বন্য প্রাণীরা বনে সুন্দর, তখন তারা ক্ষতিকারক বালাই নহে। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা বন্য প্রাণী। মানুষ যখন বন কেটে ধ্বংস করে, তখন তারা মানুষের ফসলের ও সম্পদের তারা বাঁচার জন্য ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা সকল মানুষের নিকট ক্ষতিকারক বালাই হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। হিন্দু ধর্মে ইঁদুর হচ্ছে গনেশ দেবতার বাহক। এ জন্য গনেশ ভক্তগণ ইঁদুরকে মারতেন না, কারণ তাদের বিশ্বাস গনেশ দেবতা অসন্তুষ্ট হতে পারেন। যখন বহুসংখ্যক এসব ভক্তগণ ইঁদুর বাহিত রোগে আক্রান্ত হলেন তখন এদের নিধনের বাধা আর থাকে নাই। প্রাণী জগৎতে ইঁদুরের ভূমিকা ও অবদান অনেক। এদের সংখ্যা বেশি বলে অন্যান্য বন্য প্রাণীরা তাদের প্রোটিনের অভাব পূরণ করতে পারে। পৃথিবীর অনেক মানুষের প্রোটিনের উৎস। দিনাজপুরে ইঁদুর ভোজীরা ম্যাইটা কই হিসেবে অভিহিত করে। পার্বত্য অঞ্চলে শীতকালে বা বর্ষার আগে ইঁদুর ধরে শুঁটকি দিয়ে রাখে এবং বর্ষাকালে খেয়ে থাকে। জার্মানির হ্যামিলন শহরে বংশীবাদক নেই, কিন্তু শুধু ইঁদুরের মাংশ দ্বারা নানান রকমের খাবার তৈরি করে বিক্রি করা হয়। বহু পর্যটক ইঁদুরের মাংশ খাওয়ার জন্য অতি জনপ্রিয় হোটেলে গিয়ে থাকে। মানুষের রোগের নানা ওষুধের কার্যকারিতা ইঁদুরের উপর পরীক্ষার পর মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী হচ্ছে-ইঁদুর, কাঠবিড়ালি ও সজারু। চিকা কিন্তু ইঁদুর জাতীয় প্রাণী নহে। চিকা ফসলের পোকামাকড় খেয়ে উপকার করে। কিন্তু নানা রকম রোগ জীবাণুর বিস্তার ঘটাতে পারে। তাই চিকা ফসলের মাঠে এরা উপকারী প্রাণী, কিন্তু ঘরবাড়িতে এরা মানুষের ক্ষতিকারক বালাই।
সব দেশেই ইঁদুরের সমস্যা কম বেশি বিদ্যমান। ইঁদুরের সমস্যা পূর্বেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষৎতেও থাকবে। এমন কোনো প্রযুক্তি পৃথিবীতে উদ্ভাবন হয় নাই, যে পদ্ধতি দ্বারা সকল ইঁদুর মেরে ফেলা সম্ভব হবে। কিন্তু উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে এদের সংখ্যা কম রেখে, ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং ইঁদুর বাহিত রোগ জীবাণুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব। পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিকগণ প্রতি নিয়ত ইঁদুর দমনের প্রযুক্তির উন্নয়ন করে চলছে। সব ইঁদুর দমন কলাকৌশল সব দেশে সমভাবে কাজ হয় না। কারণ প্রজাতি, পরিবেশের ভিন্নতার বিদ্যমান। ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করার হয়েছে- ১. অরাসায়নিক, ২. রাসায়নিক এবং ৩. বাইলোজিক্যাল দমন পদ্ধতি। এ তিনটি পদ্ধতির রাসায়নিক দমন পদ্ধতি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল আকারের ব্যবহার হচ্ছে। প্রধান কারণ হলো-সবাই মরা ইঁদুর দেখতে চাই, অর্থাৎ হাতে হাতে ফল পেতে চাই। অরাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগের পর ফল দেরিতে পাওয়া যায়, কিন্তু কিছুটা কষ্টকর। বাইলোজিক্যাল পদ্ধতি ফলাফল দেরিতে পাওয়া যায়।
ধনী-গরিব, দালান-কোঠার মালিক, ব্যবসায়ী, কৃষক-শ্রমিক, অফিস আদালত, হাসপাতাল, শিল্পকারখানা, মুরগির খামার যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, সেই বলবে ইঁদুরের উৎপাত রয়েছে মানে অনেক ক্ষতি করছে, রাতে ঘুমাতে পারি না ইত্যাদি। অনেকে বলেন রাতের বেলায় চলাচল বা দৌড়াতে দেখি, অনেক সময় দিনের বেলায়ও দেখা যায়। সাধারণত ইঁদুরের সংখ্যা বেশি না হলে চোখে পড়ে না, অর্থাৎ ওই স্থানে ৫-৭টির বেশি ইঁদুর রয়েছে। অফিসে সবাই ইঁদুরের, গর্ত, মল, অল্প ক্ষতি দেখা সত্ত্বেও দমন ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। যখন ব্যাপক বা বেশি ক্ষতি করে ফেলে তখন ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সকলের এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন ইঁদুরের উপস্থিতি হওয়া বা থাকার অর্থ কিছু না কিছু ক্ষতি করবেই। ইঁদুরের গর্ত দেখা গেলে ইঁদুর দমন ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
ইঁদুর ফসল ও সম্পদের অনেক ক্ষতি করে থাকে। শুধু তাই নয় ৩০-৩৫ ধরনের রোগের বাহক হিসেবেও কাজ করে ইঁদুর। এ জন্য ইঁদুর দমন করা অত্যন্ত জরুরি। ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব গ্রামীণ ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হলো।
বাংলাদেশের ইঁদুর ব্যবস্থাপনার সমস্যাগুলো
১. দলগতভাবে ইঁদুর মারতে চায় না অথবা অভ্যস্ত নহে। ২. ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির প্রতি সর্বস্তরের জনসাধারণ গুরুত্ব কম দেয়। ৩. ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। কিন্তু পোকা দমনের জন্য প্রতিষেধক হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন।
৪. ইঁদুরবাহিত রোগ সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের ধারণা অত্যন্ত কম। ইঁদুরের মলমূত্র, লোম দ্বারা মানুষের মধ্যে রোগের বিস্তার ঘটতে পারে তা বিবেচনা করেন না। রোগের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কারণ আমাদের দেশে কোনো গবেষণা হয় না। ৫. ইঁদুর রাস্তাঘাট, রেল রোড ও বাঁধের বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক ক্ষতি করে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা ইঁদুর দমনের কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেয় না। এজন্য এসব স্থানে ইঁদুর নিরাপদে বংশবিস্তার ও বসবাস করতে পারে। ৬. ইঁদুর প্রজাতির সচেতনতা ও স্মরণশক্তির কারণে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতা সমস্যা দেখা দেয়। ৭. একটি দমন ব্যবস্থা দ্বারা সফলভাবে ইঁদুর দমন করা বাস্তবে সম্ভব নয়। সাধারণত মানুষ মরা ইঁদুর দেখতে চায়। এজন্য বিষটোপ বেশি ব্যবহার করে। তারা অন্যান্য দমন পদ্ধতি ব্যবহার করতে চায় না। অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব-ইঁদুর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাদের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব।
পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা কৌশল
পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা কলাকৌশলের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের সমন্বয় ঘটানোর প্রয়োজন, অন্যথায় দমনব্যবস্থা ততটা কার্যকর হবে না। সমন্বিত ইঁদুর ব্যবস্থাপনার বিবেচ্য উপাদানগুলো নিচে দেয়া হলো।
১. বালাই প্রজাতি : বালাই প্রজাতির ইকোলজি, জীবন বৃত্তান্ত, শারীরতাত্ত্বিক ও আচরণ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। যেমন- কিছু ইঁদুর গর্তে বাস করে (যেমন- মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর), আবার অন্যান্য প্রজাতি গর্তে বাস করে না (যেমন- গেছো ইঁদুর ও সলই ইঁদুর)। প্রজাতিভেদে পরিবেশ ও খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য রয়েছে। যেমন- ব্যান্ডিকট দলের প্রজাতির সাথে (গঁং) দলের ইঁদুরের প্রজাতির খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এজন্য সফলভাবে ইঁদুর দমন করতে হলে প্রজাতি অনুসারে ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্বাচন করতে হবে।
২. পরিবেশ : এ ক্ষেত্রে খাদ্যের উৎস, পতিত স্থান বা আবর্জনাপূর্ণ স্থান, আবহাওয়া এবং বায়োটাইপস ইত্যাদি পরিবেশকে বিবেচনা করতে হবে। যদি খাদ্যের উৎস বা প্রাচুর্য বেশি বা সহজলভ্য হয় সে ক্ষেত্রে ইঁদুর সহজেই বংশবিস্তারের মাধ্যমে পপুলেশন বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। তিনটি মৌলিক জিনিষ যেমন- খাদ্য পানি ও বাসস্থানের ওপর ইঁদুরের বংশবিস্তারের হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে। এ তিনটির একটি অভাব হলে ইঁদুর সেখানে থাকে না ও বংশবিস্তার করে না। বর্ষার সময়ে মাঠের ইঁদুর উঁচুস্থান, রাস্তাঘাট এবং ঘরবাড়িতে চলে আসে। আবার বর্ষা কমে গেলে ফসলের মাঠে ফিরে যায়। তাই বর্ষার সময় উঁচু স্থান, রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ির ইঁদুর মারা হলে পরে মাঠে ইঁদুর সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। পতিত জায়গা বা আবর্জনাপূর্ণ স্থানে ইঁদুর নিরাপদে বংশবিস্তার করতে পারে। শহরে ডাস্টবিন ও বর্জ্য ফেলার স্থানে ইঁদুর সহজেই বংশবিস্তার করে থাকে। কারণ এসব স্থানের ইঁদুর কেহ মারে না। রোগজীবাণুর বিস্তার ও পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য এসব স্থানের ইঁদুর নিধন করার উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
৩. লক্ষ্য ফসল : ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে ফসলের প্রকার, বর্ধনস্তর, কর্তন স্তরের অবস্থা, শস্য, পানি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। গম, ধান ও ভুট্টা (দানাদার শস্য) ইঁদুরের আক্রমণ মাঠে সবচেয়ে বেশি হয়। যেকোনো ফসলের (চারা হতে কুশি স্তর) দমন ব্যবস্থা গ্রহণ উপযুক্ত সময় ও সহজ এবং কার্যকর হয়। থোড় হতে পাকা স্তরে দমন ব্যবস্থা কার্যকর করা কঠিন। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা সাধারণত পাকা স্তরে দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। কৃষকদের মনোভাব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
৪. কমিউনিটি অ্যাপ্রোচ : সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে ইঁদুর দমন অথবা মেরে থাকে। এতে সফলতার পরিমাণ অত্যন্ত কম। দমনব্যবস্থা অল্প সময়ের জন্য কার্যকর থাকে। কারণ ইঁদুরের খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের জন্য সর্বত্র স্থান পররবর্তন করে থাকে। এজন্য মাঠের ফসলের বেশি এলাকা এবং পাড়া অথবা গ্রামের সবাই একত্রে ইঁদুর দমন করা প্রয়োজন। এতে প্রতিবেশির মাঠ অথবা বাড়িতে ইঁদুরের আগমনের সম্ভাবনা কমে যায়। দীর্ঘস্থায়ী ও সফলভাবে ইঁদুর দমন করতে হলে কমিউনিটির সবার অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে এইড-কুমিল্লার পরিবেশবান্ধব ইঁদুর দমন ব্যবস্থার মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে (চিত্র-১)।
এইড-কুমিল্লা, নেত্রকোনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরা জেলার ৮টি উপজেলার ১০টি গ্রামে কমিউনিটি বেইজ পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়িত করছে। একটি গ্রামের ২০০টি পরিবার নির্বাচন করে হাতে কলমে ২ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীর ৯৮% মহিলা। প্রত্যেক পরিবারকে একটি ডাইরি দেয়া হয়েছে যাতে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব, নিধনকৃত ইঁদুরের সংখ্যা লিখে রাখতে পারেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২০০ জনকে চারটি দলে বিভক্ত করা হয়েছে। ৫০ জনকে ২টি করে মোট ১০০টি ফাঁদ দেয়া হয়। এই ১০০টি ফাঁদ ২০০টি পরিবার পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করে। প্রতি মাসে (২৮ দিন অন্তর) প্রত্যেক দল (৫০টি পরিবার) ৭ দিন ব্যবহারের জন্য ফাঁদ পেয়ে থাকেন। এ রোটেশন এক বছর করতে পারবেন। তারা এক বছর দলগতভাবে ২০০ পরিবার ইঁদুর মারবে। এর ফলে প্রশিক্ষণার্থীরা ফাঁদের কার্যকারিতা বুঝতে পারবে। তাদের ইঁদুরের সমস্যা, ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে। দলগতভাবে ইঁদুর নিধন করার সুফল বুঝতে পারবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা, জেলা ও অঞ্চল পর্যায়ের কর্মকর্তারা ২ দিনের প্রশিক্ষণে রিসোর্স পার্সোনেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট জেলার এনজিও অধীনে প্রকল্পের কর্মকর্তারা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির অধীনে ১৯ জন পুরুষ ও ১১,২৫৬ জন মহিলাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রত্যেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিবার ৩০-৩৫টি ইঁদুর কিল ফাঁদ দ্বারা মেরেছে বলে জানা গেছে।
গোলাজাত শস্যের ক্ষয়ক্ষতি রোধ গোলাতে শস্যের ৫-১০% ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি হয়। প্রত্যেক পরিবারের গড়ে ২০০ কেজি গোলাজাত শস্যের প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি হয়ে থাকে। এ গোলাজাত শস্যের ক্ষতি ন্যূনতম ব্যয়ে উন্নত গোলা ব্যবহারের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব
বাঁশের তৈরি শস্যদানা গুদামের প্লাটফর্মে উপস্থাপন করা হয়, যেখানকার খুঁটি টিনের পাতা দিয়ে মুড়িয়ে প্রতিরোধক করা হয় যাতে ইঁদুর মাটি হতে গুদামটিতে আরোহণ করতে না পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শস্যদানা গুদামটির ওপরের অংশ অবশ্যই সঠিক টেকসই আবরণ দ্বারা বন্ধ বা ঢেকে রাখতে হবে যাতে ঘরের দেয়াল অথবা ফাঁদ হতে ইঁদুর লাফ দিয়ে অথবা আরোহণ করতে না পারে এমন প্রতিরোধক সম্পন্ন করতে হবে। টিনের পাত অথবা অন্য ধাতব পদার্থ দ্বারা বিদ্যমান গুদাম কাঠামোটির উপরি অংশ ভালোভাবে কুড়িয়ে দিতে হবে। পাশে ঝুলে থাকা প্রান্ত ইঁদুরকে আরোহণ বা উঠতে বিরত রাখবে। ঊইজগ প্রকল্প এলাকার গ্রামে কয়েকটি বাড়িতে কৃষক দ্বারা প্রদর্শন করে ইঁদুর দ্বারা গোলাজাত শস্যের ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
খড়ের গাদার ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি রোধ
খড়ের গাদা ইঁদুরের অন্যতম বাসস্থান, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। খড়ের গাদার নিচে গর্ত খুড়ে ও কেটেকুটে ১০-২০% খড় নষ্ট করে থাকে। এ খড় পশুকে খাওয়ালে ইঁদুরবাহিত রোগ দ্বারা পশু আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খড়ের গাদা করার সময় মাচা বা মঞ্চ করে রাখলে ইঁদুরের ক্ষতি হতে খড়কে রক্ষা করা সম্ভব। এতে খড়ও ভালো থাকবে। সাধারণত ৬০-৭৫ সেন্টিমিটার উঁচু মাচা তৈরি করে খড়ের গাদা তৈরি করলে এবং মাচার নিচের অংশ সব সময় পরিষ্কার রাখলে ইঁদুরের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যায়।
গ্লুবোর্ড দ্বারা ইঁদুর দমন
বাজারে মুদির দোকানে ইঁদুর মারার তৈরি গ্লুবোর্ড পাওয়া যায়। ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় পেতে রাখলে ইঁদুর আঠায় আটকা পড়ে, যেতে পারে না। ইঁদুর আটকা পড়ার পর যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি তুলে মেরে ফেলতে হবে। কারণ দেরি হলে, অন্যান্য ইঁদুরা দেখে ফেল্লে ঐ বোর্ডের নিকট যাবে না। তাই একটা ইঁদুর ধরা পরার পর বোর্ডটি অন্যত্র বা একটু দূরে রাখতে হবে।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
১. গ্যাস বড়ি দ্বারা ইঁদুর দমন
রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, মহাসড়ক, খালের পাড়ে, সেচের নালায় গর্তের ইঁদুর গ্যাস বড়ি (ফসটোক্সিন ট্যাবলেট) দ্বারা কার্যকরভাবে দমন করা যায়। বর্ষার সময় মাঠের ইঁদুর এ সকল স্থানে গর্ত করে অবস্থান করে। প্রতি নতুন গর্তে একটি গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করতে হবে। এর পর সকল গর্তের মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। ইঁদুর গর্তের ভিতর হতে বের হলেও মারা যাবে। ইঁদুর নিধন অভিযানের সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে গর্তের ইঁদুর নিধনের ডেমনস্ট্রেশন করতে পারে। ফসলের মাঠে বা যেকোনো স্থানের গর্তের ইদুর গ্যাস বড়ি দ্বারা দমন করা সহজ ও কার্যকর। গ্যাস বড়ি দ্বারা ৯০-৯৫% গর্তের ইঁদুর নিধন করা যায়।
২. বিষটোপ দ্বারা ইঁদুর দমন
কোনো স্থানে বিষটোপ দ্বারা ৬০-৭০% এর বেশি ইঁদুর মারা যায় না। সঠিক মাত্রার বিষটোপ সঠিক স্থানে ও সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এক গ্রাম বা পাড়ায় সকলে মিলে একদিন বিষ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আবার সমস্ত মাঠে একত্রে বিষটোপ প্রয়োগ করলে দমন ব্যবস্থা কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিষটোপ প্রয়োগের সাবধানতার নিয়মগুলো অনুসরণ করতে হবে।
জীব দ্বারা ইঁদুর দমন
বাড়িতে বিড়াল পালন করলে ইঁদুরের উপদ্রব কম থাকবে। বনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ইঁদুর ভোজী প্রাণীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যেমন- বনবিড়াল, শিয়াল, বেজি, পেঁচা, সাপ ইত্যাদি প্রাণী। এদের যত্রতত্র নিধন করা হতে বিরত থাকতে হবে। বটবৃক্ষ ও বড় বড় গাছে পেঁচা বাস করে। কোনো স্থানে কয়েকটি পেঁচা থাকলে ইঁদুরের উপদ্রব কম থাকবে। কারণ একটি পেঁচা রাতে ৫-১০টি ইঁদুর মারতে পারে। পেঁচার পপুলেশন বাড়ানোর জন্য গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। বটবৃক্ষ যাতে কেটে না ফেলে সেদিকে নজর দিতে হবে। বটবৃক্ষ রোপণের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। এতে পরিবেশ ভালো থাকবে।
উপসংহার : ইঁদুর একটি সামাজিক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সামাজিকভাবেই করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা সরকারের পক্ষে স্থায়ীভাবে সমাধান করা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাই ঊইজগ প্রকল্পের প্রশিক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা মডেল সব জেলায় গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে গ্রামবাসীরা দলীয়ভাবে ইঁদুর নিধনে উদ্বুদ্ধ হবেন। কৃষকদের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুরবাহিত রোগ জীবাণু রোধ, পরিবেশের দূষণ কমানো এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। ইঁদুর দমন প্রযুক্তি উন্নয়নের আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ইঁদুর দমন প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, কারণ ইঁদুর দমন প্রযুক্তি অন্যান্য বালাই ব্যবস্থাপনা হতে সম্পূর্ণ বিভন্ন রকমের। ইঁদুর দমন অভিযান বা কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।
ড. সন্তোষ কুমার সরকার