Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ফল ও ফসলের জাত উন্নয়ন

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা ছিল এখন তা তিনগুণ অথবা তারও বেশি। যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে সে হারে কিন্তু ফসলি জমির পরিমাণ বাড়েনি বরং কমেছে। সে সময় যে হারে ফসল উৎপাদন করা হতো এখন যদি সেই একই হারে ফসল উৎপাদন করা হয় তাহলে এত মানুষের খাদ্যের চাহিদার জোগান দেয়া কি সম্ভব হতো? অথবা আজ থেকে ২০ বছর পর জনসংখ্যা  যখন আরও বাড়বে তখন খাদ্যের জোগান কিভাবে দেয়া যেতে পারে? ফসলি জমিগুলো দিন দিন বসত ভিটা আর শিল্পকারখানায় পরিণত হচ্ছে। যে পরিমাণ আছে তাও আবার বন্যা, খরা অথবা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কবলিত। এসব সমস্যার সমাধান কী হতে পারে? সমাধান ফসলের জাত উন্নয়ন।
ফসলের জাত উন্নয়ন হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলকে উন্নত ও উচ্চফলনশীল, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ যেমন- খরা, বন্যা ইত্যাদির উপযোগী করে তোলা। বোঝার সুবিধার্থে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন একটি এলাকা চরম খরাপ্রবণ। এখন সে এলাকায় কিভাবে ফসল উৎপাদন করা যেতে পারে? এক্ষেত্রে আমাদের এমন একটি বৈশিষ্ট্য অথবা গুণ প্রয়োজন যা ফসলকে কম পানি শোষণ করে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। আমরা জানি মরুভূমির গাছগুলো কম পানি শোষণ করে বেঁচে থাকে। এই  বৈশিষ্ট্যটি যদি আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত ফসলে প্রবেশ করাতে পারি তাহলে তারা যেমন খরাতে টিকে থাকবে তেমনি ফলনের নিশ্চয়তাও দিতে পারবে। এমনিভাবে ফসলকে বন্যা, লবণাক্ততা, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী করে তোলা সম্ভব। আবার ফসলের জাতকে উচ্চফলনশীল করার মাধ্যমে যে জমিতে আগে ১০ মণ ফসল পাওয়া যেতো এখন সেখানে ১০০ মণ পাওয়া যেতে পারে।

ফসলের জাত উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো
ফসলের জাত উন্নয়নের ক্ষেতগুলো হচ্ছে
১.     ফসলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি
(Abiotic Stress) উপযোগী করে তোলা;
২.     মৌসুমি ফসলগুলো বারো মাস উৎপাদন উপযোগী করে তোলা;
৩.     পোকামাকড় ও রোগ-বালাই প্রতিরোধী করে তোলা
(Disease and pest Resistance);
৪.     উচ্চফলনশীল করা;
৫.     ফসলের বন্ধ্যত্ব
(Dormanuy) দূর করা;
৬.     ক্ষতিকর উপাদান দূরীকরণ যেমন- খেসারির ডালে নিউরোটক্সিন আছে, যা প্যারালাইসিস সৃষ্টি করে। এ নিউরোটক্সিন দূর করে নতুন জাত সৃষ্টি করা যেতে পারে;
৭.     ফল-ফসলের পরিপক্বতার সময়কালকে কমিয়ে আনা ফলে এক বছরে কয়েকবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে;
৮.     ফল-ফসলের মধ্যে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির উন্নয়ন সাধন করা;
৯.     উন্নত ফসল, যা আমাদের দেশে উৎপাদন করা হয় না সেগুলো এ দেশে উৎপাদন উপযোগী করে তোলা;
১০.     উন্নত কিন্তু বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির উৎপাদন করা;
১১.    ফসলের এগ্রোনোমিক বৈশিষ্ট্য
(Agronomic characteristics) বৃদ্ধি করা;
১২.    সংগৃহীত ফল-ফসলের স্থায়িত্বকাল
(Shelf life) বৃদ্ধি করা;
১৩.    অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মান উন্নয়ন করা যেমন- পাটের আঁশের মান উন্নয়ন করা।

ফসলের জাত উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে উদ্ভিদের একটি উন্নত গুণ বা বৈশিষ্ট্য (জিন) অন্য একটি উদ্ভিদে প্রবেশ করানো যায়, যা সুনির্দিষ্ট এবং বংশানুক্রমিকভাবে স্থানান্তরযোগ্য। গতানুগতিক প্রজননের
(Conventional breeding) ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো দেখা যায় তা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সহজেই দূর করা সম্ভব। গতানুগতিক  পদ্ধতিতে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের স্থানান্তর কেবলমাত্র এমন দুইটি উদ্ভিদের মধ্যে সম্ভব যারা যৌনজননে অংশগ্রহণ করতে পারে। আবার যে বৈশিষ্ট্য আমরা আনতে চাই তার পাশাপাশি অনাকাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ ফসলে চলে আসতে পারে যা ফসলের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। এ পদ্ধতি অনেক ধীর। অপরদিকে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে একই প্রজাতির বিভিন্ন ফসলের মধ্যে যেমন গুণাগুণ স্থানান্তর করা যায় তেমনি দূরবর্তী কোনো প্রজাতি যেমন প্রাণিদেহ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তর করাও সম্ভব।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ধাপগুলো
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মোটামুটিভাবে ৫টি ধাপে সম্পন্ন করা হয়।
ধাপ ১ : কাঙিক্ষত ডিএনএ সংগ্রহ
(DNA extraction)
প্রজাতির গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য (জিন) ডিএনএ’তে সংরক্ষিত থাকে। ডিএনএ’র যে অংশটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে তা নির্বাচিত ও সংগ্রহ করা হয়। এজন্য বিভিন্ন এনজাইম ও কাটিং টুল ব্যবহার করা হয় যাতে প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে সম্পন্ন কর যায়।
ধাপ ২ : জিন ক্লোনিং
(Gene Cloning)
এ ধাপে জিন ক্লোনিং করা হয় অর্থাৎ যে বৈশিষ্ট্য বা গুণ (জিন) নির্বাচিত করা হয়েছে তার অনেক কপি বানানো হয়। এতে একক বৈশিষ্ট্য সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়।
ধাপ ৩ : নতুন জিনের নকশা তৈরি
(Gene design)
নির্বাচিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ডিএনএ’র ছোট অংশটি কাক্সিক্ষত ফসলের বিশাল ডিএনএ’র মধ্যে বিভিন্ন এনজাইম ও কাটিং টুলের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে নতুন জিনের নকশা তৈরি করা হয়।
ধাপ ৪ : রূপান্তরকরণ
(Transformation)
নতুন জিনের নকশাটি রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত করা হয়। উদ্ভিদে যেহেতু লফ লফ কোষ আছে তাই প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াসে এ নকশাটি প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাই টিস্যু কালচারের মাধ্যমে তৈরিকৃত ক্যালাসে প্রবেশ করানো হয়। ক্যালাস হচ্ছে অনেক কোষের সমষ্টি যা দেখতে থকথকে জেলির মতো। এ ক্যালাস থেকে পরবর্তীতে নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি যার সব কোষে নতুন বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পাবে। জিনের নতুন নকশাটি বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে কোষের ভেতর প্রবেশ করানো হয়। এ কৌশলগুলোর মধ্যে জিন গান (Gene gun) এগ্রোব্যাকটেরিয়াম (Agrobacterium), মাইক্রোফাইবার ও ইলেকট্রোপোরেশান সবচেয়ে প্রচলিত। এ পদ্ধতিগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে উদ্ভিদ কোষকে না মেরে সফলভাবে জিনের নতুন নকশাটি কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করানো। রূপান্তরিত উদ্ভিদ কোষ গ্রিনহাউসের মধ্যে পরিপূর্ণ উদ্ভিদে পরিণত হয়। এ উদ্ভিদের বীজগুলো নতুন বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয় যা সংগ্রহ করে পরবর্তীতে ব্যবহার করা যায়।
ধাপ ৫ : ব্যাকক্রস প্রজনন
এ উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী উদ্ভিদকে জাত হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্বাচিত করা হয় এবং পরবর্তীতে মাতৃ গাছ হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য উত্তম প্রজাতির সঙ্গে প্রচলিত পদ্ধতিতে
(Traditional breeding) বার বার প্রজনন করা হয়। এতে উৎপন্ন চারা উন্নত বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়। এভাবে উন্নত জাত উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
উপসংহার
এদেশের অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আবাদি জমির স্বল্পতা প্রভৃতি নানামুখী সমস্যা সমাধানে কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদনে বিকল্প পদ্ধতির অনুসরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ফল ও ফসলের জাত উন্নয়ন এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে, এদেশের মানুষকে দিতে পারে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা।

 

শাব্বির আহমদ*
*ছাত্র, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়