একটি কৃষক সংগঠনের সাফল্য এবং টিকে থাকা না থাকার পেছনে বহু বিষয়ের অবদান রয়েছে। একটি সংগঠন কোন পটভূমি ও প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে তা থেকে শুরু করে এর পরবর্তী ব্যবস্থাপনা এবং কর্মকাণ্ডের ওপর তা নির্ভর করে। কৃষক সংগঠনের অবস্থা চিত্রায়ন ও দক্ষতা যাচাইয়ের একটি সমীক্ষায় এমন কতগুলো বিষয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রায় ক্ষেত্রেই অবহেলিত হয় আর তার ফলে, বিশেষ করে, সংগঠন সফল ও টেকসই হতে পারে না। নিচের পিরামিড চিত্রে একটি কৃষক সংগঠনের সাফল্যের মূল বিষয়গুলো দেখানো হলো-
কৃষক সংগঠনের সাফল্যের পিরামিড
স্বশাসন : যদিও কোনো কোনো কৃষক সংগঠন সম্প্রসারণ সংস্থার সহায়তায় গঠিত হচ্ছে কিন্তু এ ধরনের সংগঠনের দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার জন্য স্বশাসন বা তার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনের ভেতর থেকেই আসতে হবে নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা ও উদ্যোগ। অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংগঠনের সদস্যদের নিজেদের। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্প্রসারণ সংস্থা বা প্রকল্পের সহায়কদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো রকম প্রভাব থাকলে চলবে না। অবশ্য এর অর্থ এই নয় সহায়তাকারীদের (facilitators) কোনো ভূমিকাই থাকবে না। সরকারি-বেসরকারি সম্প্রসারণ সংস্থা যারা সহায়ক হিসেবে কৃষক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবে তাদের সবার অবশ্যকরণীয় হলো একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংগঠনের পরিপূর্ণ স্বশাসনের জন্য সত্যিকার অর্থে কাজ করা। যেমন প্রদর্শনী বা প্রকল্প সুবিধা কে পাবে সেটা নির্ধারণ করবে সংগঠন। সম্পদের ব্যবহার কিভাবে করা হবে তার সিদ্ধান্তও নেবে সংগঠন। তাই এটাকে সম্ভব করতে কৃষক সংগঠনের সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি বাইরে থেকে অতিরিক্ত চাপানো কিছু হলে চলবে না। বরং তার বদলে অবশ্যই সংগঠিত হওয়ার উপকারিতাগুলো কী কী তার ওপর জোর দিতে হবে। যেসব কৃষক সংগঠন ইতোমধ্যে সুগঠিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের কাছ থেকে এক বা আরেক সংগঠনকে শিখে নেয়ার সুবিধা করে দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে স্থানীয় কৃষক সংগঠনগুলোর মাঝে নেটওয়ার্কের বা যোগসূত্রমূলক কাঠামো আরও উন্নত করে গড়ে তুলতে হবে। এ প্রক্রিয়া একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যারা কৃষক সংগঠন গড়ার কাজ করছেন তাদেরকে অবশ্যই এ সময়টা দিতে হবে।
সর্বসম্মত নেতৃত্ব (inclusive leadership) : কৃষক সংগঠনগুলোর টেকসই হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দরকার। এ নেতা তার সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে ধারণ করবেন, সদস্যদের সক্রিয় করে তুলবেন ও সংগঠনের কাজে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। নেতার প্রতি সংগঠনের সদস্যদের সত্যিকার সমর্থন থাকতে হবে। নেতা নিজেকে সংগঠনের কাজে সর্বদা নিয়োজিত রাখবেন; সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে দূরে ঠেলে সবাইকে লক্ষ্যের দিকে চালিত করবেন। বিনয়ের সঙ্গে অন্যের মতামতকে গ্রাহ্য করবেন। সঙ্গে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রেখেও চলবেন। বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি নেতা ভূমিকা রাখবেন। সুযোগ্য নয় এমন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো কারণ থেকে থাকলে সেই সুপ্ত ক্ষোভের প্রতিকার ও জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে।
নেতা তখনই হবেন যখন তিনি সংগঠনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন, গতিশীলতা আনবেন। সব সদস্য পরস্পরের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত মনে করবেন এবং একে অপরের সহায়তায় সদা সচেষ্ট থাকবেন এবং এভাবে তারা অগ্রসর হবেন।
মজবুত সদস্যভিত্তি : কৃষক সংগঠনের শক্তি নিহিত তাদের সদস্যদের সক্রিয়তার মাঝে। সব কাজে সদস্যদের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ স্বাভাবিকভাবে দলের নেতৃত্বকেও শক্তিশালী করে। তবে এর বিপরীতটা কোনোক্রমেই সত্য হতে পারে না, অর্থাৎ সংগঠন শুধু নেতাদের শক্তিতেই মজবুত হতে পারে না। সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয়রাই কেবল সংগঠনের সব সুবিধা গ্রহণ করবেন এমন প্রবণতা সংগঠনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তাদের এ প্রবণতার (অভিজাতরাই সুবিধার মালিক-এ মানসিকতা) দরুন নেতারা তাদের সদস্যদের সঙ্গে সুবিধাগুলো ভাগাভাগি করে নিতে চান না। এতে সদস্যরা সংগঠন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে পারেন। পরিণামে সংগঠন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এ কারণে সংগঠনে বলিষ্ঠ ও সক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যবর্গের একটা মজবুত ভিত্তি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ভিত্তি মজবুত থাকলে সংগঠনের স্থায়িত্ব বাড়ে। সদস্যদের সংগঠনের বিষয়ে অবশ্যই যথেষ্ট আন্তরিক থাকতে হবে এবং পাশাপাশি নেতৃত্বকেও জবাবদিহি করতে সক্ষম হতে হবে।
সদস্যদের চাহিদামাফিক সেবা প্রদান : কৃষক সংগঠন তার সদস্যদের জন্য সে সেবা প্রদান করে থাকে তা অবশ্যই সদস্যদের সত্যিকারের প্রয়োজনের নিরিখে হতে হবে, বাইরের পেশাদার ব্যক্তিদের পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে নয়। সেবা প্রদান ব্যবস্থায় সত্যিকারের প্রয়োজনের প্রতিফলন থাকলে সেটা সংগঠনকে আর্থিক দিক থেকে টেকসই করে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অনেকে মনে করেন অর্থই সব অনর্থের মূল কিন্তু খুব কম লোকই আছেন যারা ভেবে দেখেন যে অর্থের মূলে হলো সঠিক উদ্যোগ, কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়। এ আর্থিক স্থিতিশীলতা বাস্তবে আকার নিতে পারে যদি সংগঠনের মালিকানায় কোনো একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যেমনÑ আমরা সংগঠনের বিনিয়োগে বীজ উৎপাদন বা নার্সারি বা কৃষি যন্ত্রপাতি ভাড়া প্রদান ব্যবসার কথা বলতে পারি। ভালো উপকরণের চাহিদা সব সদস্যর নিকট সমান। এ রকম একটা উদ্যোগ হাতে নিলে তা থেকে সদস্যদের যেমন সেবা দেয়া যায় আবার কিছু আয়ও আসে। সংগঠন টেকসই করা যায়। আবার তথ্য ও পরামর্শ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা যায়। এটা কোনো আয় নিয়ে আসতে না পারলেও সংগঠনের সদস্যদের জন্য সরকারি দপ্তর থেকে সেবা পাওয়াটা নিশ্চিত করতে পারে। এভাবে চাহিদা অনুযায়ী উন্নত সেবা দিতে পারলে সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে ক্রমাগত সদস্যভুক্তির একটা ধারা তৈরি করতে পারে। আর এভাবে যারা সদস্যভুক্ত হতে থাকবেন তাদের প্রদেয় চাঁদা তথা আয় পাবে সংগঠন। সদস্য বাড়তে থাকলে তারা সংগঠনের কাজে সক্রিয় হবে ও সংগঠনের আয়ও আসতে থাকবে। সংগঠন আর্থিক দিক থেকে টেকসই হয়ে উঠবে।
স্পষ্ট স্বকীয় উদ্দেশ্য : কৃষক সংগঠন গড়ার প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক পদক্ষেপ হলো কৃষকদের সংগঠিত হওয়ার উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার, স্পষ্ট ও স্বকীয় করে তোলা। শুধু সহায়তাকারী কর্মকর্তার কাছেই নয়, সব সদস্য কৃষকের কাছে এ উদ্দেশ্য অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে। সহায়করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব ধ্যান ধারণা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এটি একটি বড় বিষয় যা কৃষক সংগঠন গড়ার কাজকে যান্ত্রিক ও নিষ্প্রাণ করে তোলে। আর সাধারণত সেই একই কারণে যেসব সংগঠন প্রকল্পের আওতায় গঠিত হয় সেসব প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই ব্যর্থতার ঝুঁকিতে পড়ে।
মাহমুদ হোসেন* ড. ইমানুন নবী খান**
* ন্যাশনাল টিম লিডার, আইএপিপি-টিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ** প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, আইএপিপি-টিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা