Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২ এর মূল লক্ষ্য

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২ এর মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট

জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করে ক্ষুধা থেকে মুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত এমডিজির রোল মডেল বাংলাদেশের বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জনের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদেশের মানুষের জন্য সারা বছর নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি সর্বোচ্চ ফলনের জন্য লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ভূমিকা রাখছে।

 

বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২৬ শতাংশ অব্যাহত থাকলে এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ভিশন-২০৩০, বিএআরসি ২০১২ এর প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০৩০ সালে  আমাদের প্রয়োজন হবে ধান ৩৯.৮০ মিলিয়ন টন, গম ৩.৮৫ মিলিয়ন টন, ভুট্টা ৪.০০ মিলিয়ন টন, ডাল জাতীয় শস্য ৩.৫০ মিলিয়ন টন, তৈল জাতীয় শস্য ১.৭০ মিলিয়ন টন, আলু ৫.২৫ মিলিয়ন টন, শাকসবজি ১৩.৯৮ মিলিয়ন টন এবং ফল ৬.২৪ মিলিয়ন টন। সুতরাং এসডিজি- এর লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে হলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের সর্ববৃহৎ বহুবিদ ফসল গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দেশের সার্বিক কৃষি উন্নয়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা অর্জন, কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রকার দানা জাতীয় ফসল, কন্দাল ফসল, ডাল ফসল, তেল ফসল, মসলা ফসল, সবজি, ফল, ফুল এবং সামুদ্রিক শৈবালসহ ২০৮টি ফসলের উপর গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ প্রতিষ্ঠান এসব ফসলের খরা, লবণাক্ততা প্রতিরোধী, স¦ল্প দৈর্ঘ্যরে বায়োফর্টিফাইড উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, ফসল ব্যবস্থাপনা, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগ-বালাই প্রতিরোধী জাত ও ব্যবস্থাপনা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, এলাকা ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন, হাইড্রোপনিক পদ্ধতি, সমনি¦ত খামার পদ্ধতি উন্নয়ন, পাহাড়ি অঞ্চলে ফসল উৎপাদন এবং সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ইত্যাদি বিষয়ের  উপর লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তার সম্প্রসারণকর্মী, কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট এনজিও কর্মী এবং কৃষকের নিকট হস্তান্তরের জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন  করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত গম, ভুট্টা, আলু, ডাল ও তেলবীজ, শাক-সবজি, ফল, ফুল ও মসলাসহ বিভিন্ন ফসলের ৫৩১টি উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং ৫০৫টি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।


উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল উন্নত জাত : উচ্চফলনশীল গমের জাত এবং অন্যান্য উৎপাদন প্রযুক্তিসমূহ উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে গম উৎপাদন ও বিশেষভাবে ফলন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিএআরআই কর্তৃক এ পর্যন্ত ৩৩টি উন্নত গমের জাত এবং ২টি ট্রিটিকেলি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪.২৮৮ লক্ষ হেক্টর থেকে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১৪.২৩৬ লক্ষ টন গম এবং গড়ে হেক্টরপ্রতি ফলন রেকর্ড হয়েছে ৩.৩২ টন। গত ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গমের হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ২৩৮% বৃদ্ধি পেয়েছে যা একটি মাইলফলক। এ অর্জনের মূল কারণ হলো গমের উচ্চফলনশীল রোগ প্রতিরোধী ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ। বর্তমানে দেশে যে গম আবাদ হয় তার প্রায় ১০০% বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত। এ পর্যন্ত ১৫টি হাইব্রিড ভুট্টা এবং ৯টি মুক্ত পরাগায়িত ভুট্টার জাত অবমুক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে একটি খৈ ভুট্টা, একটি মিষ্টি ভুট্টা ও একটি বেবিকর্নের জাতও রয়েছে। এ ছাড়াও বার্লির ৭টি, কাউনের ৩টি অবমুক্ত করা হয়েছে। বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল আলুর জাত কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের ফলে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ আলু চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা পূরণ করেও  প্রচুর পরিমাণে আলু বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৫.২৮৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১১৩.৩২৭ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়  চাষাবাদের দিক থেকে বাংলাদেশে ধান ও গমের  পরেই আলুর অবস্থান।


দেশকে তেল ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য বিএআরআই ৮টি গুরুত্বপূর্ণ তেল ফসলের উপর গবেষণা করে উচ্চফলনশীল সরিষার ১৮টি, চীনাবাদামের ১১টি, তিলের ৪টি,  সয়াবিনের ৬টি, সূর্যমুখীর ২টি, তিসি, গর্জন তিল এবং কুসুম ফুলের ১টিসহ তৈলবীজ জাতের সর্বমোট ৪৪টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। বর্তমানে স¦ল্পমেয়াদি বারি সরিষা-১৪,বারি সরিষা-১৫ বোরো ধান-রোপা আমন ধান শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করে সরিষার উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি স্বল্পতা দূর করতে, মাটির হারানো উর্বরা শক্তি ফিরে পেতে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে, সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ডালের আবাদ বৃদ্ধি বর্তমান সময়ের অপরিহার্য দাবি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী সুষম খাদ্য তালিকায় একজন মানুষের জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম ৪৫ গ্রাম ডালের প্রয়োজন। কিন্তু দেশে উৎপাদিত ডাল থেকে জন প্রতি প্রতিদিন মাত্র ১৭ গ্রাম ডালের সংস্থান হয়। সুতরাং ডালের এই ঘাটতি পূরণে উচ্চফলনশীল জাত ও আধুনিক উৎপাদন কৌশলের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিএআরআই উদ্ভাবিত জাতসমূহ উচ্চফলনশীল যার ফলন স্থানীয় জাতের প্রায় দ্বিগুণ। অতএব স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উন্নত জাতের চাষাবাদের মাধ্যমেই ডালের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব। স¦ল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল বারি মুগ-৬ ইতিমধ্যে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং মাঠ পর্যায়ে ডাল ফসলের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।


সবজির ঘাটতি পূরণের জন্য বিএআরআই এ পর্যন্ত ৩৪টি সবজির ১০৭টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যার অনেকগুলোর মধ্যে রোগ, পোকামাকড়, লবণাক্ততা, উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যে কারণে বিভিন্ন সবজি ফসলের আবাদযোগ্য জমি ও সার্বিক উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া তাপসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের ফলে অনেক সবজি সারা বছরই চাষ করা সম্ভবপর হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বেশ কয়েকটি হাইব্রিড জাত টমেটো চাষে এক নীরব বিপ্লব সংঘটিত করেছে। বিএআরআই এ যাবৎ ২৮টি টমেটোর উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে ১১টি হাইব্রিড জাত রয়েছে। সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বারি টমেটো-১৬, ১৭ এবং বারি টমেটো-৮ ও ৯ অন্যতম। বারি হাইব্রিড টমেটো-৪ ও ৮ গ্রীষ্মকালীন জাত হিসেবে সারা দেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বারি টমেটো-১৫ হলুদ পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী এবং বারি টমেটো-১৬ ও ১৭ উচ্চ সংরক্ষণশীল জাত হিসেবে পরিচিত। বিএআরআই এ পর্যন্ত ১২টি বেগুনের জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে ৪টি হাইব্রিড জাত রয়েছে। এদের মধ্যে বারি বেগুন-৮ ও ১০ উচ্চফলনশীল জাত ও ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধী। জীব প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিএআরআই উদ্ভাবিত বিটি বেগুনের ৪টি জাত ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী। আগাম জাত বারি ব্রোকলি-১ রোপণের ৭৫ দিনের মধ্যে সংগ্রহ উপযোগী। বারি লাউ-৪ সারা বছরব্যাপী চাষ করা যায় ও লাভজনক হিসাবে কৃষকদের নিকট ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বারি শিম-৭একটি গ্রীষ্মকালীন জাত যা উচ্চ তাপমাত্রায় ফল ধারণে সক্ষম। বারি কামরাঙ্গা শিম-১ জাতটি পুষ্টিকর ও উন্নতমানের খনিজ সমৃদ্ধ। বারি ঝিঙ্গা-২ সারা দেশে গ্রীষ্মকালে চাষোপযোগী রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল জাত। বারি ঢেঁড়শ-২ হলুদ পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস প্রতিরোধী।


বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ৩২টি ফল ফসলের ৭৯টি জাত উদ্ভাবন করেছে। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ফল ফসল উৎপাদনের হার দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলসহ অনেক অনাবাদি জমিতে বিএআরআই উদ্ভাবিত জাতসমূহ দিয়ে ফল বাগান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে বছরব্যাপী দেশীয় ফলের সহজলভ্যতা বাড়ছে। বিশেষ করে সারা দেশে বারি মাল্টা-১ ও বারি পেয়ারা-২ এর চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি বারি আম-১১ (বারমাসী) এর উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের ফলে বছরের অধিকাংশ সময়ে আমের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বারি আম-৪ (হাইব্রিড) একটি নাবী ও সুস্বাদু জাত হিসেবে ইতিমধ্যে সারা দেশে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।


বিএআরআই এর মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৫টি ফসলের ৩৫টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়েছে। বারি রসুন-২ জাতটি চলনবিল এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বারি রসুন-৩ ও ৪ বড় আকারের ও বড় কোয়াযুক্ত যা ভোক্তা ও কৃষকদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। বারি আদা-২ ও ৩ উচ্চফলনশীল ও উন্নত মানের। বারি আলুবোখারা-১ মসলা, আচার ও চাটনিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি আকর্ষণীয় লাল রঙের, টক মিষ্টি স্বাদের, রসালো এবং এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। বারি দারুচিনি-১ জাতটি গুণেমানে ভালো এবং আমদানি করা সেরা দারুচিনির মতোই ঝাঁঝ, মিষ্টতা ও সুগন্ধিযুক্ত। বারি পাতা পেঁয়াজ-১ চাষে সারা বছর পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।


উৎপাদন প্রযুক্তি : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উন্নত ফসল বিন্যাস, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, উন্নত সংরক্ষণ পদ্ধতি, সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাসহ ৫০৫টি লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। চার ফসল ভিত্তিক ৩টি কার্যকরী ফসল ধারা যেমন রোপা আমন - সরিষা - বোরো - রোপা আউশ, রোপা আমন - আলু - বোরো - রোপা আউশ এবং রোপা আমন -  সরিষা - মুগ - রোপা আউশ উদ্ভাবনের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা ১৯১% থেকে ৪০০% পর্যন্ত উন্নীতকরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।


বারি উদ্ভাবিত আইপিএম পদ্ধতিতে সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ যৌথভাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সবজি যেমন- টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, কচু, ঢেঁড়শ, শিম ইত্যাদি এবং আম, পেঁয়ারা, কমলা, ডালিম ইত্যাদি ফলের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে তেমনি প্রযুক্তিসমূহ স্বল্প ব্যয়সম্পন্ন হওয়ায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। কোন ধরনের কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয় না বলে উদ্ভাবিত আইপিএম পদ্ধতিসূমহ পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যগত সমস্যামুক্ত।


শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো এবং বেগুন, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, তরমুজ, পেঁপে, পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি ফসলের জন্য উদ্ভাবিত ফার্টিগেশন ও স্প্রিংলার সেচ প্রযুক্তি বাণিজ্যিক কৃষকগণের নিকট সমাদৃত হয়েছে।
বিএআরআই উদ্ভাবিত মাটি ব্যবস্থাপনা ও মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ প্রযুক্তিসমূহ কৃষকের মাঠে ফলন বৃদ্ধিতে সফল ভূমিকা রাখছে। জৈব আর্বজনা থেকে ভার্মিকম্পোস্ট  বা কেঁচোসার  উৎপাদন কলাকৌশল, ফসল উৎপাদনে বায়োস্লারির ব্যবহার, ভুট্টার দানা গঠনে চুন ও বোরন সারের প্রভাব, সরিষা ফসলে বোরনের প্রভাব, ঝাড়শিম উৎপাদনে রাইজোবিয়াম অণুজীব সার, চীনাবাদাম উৎপাদনে রাইজোবিয়াম অণুজীব সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি।


কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতা, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের কথা বিবেচনা করে ৩৮ ধরনের উন্নত এবং লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েক ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি, যেমন বীজ বপন যন্ত্র, আলু উত্তোলন যন্ত্র, ধান ও গম কর্তন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও বারি উদ্ভাবিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, শুকনা জমি নিড়ানি যন্ত্র, শস্য ঝাড়াই যন্ত্র, আলু রোপণ যন্ত্র, আলু উত্তোলন যন্ত্র, আলু গ্রেডিং যন্ত্র, আম পাড়া যন্ত্র, আম শোধন যন্ত্র, গাজর বা মূল জাতীয় ফসল ধৌতকরণ যন্ত্র ইত্যাদি কৃষক পর্যায়ে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। শস্য সংগ্রহোত্তর বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের মূল্য ও পুষ্টিমান সংযোজন করে উদ্যোক্তা তৈরি ও বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখা হচ্ছে।


সামুদ্রিক শৈবাল : বিশ্বের বহুদেশে সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল উপকূলীয় এলাকা। বাংলাদেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার যেখানে ২৫০০০ বর্গ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা বিস্তৃত। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যেখানে প্রাকৃতিকভাবে  প্রচুর শৈবাল জন্ম নিয়ে থাকে। বিএআরআই অগভীর সামুদ্রিক উপকূলীয় এলাকায় শৈবাল গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়ে ইতোমধ্যে চাষ উপযোগী কয়েকটি শৈবাল চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিরূপণে অগাদ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।


প্রতিকূল আবহাওয়ায় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণ : বিএআরআই প্রতিকূল আবহাওয়া যেমনÑ লবণাক্ততা, খরা, উষ্ণতা, জলমগ্নতা প্রভৃতি পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করণে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ফসলের বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে। প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিরোধী জাতের মধ্যে বারি গম-২৫ তাপ ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারি গম-২৬ তাপ সহিষ্ণু, বারি গম-২৮ এবং বারি গম-৩০ স্বল্প মেয়াদি ও তাপ সহিষ্ণু, বারি গম-৩৩ ব্লাস্টরোগ প্রতিরোধী, বারি আলু-২৮ লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারি সরিষা-১১ খরা সহিষ্ণু, বারি সরিষা-১৬ খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারি তিল-৪ খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারিছোলা-৯ খরা সহিষ্ণু, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ খরা সহনশীল, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫ তাপ সহনশীল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।


অত্র প্রতিষ্ঠানের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন ফসলের জাতসমূহের মধ্যে গমের ক্ষেত্রে ১০০%, আলুর ক্ষেত্রে ৮৬%, সরিষায় ৯০.৪%, চীনাবাদামে ৫২.০%, তিলের ক্ষেত্রে ৬৫.০৯%, সয়াবিনে ১০০%, মসুরে ৮৭.৫৫%, মুগবিনে ৯৭.৮২%, মাসকালাইয়ে ৪৭.৫৭% এবং ছোলার ক্ষেত্রে ৭১.৯৫% কৃষক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতসমূহ ব্যবহার করছে এবং দেশের মাঠ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের গবেষণা ক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতায় ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত বিএআরআই বিভিন্ন ফসলের ২২২টি হাইব্রিডসহ উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং ২৫০টি উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিভিন্ন ফসলের মধ্যে গমের ৯টি, ভুট্টার ৬টি, আলুর ৫০টি, ডালের ১৪টি, তৈলবীজ ফসলের ৬টি, শাকসবজির ৪৫টি ও ফলের ৪০টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের ফলে ফলন ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভিন্ন ফসলের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের মাধ্যমে অনাহার বা ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার পথকে নিশ্চিত করে চলেছে।

 

ড. আবুল কালাম আযাদ


মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৪১৭৯০৪৮