Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে মাছের পরির্চযা

চাষি ভাইয়েরা মাছ চাষের পুকুর আশা করি এর মধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন। বড় মাছের পরিচর্যা করার সময় বিশেষভাবে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। পুকুরের মাছকে যেন উপযুক্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক ও পরিপূরক খাদ্যের জোগান দেয়া হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি করার জন্য প্রয়োজন মতো নাইট্রোজেন ও ফসফেট ঘটিত সার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। এ সারের সঙ্গে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগের প্রয়োজন। প্রথম কিস্তিতে প্রায় ৬০ শতাংশ সার প্রয়োগ করে, সারের অবশিষ্ট অংশ প্রতি মাসে পুকুরে সমান হারে প্রয়োগ করলে সারা বছরই পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের জোগান থাকে। তারপর প্রতিদিন পুকুরের মাছকে সুষম পরিপূরক খাদ্য দিতে হবে। পরিপূরক খাদ্য পানিতে মিশিয়ে গোলা করে কাঠের পাত্রে রেখে পুকুরের পানির বিভিন্ন স্তরে দিতে হয়। সন্ধ্যার সময় পাত্রগুলো তুলে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তা থেকে মাছ কতটুকু খেয়েছে। তারপর পরিপূরক খাদ্যের পরিমাণ কমানো অথবা বাড়ানো যেতে পারে।
পুকুরের পানিতে সর্বদা দ্রবীভূত অক্সিজেনের জোগান থাকা চাই। এর জন্য মাঝে মধেই পুকুরের পানিতে স্রোতের সৃষ্টি করতে হয়। পুকুরের সব রকম পচনক্রিয়া বন্ধ করতে হয়। তা হলেই দ্রবীভূত অক্সিজেনের জোগান অব্যাহত থাকবে।

মাছকে নিয়মিত তাড়া দিতে হবে। এ কাজ করতে গেলে পুকুরে মাসে অন্তত ২-৩ বার জাল টানতে হবে। পানির অম্লত্ব সর্বদা কম রাখতে হবে। পুকুরের পানি অম্ল হলে পুকুরে ১০-২০ কেজি চুন প্রতি বিঘায় প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়াও পুকুরে মাছের মজুতের হার কখনোই বিঘাপ্রতি ৭০০টির বেশি হওয়া উচিত নয়। তারপর যদি মিশ্র মাছের চাষ করেন, তবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অনুপাতও সঠিক রাখা প্রয়োজন। যেমন পুকুরের উপরের স্তরের মাছ শতকরা ৩০টি থাকা চাই, মাঝের স্তরের মাছ শতকরা ৪০টি এবং পুকুরের নিচের স্তরের মাছ শতকরা ৩০টি থাকা চাই।
পুকুরের পানির গভীরতা খুব বেশি হলে সে পুকুরে মাছের ভালো ফলন হবে না। সাধারণত বড় মাছের পুকুরে ৫-১০ ফুট পানি থাকলেই মাছের ভালো ফলন পাওয়া যায়।
পুকুরটি এমন হবে যেন পুকুরে যথেষ্ট আলো-বাতাস খেলতে পারে। কোনো নালা-নর্দমার পানি যেন পুকুরে এসে না পড়ে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রজনন ঘটানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। মাছের প্রজনন ঘটানোর সময় বেশ কয়েকটি সতর্কতা গ্রহণ করা দরকার। ডিম তোলার মাছ ভালোভাবে বাছাই করতে হবে যেন মাছগুলো রোগগ্রস্ত না হয় এবং মাছের বয়স অন্তত ২ বছরের বেশি হয়। সিলভার কার্প, গ্রাসকার্পের ক্ষেত্রে মাছের বয়স ৩ বছরের বেশি হলে ভালো। কাতলা ৩ বছর বয়সের হলে ভালো হবে।
মাছকে ইনজেকশন দেয়ার সবক‘টি সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করে নিন। তার মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের পিটুটারি গ্ল্যান্ড আগে থেকেই সংগ্রহ করে নিতে হবে। বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পিটুটারি গ্ল্যান্ড সংগ্রহ করলে লোকসানের কোনো আশঙ্কা থাকে না।
এ সময় প্রজননক্ষম মাছের পরিচর্যার কাজ চালিয়ে যান। যারা এখনই ডিম তোলার কাজ আরম্ভ করতে চান, তারা আপাতত কম মাছ দিয়ে এ কাজ আরম্ভ করুন। কারণ গরমের কারণে সময় বেশি মাছ দিয়ে ডিম তোলার কাজ আরম্ভ করলে মাছের ও ডিম পোনা উভয়েরই ক্ষতি হতে পারে।


জিওল মাছের চাষ যেসব জলাশয়ে করা হয়েছে তা পরিষ্কার করে জিওল মাছের চাষ করুন। কয়েকটি প্রজাতির জিওল মাছের চাষ করা যেতে পারে যেমন- কই, মাগুর, শিংগি, শাল, শোল, ল্যাটা ইত্যাদি। সুতরাং এ রকম জলাশয় আপনার কাছে থাকলে আপনি এ বছর জিওল মাছের চাষ করার কাজে হাত দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। এর জন্য আপনাকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে নিতে হবে। বর্ষা নামলেই বিভিন্ন প্রজাতির জিওল মাছ ডিম পাড়বে। সেগুলো সংগ্রহ করে পুকুরে চাষ করা সম্ভব। তাছাড়া ইনজেকশন দিয়ে জিওল মাছের চারা পোনাও উৎপাদন করা যেতে পারে। পুকুরের পানির গভীরতা খুব বেশি হতে হবে না। পুকুরের তলদেশে পাঁক থাকলেও ক্ষতি হবে না। বিঘাপ্রতি ৩-৮ হাজার জিওল মাছের পোনা পুকুরে দেবেন। পরিপূরক খাদ্য হিসেবে কুঁড়ো, সরিষার খৈল ও শুঁটকি মাছের গুঁড়া সমান সমান মিশিয়ে মাছকে খাওয়াবেন। পুকুর ফেলে না রেখে তাতে জিওল মাছের চাষ করলে আপনি কম খরচে ভালো লাভ তুলতে পারবেন।


মাছের রোগও প্রতিকার : চারা পোনার রোগ মৌসুমের শুরুতেই চোখে পড়তে পারে। যেমন- গায়ে ঘা, পোনার গায়ে কালগুটি রোগ কিংবা সাদাগুটি রোগ। সব সময় পোনাগুলোর প্রতি লক্ষ রাখুন। রোগের লক্ষণ দেখামাত্র প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। মাছের পোনার কালগুটি রোগ হলে রোগাক্রান্ত পোনাগুলোকে প্রতি লিটার পানিতে ৩ এমজি পিকারিক এসিড গুলে ওষুধের মিশ্রণে ১ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর সেগুলোকে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়বেন। তাতে পোনার কালগুটি রোগের নিরাময় হবে। মাছের পোনার সাদাগুটি রোগ হলে চারাগুলোকে প্রতি ৫ লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার ফরমালিন গুলে ওষুধ মিশ্রণ তৈরি করে তাতে ৭-১০ দিন প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ডুবিয়ে রাখতে হবে। ফলে চারার সাদাগুটি রোগ শেষ হয়ে যাবে। তখন সেগুলোকে পানিতে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়বেন।
চারার গায়ে ঘা হলে সেগুলোকে প্রতিলিটার পানিতে ১ গ্রাম কেএমএনও-৪ গুলে পোনা ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। তারপর সেগুলোকে পুকুরে দেবেন।
বড় মাছের পুকুরেও কয়েকটি রোগ এ সময় দেখা যাবে। যেমন- মাছের কানকোয় ও গায়ে অসংখ্য আরগুলাস উপদ্রব হতে পারে। এটা দমন করার জন্য পুকুরে নুভান নামক একটি ওষুধ প্রতিবিঘায় ১৩০ মিলিলিটার হারে প্রয়োগ করবেন। ওষুধটি প্রয়োগ করে কয়েক দফা জাল টেনে ওষুধটি পানির সাথে মিশিয়ে দিন। ১৫ দিন পর আরগুলাস দমন না হলে পুনরায় একই হারে ওষুধটি প্রয়োগ করবেন।

 

এছাড়া বড় মাছের গায়ে ক্ষতরোগ হতে পারে, ফুলকা ও পাখনায় পচন রোগ দেখা যেতে পারে, কিংবা চোখ ফুলা রোগও দেখা যেতে পারে। এ রোগগুলো দমনের জন্য সালফাজল অ্যাসিড অথবা সালফাজিন নামক ওষুধের যে কোনো একটি ১০০ গ্রাম প্রতি কেজি পরিপূরক খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে পুকুরের মাছকে ৫-৭ দিন খেতে দিন। মাছের রোগের নিরাময় হবে। তারপর পুকুরে ১৩-২০ কেজি চুন প্রতি বিঘা হারে প্রয়োগ করবেন। পুকুরের পানিকে শোধন করার জন্য বিঘাপ্রতি ৬৫০ গ্রাম কেএমএনও-৪ ওষুধ পানিতে গুলে পুকুরে দিন।
উপসংহার : এখনই সারা বছরের মাছ চাষের কাজ আরম্ভ করতে হবে। এ সময় আপনি যেভাবে পুকুর তৈরি করবেন এবং পুকুর সংস্কারের যেসব ব্যবস্থা নেবেন তার উপরই সারা বছরের মাছের ফলন নির্ভর করবে।

 

আফতাব চৌধুরী*
*সাংবাদিক, ব্লক-এ, শাহজালাল উপশহর, সিলেট