বোরো ধান বাংলাদেশের মোট উৎপাদনে গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৫ থেকে ২.০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। গত বছর ১৯.১৫ মিলিয়ন টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮.০১ মিলিয়ন টন। আগামী বোরো উৎপাদন নির্বিঘ্ন করার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বোরো আবাদে সঠিক জাত নির্বাচন সমস্যা, কৃষিতাত্ত্বিক ও সার ব্যবস্থাপনা সমস্যা, রোগ-বালাই ও সেচজনিত প্রতিবন্ধকতাগুলো এবং সম্ভাব্য প্রতিকার ব্যবস্থা তুলে ধরা হলো-
জাত নির্বাচনে সতর্কতা ও করণীয়
বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমি ৩০টি বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিভক্ত। ধান এমন একটা ফসল যা দেশের প্রায় সব পরিবেশ অঞ্চলে চাষাবাদ করা গেলেও কৃষি পরিবেশ অঞ্চল ভেদে এর অভিযোজনশীলতায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষক অনেক সময় এলাকা ভিত্তিতে সঠিক জাত নির্ধারণ করতে পারেন না। যেমন- কোনো কৃষকের জমিতে ১৫০ দিনের কম জীবনকাল সম্পন্ন জাত (যেমন-ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৪৭) ভালো হবে কিন্তু না জানার কারণে সেখানে কৃষক ১৫০ দিনের বেশি জীবনকাল সম্পন্ন জাত নির্বাচন করেন; যেমন- বিআর১৪, ব্রি ধান২৯। তাছাড়া কৃষক অনেক সময় গুণগত মানসম্পন্ন বীজের অভাবে সুস্থ সবল চারা উৎপাদন করতে পরে না। তালিকা অনুযায়ী কৃষি ইকোসিস্টেম ও ভূমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সঠিক জাত নির্বাচন করতে হবে।
অঞ্চল উপযোগী জাতগুলোর সীমাবদ্ধতা
মার্চ-এপ্রিলে অতিবৃষ্টি। পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যা। স্বল্পমেয়াদি, ঠাণ্ডা সহনশীল উচ্চফলনশীল জাতের অভাব। হাওর (বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ) এ অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত উঁচু জমির জন্য ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০ এবং ব্রি ধান৫৮ । মাঝারি নিম্ন জমিতে ব্রি ধান২৮, ব্রি হাইব্রিড ধান ৩ ও ৫ আর নিম্ন জমিতে ব্রি ধান২৮ বৃহত্তর রাজশাহী চলনবিল ও অন্যান্য অঞ্চল : বিআর১৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫
বরেন্দ্র অঞ্চল : বিআর২৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৬৩, হাইব্রিড ধান৩ ও ৫। ব্রাউশ হিসেবে : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৮ ও ব্রি ধান৫৮ ঠাণ্ডায় ধানের চারা উৎপাদন ব্যাহত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ধান লাগানোর পরে পুনরায় রোপণ করতে হয়। মার্চ-এপ্রিলে অতিবৃষ্টির ফলে চলনবিলের নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়ে দীর্ঘ জীবনকালের বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বৃহত্তর রংপুর অপেক্ষাকৃত নিম্ন অঞ্চল : বিআর১৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৬৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫।
অপেক্ষাকৃত উঁচু ও বেলে দো-আঁশ অঞ্চলে ব্রাউশ হিসেবে : বিআর২৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৫৮ ও ব্রি ধান৬২।
ঠাণ্ডা সহনশীল জাত : ব্রি ধান৩৬, ব্রি ধান৫৫ ও ব্রি ধান৬৯। শীতে চারা মারা যায়; ধানের প্রজনন পর্যায়ে ঠাণ্ডার কারণে চিটা হয়ে যায়; ব্রাউশ ধান জুন মাসের উচ্চ তাপমাত্রার কারণে চিটা হয়; মাটির বুনট বেলে দো-আঁশ হওয়ায় সেচ সংখ্যা অনেক বেশি লাগে। ধানের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়।
বৃহত্তর কুষ্টিয়া জাতগুলো : বিআর২৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৩ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৫।
বৃহত্তর যশোর জলাবদ্ধ অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬৩ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৫।
অন্যান্য অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬৩ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫ জলাবদ্ধতা ও বাদামি গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণ ও ব্লাস্ট রোগ সহনশীল স্বল্প জীবনকালের জাত দরকার। Nutrient use efficient জাতের অভাব।
বৃহত্তর খুলনা অলবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬৩ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৫। মৃদু লবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬৭ ও বিনা ধান১০। মাঝারি মাত্রায় লবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান৬৭ ও বিনা ধান১০। পিট বেসিনের আওতায় নিম্ন অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫। সঠিক জাত, কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা ও ১৫ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় চারা উৎপাদন ও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রোপণ সম্পন্ন করতে পারলে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের সর্বোচ্চ লবণাক্ততা এড়িয়ে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
বৃহত্তর বরিশাল ও পটুয়াখালী অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা কবলিত অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫। মৃদু লবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৬৭, বিনা ধান১০। মাঝারি মাত্রায় লবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬৭, বিনা ধান৮ ও বিনা ধান১০ অলবণাক্ত অঞ্চলে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ধানের পরিপক্ব পর্যায়ে উচ্চ জোয়ারের কারণে বোরো ধান নষ্ট হয়। উঁচু এলাকায় ১৫ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রোপণ সম্পন্ন করতে হবে।
বৃহত্তর ঢাকা ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫ শিল্প বর্জ্য বোরো উৎপাদনে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করেছে। সেচের পানিতে ক্ষতিকর ভারী ধাতু মিশ্রিত।
বৃহত্তর ফরিদপুর জোয়ার-ভাটাকবলিত অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫। উঁচু অঞ্চল : বিআর২৬, ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান৬৩। পিট বেসিনের আওতায় নিম্ন অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫ উচ্চমাত্রায় ফসফরাস গ্রহণক্ষম জাতের অভাব (পিট বেসিন)।
চিকন ও উচ্চ মাত্রার অ্যমাইলোজ সম্পন্ন হাইব্রিড ধানের জাতের অপ্রতুলতা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম পাহাড়ি ভ্যালি অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৬০,ব্রি ধান৬৯, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫।
অলবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৭৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫।
লবণাক্ত অঞ্চল : ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬৭, বিনা ধান-৮ বিনা ধান-১০ পাহাড়ি উপজাতিয় জনগোষ্ঠীর উপযোগী ধানের জাতের অভাব। লবণাক্ত অঞ্চলে ব্রি ধান৬৭ এবং বিনা ধান১০ এর বীজের অপ্রতুলতা।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অপেক্ষাকৃত নিঞ্চল অঞ্চল (হাওর) : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫। অপেক্ষাকৃত মধ্য উঁচু অঞ্চল : বিআর২৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫ মার্চ-এপ্রিলে অতিবৃষ্টি। পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যা।
কুমিল্লা বিআর১৬, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫ জলাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় বোরো চাষে দেরি হয়। ফলে বোরো ধান কাটার সময় হঠাৎ বৃষ্টি হলে পাকা বোরো ধান অনেক ক্ষেত্রে তলিয়ে যায়।
বৃহত্তর সিলেট হাওর অঞ্চলের বাহিরে (মধ্য উঁচু জমিতে) : বিআর১৪, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৫৮, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ৫ মার্চ-এপ্রিলে অতিবৃষ্টি। পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যা।
কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা
চারা তৈরি : অনেক সময় কৃষক অনুর্বর জমিতে এবং গাছের ছায়ায় বীজতলা করেন ফলে চারার গুণগত মান খারাপ হয়। পরবর্তীতে সে চারা হতে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। আদর্শ বীজতলা হতে সুস্থ্য সবল চারা হবে, কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে, বীজের সঠিক হার বজায় থাকে এবং বীজ সাশ্রয় হয়।
বেশি বয়সী চারার ব্যবহার : কৃষক নানা কারণে বেশি বয়সের চারা মাঠে রোপণ করে। বেশি বয়সের চারা হতে বেশি কুশি হয় না পরবর্তীতে ফলন কমে যায়। বোরো মৌসুমে অবশ্যই ৩৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। সঠিক বয়সের চারা রোপণ করলে সর্বোচ্চ কুশির সংখ্যা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া সম্ভব। সাধারণত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ : অনেক এলাকার কৃষক সুষম সার ডিএপি/টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক ব্যবহার করে না। কোনো কোনো এলাকা টিএসপি, এমওপি ব্যবহার করে। কিন্তু জিপসাম এবং জিংক সার ব্যবহার করে না। গাছের বাড়-বাড়তির এবং পর্যাপ্ত কুশি উৎপাদনের জন্য সুষম সার প্রয়োগ করা খুবই জরুরি। কৃষকের জমির উর্বরতা বিবেচনা করে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
নাইট্রোজেন সার ব্যবহারে সতর্কতা : কৃষক চারা লাগানোর ৭-১০ দিনের ভেতর একবার এবং ফুল আসার আগে আরেকবার উপরিপ্রয়োগ করেন। কিন্তু কুশি আসা ও কুশি উৎপাদনের সময় সার প্রয়োগ করে না। ফলে কুশির সংখ্যা কমে গিয়ে ফলন কমে যায়। আবার অনেক সময় পিআই আসার ৫-১০ দিন আগে যে ইউরিয়া সার দিতে হয় তা সঠিক সময় প্রয়োগ করে না। এ সময়ে সার দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো ইউরিয়া সার দিতে না পারলে ধানের ছড়ায় দানার সংখ্যা কমে যায় ফলে ফলন কম হয়। ক্রান্তিকাল (Critical Period) সময়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
সঠিক সময়ে আগাছা দমন : আগাছা সঠিক সময়ে দমন না করলে বোরো মৌসুমে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যায়। বোরো মোৗসুমে চারা লাগানোর পর দুইবার/তিনবার আগাছা পরিষ্কার করতে হয় বা সঠিক আগাছানাশক প্রয়োগ করে আগাছা দমন করা যায়। বোরো মৌসুমে আগাছা দমনের ক্রান্তিকাল (Critical time) হলো ৪৫-৫০ দিন। সে সময় পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে পারলে ফসলের ক্ষতি হবে না। বোরো মৌসুমে চারা লাগানোর অন্তত ৪৫ দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো : জমিতে জৈব সার তথা ধইঞ্চা বা গোবর সার বা খামারজাত সার ব্যবহার করলে অন্যান্য অজৈব সার যেমন- ইউরিয়া, ডিএপি/টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সারের কার্যকারিতা বাড়ে। জমির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। জমির ভৌতিক, জৈবিক ও রাসায়নিক পরিবর্তন এর ফলে পরবর্তীতে ফলন বাড়ে। রোপা আমন কাটার পর যে ১৫-৩০ দিন জমি পতিত থাকে তখন ধৈইঞ্চা বা অন্যান্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া ২০ সেমি. ধানের খড় কাটার সময় জমিতে রেখে দিলে ক্রমান্বয়ে জমিতে জৈব সার ও পটাশের পরিমাণ বড়ে।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা ও করণীয়
বোরো মৌসুমে পোকামাকড়ের আক্রমণে ধানের ফলন ১৩% পর্যন্ত কমতে পারে। এর মধ্যে থ্রিপস, বাদামি গাছফড়িং, সাদা-পিঠ গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা, মাজরা পোকা, গান্ধীপোকা, শীষকাটা লেদাপোকা ও ইঁদুর অন্যতম। সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এসব পোকার আক্রমণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
থ্রিপস
থ্রিপস পোকা বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক উভয় অবস্থায় ধানের পাতার রস শুষে খায়; ধানের বীজতলা এবং প্রাথমিক কুশি অবস্থায় গাছ বেশি আক্রান্ত হয়; সব মৌসুমে এ পোকার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়; আক্রান্ত গাছের পাতাগুলো লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে সুঁচের মতো আকার ধারণ করে; খুব বেশি আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে মারা যায়। আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া ব্যবহার করতে হয়; আক্রমণ বেশি হলে ফাইফানন ৫৭ ইসি, মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি, সেভিন ৮৫ ডব্লিউপি অথবা ডার্সবান ২০ ইসি এর যে কোনো একটি অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।
বাদামি গাছ ফড়িং
বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক বাদামি গাছফড়িং উভয়ই ধান গাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়; এক সাথে অনেক পোকা রস শুষে খাওয়ার ফলে গাছ প্রথমে হলদে ও পরে শুকিয়ে মারা যায় এবং দূর থেকে পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়; বাদামি গাছফড়িংয়ের এ ধরনের ক্ষতিকে ‘হপার বার্ন’ বা ‘ফড়িং পোড়া’ বলে; ধানের শীষ আসার সময় বা তার আগে ‘হপার বার্ন’ হলে কোনো ফলনই পাওয়া যায় না। আলোক ফাঁদ ব্যবহার; জমিতে পোকা বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলা; উর্বর জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ না করা; পোকার আক্রমণ অর্থনৈতিক ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলে (চারটি ডিমওয়ালা পেট মোটা পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকা বা ১০ টি বাচ্চা গাছ ফড়িং বা উভয়ই) প্লিনাম ৫০ডব্লিউজি, একতারা ২৫ডব্লিউজি, মিপসিন ৭৫ডব্লিউপি, এডমায়ার ২০এসএল, সানমেক্টিন ১.৮ইসি, এসাটাফ ৭৫এসপি, প্লাটিনাম ২০এসপি অথবা মার্শাল ২০ইসি কীটনাশকের বোতলে বা প্যাকেটে উল্লিখিত অনুমোদিত সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করার মাধ্যমে এ পোকা দমন করতে হবে।
পাতা মোড়ানো পোকা
এ পোকার ক্ষতিগ্রস্ত পাতায় প্রথমদিকে সাদা লম্বা খাওয়ার দাগ দেখা যায়। খুব বেশি ক্ষতি করলে পাতাগুলো পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়। আলোক ফাঁদ ব্যবহার; জমিতে পার্চিং; ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিহার; জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেভিন ৮৫এসপি, ডার্সবান ২০ইসি অথবা মিপসিন ৭৫ডব্লিউপি এর যে কোনো একটি অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
মাজরা পোকা
মাজরা পোকা শুধু কীড়া অবস্থায় গাছের ক্ষতি করতে পারে; কীড়াগুলো গাছের মাঝখানের ডিগ কেটে ফেলে; ফলে ডিগ মারা যায়। গাছে শীষ বা ছড়া আসার আগে এরকম ক্ষতি হলে একে ‘মরা ডিগ’ বলে। ‘মরা ডিগ’ হলে সে গাছে আর ধানের শীষ বের হয় না; আর গাছে থোর হওয়ার পর বা শীষ আসার সময় যদি কীড়াগুলো ডিগ কেটে দেয় তাহলে শীষ মারা যায় একে মরা শীষ’ বলে। এর ফলে শীষের ধানগুলো চিটা হয়ে যায় এবং শীষ সাদা হয়ে যায়। মাজরা পোকার ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলুন; ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে দিয়ে পোকা খেকো পাখির সাহায্যে পোকার সংখ্যা কমানো যায়; সন্ধ্যার সময় আলোক ফাঁদের সাহায্যে মথ আকৃষ্ট করে মেরে ফেলুন; ধান কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন; ক্ষেতে মরা ডিগ শতকরা ১০-১৫ ভাগ অথবা মরা শীষ শতকরা ৫ ভাগ পাওয়া গেলে ভির্তাকো ৪০ডব্লিউজি, ডার্সবান ২০ইসি, মার্শাল ২০ইসি, সানটাপ ৫০এসপি, অথবা বেল্ট ২৪ডব্লিউজি এর যে কোনো একটি অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।
নেক ব্লাস্ট
নেক ব্লাস্ট ধানের একটি মারাত্মক ছত্রাকজনিত রোগ। ধানের ফুল আসার পর শীষের গোড়ায় এ রোগ দেখা দেয়। বোরো মৌসুমে সাধারণত ব্যাপকভাবে নেক ব্লাস্ট রোগ হয়ে থাকে; আক্রান্ত শিষের গোড়া পচে যায় এবং ভেঙে পড়ে দিনের বেলায় গরম ও রাতে ঠা-া, দীর্ঘ শিশিরে ভেজা সকাল, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, ঝড়ো আবহাওয়া এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এ রোগের জন্য খুবই অনুকূল। কৃষক যখন জমিতে নেক ব্লাস্ট রোগের উপস্থিতি শনাক্ত করেন, তখন জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। সেজন্য কৃষক ভাইদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। যেসব জমির ধান নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি, অথচ ওই এলাকায় রোগের অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে, সেখানে ধানের শীষ বের হওয়ার সাথে সাথেই অথবা ফুল আসা পর্যায়ে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন ট্রুপার (৫৪ গ্রাম/বিঘা) অথবা নেটিভো (৩৩ গ্রাম/বিঘা) অথবা ট্রাইসাক্লাজল গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ৬৬ লিটার পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকালে ৫-৭ দিন অন্তর দুইবার আগাম স্প্রে করতে হবে; ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়।
পাতাপোড়া
ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া বোরো মৌসুমে ধানের অন্যতম একটি প্রধান রোগ। রোগের শুরুতে পাতার অগ্রভাগ বা কিনারায় পানি চোষা শুকনা দাগ দেখা যায়। দাগগুলো আস্তে আস্তে হালকা হলুদ রঙ ধারণ করে পাতার অগ্রভাগ থেকে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। শেষের দিকে আংশিক বা সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায় এবং ধূসর বা শুকনো খড়ের মতো রঙ ধারণ করে। বেশি পরিমাণ ইউরিয়া সারের ব্যবহার, উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা রোগের জন্য অনুকূল। ঝড় ও বৃষ্টির পরে মাঠে রোগটির বিস্তার দ্রুত হয়। ঝড়-বৃষ্টি এবং রোগ দেখার পরপরই ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে; রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে; থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে; পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে (AWD) সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে।
বাকানি
ধানের বাকানি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশেষত সিলেট, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটি একটি বড় সমস্যা। ধানের বাকানি রোগের লক্ষণ বীজতলা ও ধানের জমিতে কুশি অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। আক্রান্ত চারা বা গাছ লম্বা হয়ে যায় এবং কখনও কখনও সুস্থ গাছের চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা হয়ে যায়। এ গাছগুলো লিকলিকে হয় এবং ফ্যাকাশে সবুজ রঙ ধারণ করে। বাকানি রোগটি মাটি ও বীজের মাধ্যমে ছড়ায়। ফলে চারা গাছে বাকানির লক্ষণ দেখা দেয়। তাপমাত্রা বেশি হলে এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। মাটিতে অধিক মাত্রায় ইউরিয়া সারের প্রয়োগ বাকানি রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটতে পারে। রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা; বীজতলা সবসময় পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা; একই জমি বার বার বীজতলা হিসাবে ব্যবহার না করা; অটিস্টিন ৫০ডব্লিউপি বা নোইন দ্বারা চারা শোধন করা (১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটিস্টিন ৫০ডব্লিউপি বা নোইন মিশিয়ে তাতে ধানের চারা ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা); আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলা।
চারাপোড়া বা ঝলসানো
চারাপোড়া বা ঝলসানো ছত্রাকজনিত রোগ। রোগটির ফলে বোরো মৌসুমে বীজতলায় শতকরা ২৫-৩০ ভাগ এবং ট্রেতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ধানের চারা নষ্ট হয়। বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই আক্রান্ত বীজ পচে যেতে পারে; অঙ্কুরিত হবার পর আক্রান্ত চারা আস্তে আস্তে শুকিয়ে মরে যেতে পারে যা পরবর্তীতে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়; শিকড় ও চারার গোড়ার দিকটা কালচে রঙের হয় এবং অনেক সময় সাদা ছত্রাক কাণ্ড, চারার গোড়াতে দেখা যায়। রোগাক্রান্ত চারা দূর থেকে হলদেটে দেখায়; এ রোগ সাধারণত উঁচু জমিতে ও শুকনা বা কম ভেজা মাটিতে বেশি হয়; মাটি, আক্রান্ত নাড়া, আগাছা ও পচা আবর্জনা এ রোগ বিস্তারের জন্য দায়ী। প্রতি লিটার পানিতে ২-৩ মিলি এজোক্সিস্ট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন মিশিয়ে ১৮-২০ ঘণ্টা বীজ শোধন করা; বেশি শীতের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন না করা; শৈত্যপ্রবাহ চলাকালীন এবং রাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা; রোগ দেখা দিলে জমি বা বীজতলায় পানি ধরে রাখা; এজোক্সিস্ট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন২ মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলা/ট্রেতে স্প্রে করা।
সেচজনিত প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকার
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাবনা, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ কাজে বিঘ্নতা ঘটছে। হাওড় এলাকার এপ্রিল-মে মাসে কিছু স্থানে ভূপরিস্থ (ছোট নদী, খাড়ি, নালা ইত্যাদি) পানির অভাবে বোরো ফসলের শেষ পর্যায়ে সেচ প্রদানে সম্ভব না হওয়ায় প্রায়শই ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। উপকুলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানির জন্য এবং উপকূলীয় অলবণাক্ত এলাকায় সেচ অবকাঠামোর অভাবে বোরো চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বরেন্দ্র এলাকায় সেচসাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং পানি সাশ্রয়ী শস্যবিন্যাস প্রচলন। স্বল্প ডিসচার্জের গভীর নলকূপের ব্যবহার করা যেতে পারে। হাওর এলাকায় বিদ্যমান ছোট নদী, খাড়ি, নালাগুলো পুনর্খনন করে ভূপরিস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধিকরণ। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের সুযোগ থাকলে তা দিয়ে সম্পূরক সেচ প্রদান করে বোরো উৎপাদন সুনিশ্চিত করা। উপকূলীয় এলাকায় সরকারি পর্যায়ে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেচ অবকাঠামো উন্নয়ন।
*ড. মো. শাহজাহান কবীর ** ড. মো. আনছার আলী
*** কৃষিবিদ এম আবদুল মোমিন
*মহাপরিচালক, **পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা), *** ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি গাজীপুর