Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টি চাহিদা পূরণে বাংলাদেশে অপ্রচলিত ফল

খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোনো খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায়, কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি পূরণ হলেও পুষ্টি সমস্যা অনেক বড় আকারে বিরাজিত রয়েছে। ফলে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পুষ্টিহীনতার কারণে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে অহরহ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মা ও শিশুরাই এর শিকার বেশি। পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকাংশ ফলই সুস্বাদু, পুষ্টিকর, মুখরোচক এবং তৃপ্তিদায়ক। অতি জরুরি খাবারের অভাব কেবল দানাদার খাদ্য দিয়ে পূরণ হয় না। পুষ্টিকর খাবারের ওপর নির্ভরও করছে আমাদের জীবনের অস্তিত্ব, কর্মক্ষমতা, মেধাবৃদ্ধি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি। পুষ্টি সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমরা মোটেও সজাগ নই। ফলে যারা পেট ভরে দুইবেলা খেতে পায় না তারাই যে শুধু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তা নয়; সে সঙ্গে ধনীরাও অপুষ্টির শিকার থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না।


ফল বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ও উপকারী উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল। রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় আমাদের দেশীয় ফলসমূহ খুবই অর্থবহ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। ফলে সব ধরনের খাদ্যোপাদানই পাওয়া যায়। মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থেরও অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে দেশীয় ফল। বিভিন্ন ধরনের খাবারের মধ্যে ভিটামিন ও মিনারেলকে রোগ প্রতিরোধ খাদ্য উপাদান হিসেবে ধরা হয়। এ ধরনের পুষ্টি উপাদান তথা হরেক রকম ফল ভক্ষণে রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও হজম, পরিপাক, বিপাক, রুচি, বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফল আমরা কাঁচা বা পাকা অবস্থায় সরাসরি খেয়ে থাকি। ফল রান্না ব্যতীত সরাসরি খাওয়া সম্ভব বিধায় এতে বিদ্যমান সবটুকু পুষ্টি পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধকারী উপাদান অ্যান্থোসায়ানিন, লাইকোপেন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপস্থিত থাকায় মরণনাশক রোগব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
সুষম খাদ্য বিবেচনায় এনে আমরা মূলত ৬ ধরনের খাবার প্রতিদিন আহার করে থাকি। এগুলো হলো (১) শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট (২) আমিষ বা প্রোটিন (৩)
স্নেহ বা তেল/চর্বি এবং (৪) ভিটামিনস (৫) খনিজ লবণ (মিনারেলস) ও পানি। ফলে সব ধরনের খাদ্যোপাদানই পাওয়া যায়। তবে ভিটামিন ও খনিজ লবণের পরিমাণ খুব বেশি। এ ছাড়া ফল থেকে পাওয়া স্বেতসার, প্রোটিন ও স্নেহ জাতীয় উপাদানগুলো সহজেই হজম করা যায়।


ফল বলতে আমরা নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বককেই বুঝি। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারকেল, লেবু ও কুল- এ ১০টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। কেননা, চোখের সামনে এদের প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অপ্রচলিত শব্দটির অর্থ হচ্ছে যার প্রচলন নেই অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনে-জঙ্গলে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায়  বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এদেরকে পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক-প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিয়ামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণ রাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না বলে এরা অপ্রচলিত।


আবার কিছু কিছু ফল আছে যেগুলোর স্বাদ অনেকের কাছে ভালো লাগে আবার অনেকের কাছে ভালো লাগে নাÑ যেমন ডেউয়া। কলা বা আমের মতো সর্বজনীন আবেদন নিয়ে টেবিলে আসতে পারছে না বলে এরা অচ্ছুত হয়ে পড়েছে। তাই এরা অপ্রচলিত।


প্রাপ্যতার নিরিখে বিচার করেও কিন্তু ফলের প্রচলনের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। যদি যথেষ্ট পাওয়া যেত, তা হলে মানুষ হয়তো খেতেও পারত প্রচুর আর তখনই কোন একটা ফল তার অপ্রচলিয়তার গ্ল­ানি মুছে ফেলে প্রচলিত ফলের কোঠায় উঠে এসে কৌলিন্য লাভে সক্ষম হতো। এমনটা হয়েছে কুলে ও পেয়ারার ক্ষেত্রে। এ ফলগুলো ১০ বছর আগেও ব্যাপক হারে আবাদ হতো না। কিন্তু নিকট অতীতে, ভালো কিছু জাত এসেছে বলে (যেমন আপেল কুল, বাউকুল, কাজী পেয়ারা, বাউ-৫ পেয়ারা, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। এগুলো কৌলিন্যের বিভা পেতে শুরু করেছে। এখন এদের পরিকল্পিত চাষ হচ্ছে। বাগান হচ্ছে, যত্ন আত্তি করা হচ্ছে-অধিক পরিমাণে বাজারে আসছে, বড় বড় মানুষের রসনা তৃপ্ত করতে সক্ষম  হচ্ছে। আর অপ্রচলিত থেকে প্রচলিত হওয়ার পথ পেয়েছে। লটকন এ ধরনের ফলের একটি উদাহরণ। চালতা, করমচা, লুকলুকি, ফলসা ও তেঁতুলের মতো ফলগুলো কিন্তু সবারই পরিচিত। কিন্তু টক বলেই বোধ হয় এদের চাহিদা বাড়ছে না, আর তাই অপ্রচলিত। এ ছাড়া আরো কিছু অপ্রচলিত ফল যেমন- টাকিটুকি, পানকি, চুনকি, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি।


অপ্রচলিত ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল এক রকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো জন্মে। সাধারণত এসব ফলের গাছে তেমন কোনো সার দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড়-বাতাস কিংবা বন্যা খরাতেও এ ফলের গাছকে মারতে পারে না। এই ফলের ব্যাপকভাবে খাপখাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ওয়াইড অ্যাডাপ্টিবিলিটি, কিন্তু অনেক বিদেশি ফলেরই নেই। এ ফলের আর একটা সুবিধে হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফল গাছের মতো এসব ফল বা ফল গাছে অত বেশি রোগ-পোকারও আক্রমণ হয় না। তবে এ ফলে সবচেয়ে বেশি মেলে পুষ্টি। এ ফলের মতো এত বেশি পুষ্টি কখনো বিদেশি ফলে মেলে না। একটা ছোট্ট আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা পাঁচটা বড় কমলাতে পাওয়া যাবে না। এমনকি কোনো কোনো অপ্রচলিত ফল ফলনের দিক দিয়ে প্রচলিত অনেক ফলের চেয়ে ভালো। ডেউয়া, কদবেল, আমলকী অনেকেই খেতে চায় না। কিন্তু এর মধ্যে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা আপেল, কমলা বা আম, কাঁঠাল থেকে পাওয়া যাবে না। অপ্রচলিত ফলের অধিকাংশই সাধারণত টক স্বাদের। তাই এসব ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। আর এ ভিটামিনটি দেহে জমা রাখার কোনো নিয়ম নেই। তাই প্রতিদিনের ভিটামিন সি প্রতিদিনই কাঁচা ফল খেয়ে সংগ্রহ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অপ্রচলিত ফল, এর যোগান বেশ ভালোভাবেই দিতে পারে। কাঁঠালের চেয়ে ডেউয়ার মধ্যে আমিষের সাথে মিলছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। অন্যান্য পুষ্টি তো আছেই। সেই সাথে আছে এসব ফলের বিভিন্ন রোগ সারানোর অদ্ভুত ক্ষমতা। আমলকী, হরীতকী, বহেড়ার মতো কবিরাজি ফল প্রচলিত কোন ফলের মধ্যে কি আছে? তাছাড়া আমাদের দেশে কলা, কুল, নারিকেল ছাড়া প্রায় সব ফলই জন্মে গ্রীষ্ম -বর্ষায়। কিন্তু  অপ্রচলিত অনেক ফল আছে যেগুলো অন্য মৌসুমেও জন্মে। তাই সারা বছর ধরেই বলতে গেলে ফল খাওয়ার একটা সুবিধে মেলে। শুধু পুষ্টি বা প্রাপ্যতার দিক দিয়ে নয়, এখন অনেক অপ্রচলিত ফলের দাম বিদেশি ফলের চেয়ে কম নয়। এজন্য একদিকে প্রধান ফলের চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে হবে এ কথা যেমন সত্য তেমনি আমাদের বৈচিত্র্যময় ফলের ভাণ্ডারকেও ধরে রাখতে হবে। এটাও লক্ষ রাখতে হবে, আজকের একটি অপ্রচলিত ফল আবার আগামী দিনের প্রচলিত ফল হিসেবে গণ্য হয়ে উঠতে পারে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য জনপ্রতি প্রতিদিন গড়ে ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন হলেও বর্তমানে এ দেশের মানুষ দৈনিক মাত্র ৭৬ গ্রাম ফল খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির এ ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই খাদ্য পুষ্টি চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর আমাদের অপ্রচলিত ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর যৌক্তিকভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে বাড়িয়ে তুলতে হবে।


এজন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহকে বিবেচনা করা যেতে পারে-


অপ্রচলিত ফলের জার্মপ্ল­াজম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মূল্যায়ন ও সম্প্রসারণ করা।
প্রচলিত চাষব্যবস্থা পরিবর্তন করে পরিকল্পনা মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্দিষ্ট ফলের জন্য নির্দিষ্ট উৎপাদন এলাকা গড়ে তুলতে হবে। যেমন- বরিশালে আমড়া, সাতক্ষীরায় ক্ষীরনী, সিলেটে লেবু, বাগেরহাটে কাউফল ইত্যাদি। সেসব অঞ্চলেই এসব ফলভিত্তিক শিল্প কারখানা ও প্রক্রিয়াজতকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। বিদ্যমান শিল্পকারখানাগুলোর আধুনিকীরণ করতে হবে। অপ্রচলিত ফলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম* ড. মো: শামছুল আলম মিঠু**

*পরিচালক, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১১৮৫৪৪৭১; **ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যান তত্ত্ব বিভাগ, বিনা, ময়মনসিংহ। মোবাইল : ০১৭১১১২৪৭২২