Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষকের ব্যয় সাশ্রয় বারি আলু যন্ত্র

আলু বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিকাশে বিশেষ ভ‚মিকা রাখছে। বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু আলু উৎপাদনের উপযোগী। বাংলাদেশে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, আর কমছে কৃষি জমি। অল্প জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন। এর জন্য ভালো বীজ, সার, সেচ ও বালাই ব্যবস্থাপনাই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি প্রয়োজন উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি। ইদানীং কৃষিতে নানা কারণে প্রয়োজনীয় সংখক শ্রমিকের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে । সেজন্য     কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।


আলু শীতকালীন ও স্বল্পমেয়াদি ফসল। অল্প সময়ের মধ্যে আলু রোপণ করতে হয়। প্রচলিত পদ্ধতি ধিরগতি সম্পন্ন, ব্যয় বহুল ও অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে যে, জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন বাড়ে। তাই জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং বাংলাদেশের কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে এফএমপিই (ফার্মমেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভস্টে প্রসসে ইঞ্জনিয়িারং) বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আলুসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে কয়েকটি লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেহেতু দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও ডিজেল ইঞ্জিন এবং পাওয়ার টিলার (১২-১৬ অশ্বশক্তি) পাওয়া যায়, সেহেতু আলু চাষের  যন্ত্রপাতিগুলো  পাওয়ার টিলারের ইঞ্জিনকে কাজে লাগিয়ে ব্যবহার করা যায়। এতে একদিকে পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহার বাড়বে, অন্যদিকে কৃষকগণ অল্প খরচে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবেন। কৃষিতে নিয়জিত শ্রমিক সংখ্যা দিন দিন কমছে। সমীক্ষায় দেখা যায় ২০০২ সালে কৃষিতে ৫১.৭% শ্রমিক নিয়োজিত ছিল তা কমে ২০১৭ সালে ৪০.২% নেমে এসেছে (বিবিএস, ২০১৭)।


আলু বাংলাদেশের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য শস্য। বিগত বছরগুলোতে আলুর ব্যাপক ফলন হয়েছে যা দেশের চাহিদার চেয়েও বেশি। বর্তমানে আলুর উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর প্রায় এক কোটি তিন লক্ষ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে যা দেশের চাহিদার তুলনায় ৩৩ লক্ষ টন উদ্বৃত্ত। কিন্তু মৌসুমে দাম কম থাকায় কৃষকরা লাভের মুখ দেখেতে পারেনি। এর অন্য আরেকটি কারণ হলো যে, আলু চাষে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হয়। আমাদের দেশে আলু চাষের জন্য জমি তৈরির কাজটি পাওয়ার টিলার দিয়ে দিলেও অন্যান্য কাজ যেমন: লাইন করা, একটি একটি করে বীজ নির্দিষ্ট দূরত্বে ফেলা, আলুকে ঢেকে দেয়া, বেড তৈরি করার কাজগুলো হাতের সাহায্যেই করা হয়ে থাকে। শ্রমিকের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ও শহরমুখী নানাবিধ পেশার দিকে ঝুকে পড়ায় মৌসুমের সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা  যেমন কঠিন হয়ে পড়ছে তেমনি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আলু চাষে কৃষকের কষ্ট কমাতে শ্রমিক সাশ্রয় করতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ হতে পাওয়ার টিলার চালিত আলু রোপণ যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।


পাওয়ার টিলার চালিত এ যন্ত্র একবারেই লাইন তৈরি করে, নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ দেয়, আলু ঢেকে দেয় ও বেড তৈরি করে। এ যন্ত্রটি ৬০ সে.মি. চওড়া বেড তৈরি করে যার উচ্চতা হয় ১২-১৪ সে.মি.। যন্ত্রটিতে ২০টি ব্লেড বা ফাল থাকে যা একবিশেষ পদ্ধতিতে সাজানো হয় ফলে মাটি দুই পাশ থেকে মাঝের দিকে যায়। দুইটি ডিস্ক দুই পাশ থেকে মাটিকে আরো গুছিয়ে আনে ও পেছনের বেড শেপার মাটিকে চাপ দিয়ে সুন্দর বেড তৈরি করে দেয়। যন্ত্রের মাঝ বরাবর একটি ফারো ওপেনার আছে যা উঁচুনিচু করে বীজ গভীরতা কম বেশি করা যায়। বীজ হপারে ২৮-৪০ মিমি সাইজের আলু বীজ বা বড়বীজ কে কেটে কাক্সিক্ষত আকার করে ঢেলে দেয়া হয়। কাপ পদ্ধতির মিটারিং ডিভাইস দ্বারা একটি একটি বীজ ২৩-২৫ সেমি দূরত্বে পড়তে থাকে। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বীজ কাপগুলো প্রয়োজনের বীজের আকারের ভিন্নতার অনুসারে পরিবর্তন করে নেয়া যায়। এক হেক্টর জমির আলু যেখানে হাতে লাগাতে ৬৭ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় সেখানে যন্ত্রদ্বারা আলু লাগতে মাত্র ৪ জন শ্রমিক লাগে। হাতে আলু লাগালে হেক্টরে খরচ হয় ১৬৯০০ টাকা কিন্তু বারি আলু রোপণ যন্ত্র দিয়ে আলু লাগাতে খরচ হয় হেক্টরে মাত্র ৪৮০০ টাকা। বারি আলু রোপণ যন্ত্র ব্যবহারে ৯৭% শ্রমিক ও ৬৭% আলু রোপণ খরচ কমানো যায়। যে কৃষকের পাওয়ার টিলার রয়েছে তিনি আর মাত্র ৫৫০০০ টাকা দিয়ে যন্ত্রটি কিনে ব্যবহার করতে পারবে। যন্ত্র চালাতে ঘণ্টায় মাত্র ১.৫ থেকে ২ লিটার ডিজেল লাগে। যন্ত্রটির দ্বারা এক বিঘা জমিতে আলু  রোপণ করতে ১-১.৫ ঘণ্টা সময় লাগে। একজন চালক ও বীজ সরবরাহের জন্য একজন সহকারী দ্বারা যন্ত্রটি দিনে ৬-৮ বিঘা জমিতে আলু বীজ রোপণ করতে পারে।


এছাড়া বারি উদ্ভাবিত আলু উত্তোলন যন্ত্রও রয়েছে যা অত্যন্ত শ্রমিক সাশ্রয়ী। পাওয়ার টিলার চালিত আলু উত্তোলন যন্ত্র মাটির নিচে থাকা সব আলুকে মাটির ওপরে এনে গুছিয়ে রাখে। ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে কোদাল দিয়ে আলুর বেড খুঁড়ে ও হাত দিয়ে আলুকে খুঁজে নিতে হয় না। প্রচলিত পদ্ধতিতে মাটির নিচে প্রায় ১০% আলু থেকে যায় কিন্তু যন্ত্র ব্যবহারে একবারেই ছোট-বড় সব আলু উঠে আসে। এক হেক্টর জমির আলু উঠাতে মাত্র ২১ জন শ্রমিক লাগে যেখানে হাতে উঠাতে ৫০জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। হাতে আলু উঠাতে হেক্টরে খরচ হয় ২২০০০ টাকা কিন্তু বারি আলু উত্তোলন যন্ত্র দিয়ে আলু উঠাতে খরচ হয় হেক্টরে মাত্র ১৩৫০০ টাকা। বারি আলু উত্তোলন যন্ত্র ব্যবহারে ৫৮% শ্রমিক ও ৩৯% আলু উত্তোলন খরচ কমানো যায়। যে কৃষকের পাওয়ার টিলার রয়েছে তিনি আর মাত্র ৪৫০০০ টাকা দিয়ে যন্ত্রটি কিনে ব্যবহার করতে পারবে। যন্ত্র চালাতে ঘণ্টায় মাত্র ১.০ থেকে ১.৫ লিটার ডিজেল লাগে। যন্ত্রটির দ্বারা এক বিঘা জমিতে   ১-১.৫ ঘণ্টা সময় লাগে।


বারি আলু রোপণ ও আলু উত্তোলন যন্ত্র রাজশাহী, পঞ্চগড়, গাজীপুর, বগুড়া, যশোর ও দেশের অন্যান্য এলাকার গবেষণা মাঠে ও কৃষক মাঠে ব্যবহার শুরু হয়েছে। কৃষি কাজে শ্রমিক ঘাটতি ও শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম খরচে তাদের আলু চাষসহ অন্যান্য কৃষি কাজ সম্পন্ন করতে পারছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তিভুক্ত যন্ত্র প্রস্তুতকারীরা ইতিমধ্যে এ যন্ত্রগুলো তৈরি ও বাজারজাতকরণ শুরু করেছে। ফলে এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আলু উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, দিনাজপুরে অবস্থিত প্রস্তুতকারকগণ উৎপাদন ও বিপণন করছেন। নতুন উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির মান যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য নমুনা দেয়ার সময় তাদের যন্ত্রপাতি প্রস্তুত সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং প্রস্তুতকালীন সময়ে বিজ্ঞানীগণ কারখানা পরিদর্শন করে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করেন। এর ফলে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের কাছে সহজলভ্য  হয়ে উঠেছে এবং এগুলোর চাহিদাও দিন দিন বেড়ে চলছে।

 

ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্মমেশিনারি এন্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট,
গাজীপুর-১৭০১, মোবা : ০১৭১২৬৩৫৫০৫, ই-মেইল : arshadulfmpe@gmail.com