের অভাব হতে পারে।
সময়কাল : ঘাস খাওয়ানোর চেয়ে ঘরে বেঁধে খাওয়ালে এ সমস্যা বেশি হতে পারে।
হরমোন : প্রসব ও ইস্ট্রাস পিরিয়ডে ইস্ট্রোজেন হরমোন বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ক্যালসিয়াম মেটাবলিজমে বাধা পায়।


প্রাদুর্ভাব ও সংবেদনশীলতা  (Occurance & susceotibility)
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই অধিক দুধ উৎপাদনকারী গাভী এবং অনেক সময় ছাগী, ভেড়ী ও মহিষেরও এ রোগ হয়।
দুগ্ধজ্বর বিক্ষিপ্ত প্রকৃতির রোগ তবে খামারভুক্ত গাভীর এ সমস্যা ২৫-৩০ ভাগ হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
প্রাদুর্ভাবের পর্যায় : সাধারণত তিন পর্যায়ে রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায় : ১. গর্ভাবস্থার শেষ কয়েক দিন, ২. প্রসবকালীন ও ৩. প্রসবোত্তর (৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত)।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব : এ রোগের ফলে গাভীর সাময়িক দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে খামারি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্রুত চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যায়, তবে যদি বেশি দেরি করা হয় তাহলে যে কোনো সমস্যা হতে পারে।
এ রোগে মৃত্যুর হার কম।
রোগের লক্ষণ : এ রোগের নামে জ্বর থাকলেও আসলে জ্বর হয় না। তবে নিম্নোক্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।
গাভীর তাপমাত্রা হ্রাস পায় অনেক সময় স্বাভাবিক থাকে।
দুগ্ধজ্বরে আক্রান্ত গাভীর উপসর্গগুলোকে তিনভাবে ভাগ করা যায়-
প্রথম পর্যায়
মৃদু উত্তেজনা ও অনৈচ্ছিক পেশি খিঁচুনি।
স্নায়ুবিক দুর্বলতা, অতিসংবেদনশীলতা, ক্ষুধামন্দা ও দুর্বলতা।
হাঁটতে ও খাদ্য গ্রহণে অনিচ্ছা, পরবর্তীতে পিছনের পাদ্বয় শক্ত হয় এবং টলমল করে হাঁটে।
হৃদগতি বৃদ্ধি পায় এবং দেহের তাপমাত্রা সামান্য কিছু বৃদ্ধি পায়।
এসব উপসর্গ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য থাকে এবং অলক্ষিতভাবে চলে যায়।
এ পর্যায়ে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে আসে
দ্বিতীয় পর্যায়
গাভী মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং আর উঠে দাঁড়াতে পারে না।
গাভী শুয়ে মাথা ও ঘাড় বাঁকিয়ে ফ্লাঙ্কের ওপর রাখে।
আংশিক পক্ষাঘাত ও অবসাদ প্রকাশ পায় এবং রক্তে ক্যালসিয়াম অধিক মাত্রায় হ্রাস পায়।
সূক্ষ্ম পেশি কম্পন এবং গভীর ও দ্রুত হৃদগতি থাকে।
গাভীর দেহের প্রান্ত বিশেষ করে কান ও নাক ঠা-া থাকে এবং দেহের তাপমাত্রা ৯৬-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকে।
তৃতীয় পর্যায়
প্রাণী অবসাদগ্রস্ত থাকে, দেহের এক পাশে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে। এ বিশেষ ভঙ্গি দুগ্ধজ্বরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
পেট ফেঁপে যায়।
চিকিৎসাবিহীন গাভীর মৃত্যু ঘটে।
রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সর্বনিম্নে নেমে যায় (১ সম/ফষ) ।
প্রসব পূর্ব ও প্রসবকালীন
প্রসবের পূর্বে দুগ্ধজ্বর হলে প্রসব আরম্ভ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রসবের জন্য কোনো কোথ দেয় না।
জরায়ুর নিষ্ক্রিয়তার ফলে প্রসবে বিঘ্ন ঘটে।
প্রসব হলে হাইপোক্যালসেমিয়ায় জরায়ুর নির্গমন ঘটে।
রোগ নির্ণয় : সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করতে হয়।
ক. রোগের ইতিহাস নিয়ে এবং এর ওপর ভিত্তি করে-
গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের ইতিহাস, প্রাপ্ত বয়স্ক গাভী বিশেষ করে ৫-৯ বছর বয়সে এ রোগ বেশি হয়।
সাধারণত প্রসবের ১৫ মিনিট পরে গাভী, ৩০ মিনিট পরে বকনা এবং প্রসববিঘ্ন যুক্ত গাভী ৪০ মিনিট পর দাঁড়ায়। এ সময়ের মধ্যে বাচ্চা প্রসবের পর না দাঁড়ালে মিল্ক ফিভার রোগ সন্দেহ এবং পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
রোগের লক্ষণের সাথে প্রকাশিত উপসর্গ মিলিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়।
রক্তের ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম নির্ণয় করেও এ রোগ নির্ণয় করা হয়।
চিকিৎসা
রোগের লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিন। তাহলে দ্রুতই এ রোগের সমাধান করা যাবে। যেমন চিকিৎসা দেয়া হয়-
 ১. যত দ্রুত সম্ভব ক্যালসিয়াম বোরো গ্লুকোনেট সলুশন ইনজেকশন দিতে হবে। ৪৫০ কেজি দৈহিক ওজনের গাভীকে ৫০০ মিলি ক্যালসিয়াম বোরো গ্লুকোনেট যার মধ্যে প্রায় ১০৮ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে, অর্ধেক মাত্রা ত্বকের নিচে এবং বাকি অর্ধেক শিরায় ৫-১০ মিনিট ধরে দেয়া হয়।
২. সঠিকভাবে সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম রক্তে গেলেই গাভী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
৩. যদি মাত্রা অপর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সলুশন দিয়ে চিকিৎসা করলে গাভী সুস্থও হয় না এবং দাঁড়াতেও পারে না। অথবা সাময়িকভাবে পশু সুস্থ হলেও পুনরায় একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। অপরদিকে ক্যালসিয়াম সল্যুশন অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দ্রুত শিরায় দিলে প্রাণীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
বর্তমানে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম গ্লুকোজ সমন্বয়ে সলুশন বাজারে পাওয়া যায়। দুগ্ধজ্বরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা হ্রাস পায় কিন্তু ম্যাগনেসিয়াম মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই দুগ্ধজ্বরের চিকিৎসার ওষুধ নির্বাচনের জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। দুইভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়-
১. খাদ্য সংশোধন (
(Feed correction))
২. প্রি ডিস্পোজিং ফ্যাক্টরস সংশোধন (
Predisposing factors correction)
প্রথমত : খাদ্য সংশোধন, হতে পারে এমন-
গাভীকে শুষ্ক অবস্থায় ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করা।
তবে শুধু ক্যালসিয়াম দেয়া যাবে না কারণ
দেহকে সম্পূর্ণ পাকান্ত্রের ক্যালসিয়াম শোষণের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। এতে অস্থির ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।
০ খাদ্যে পরিমাণ মতো ফসফরাস সরবরাহ।
০ গাভীর কনসেন্ট্রেট খাদ্যে শতকরা ১৫ ভাগ মনো সোডিয়াম ফসফেট মিশিয়ে খাওয়ালে এ রোগ প্রতিহত হয়।
দ্বিতীয়ত : প্রি ডিস্পোজিং ফ্যাক্টরস সংশোধন-
বয়স : বয়স্ক গাভীর প্রর্যাপ্ত পরিচর্যা নিতে হবে।
জাত : জার্সি জাতের এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশেষ যত্ন ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
গাভীর শুষ্ক ও প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সুষম পুষ্টির ব্যবস্থা করা।
একটু সচেতন হয়ে আমরা গাভীর ব্যবস্থাপনা করলেই এ রোগ হতে সহজেই আমাদের প্রাণীকে রক্ষা করতে পারব। আর রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত সুস্থ করা যায়। ফলে আমাদের দুগ্ধ উৎপাদন ও স্বাভাবিক থাকবে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারব।

 

মো. মোস্তাফিজুর রহমান*

*শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর মোবাইল : ০১৭৬৪১২৫০১৫