Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জাতীয় ইদুর নিধন অভিযান ২০১৯

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। আমাদের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি   উন্নয়ন-কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ। সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য  মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-বন্যা, খরা, সিডর, আইলা ইত্যাদি এবং সেই সাথে ফসলের বালাই ও ইঁদুরের আক্রমণের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এ ছাড়াও কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।


ইঁদুর প্রাণীটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। এ প্রাণী প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের ক্ষতি করছে যেমন- মাঠের শস্য কেটেকুটে নষ্ট করে, খায় এবং গর্তে জমা করে। এরা যে কোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে। যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। অল্প বয়সে বাচ্চা দিতে পারে। ইঁদুরের বিচরণ ক্ষেত্র ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির শোবার ঘর, অফিস আদালত পর্যন্ত সর্বত্র। আর তাই এদের ক্ষতির দিকটি অনেক বিস্তৃত। এরা মাঠের ফসল, গুদামজাত শস্য, ফল, শাকসবজি, সংরক্ষিত বীজ, কাপড়-চোপড়, কাগজ, লেপ তোষক ইত্যাদি কাটাকুটি করে ক্ষতি করে। ২০১৩ সালের এক গবেষণা মতে এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তা নয়, এরা মানুষ ও পশু পাখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগ জীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। এরা যা খায় তার ৪-৫ গুণ নষ্ট করে। বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী দমন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী। ইঁদুরের উপরের ও নিচের চোয়ালের সামনের জোড়া দাঁত চোয়ালের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এবং এই জোড়া দাঁতের কোন রুট ক্যানেল না থাকায় সামনের কর্তন দাঁতগুলো অনবরত সারা জীবন বাড়তে থাকে। আর এই সদা বর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪১০০ টির মতো স্তন্যপায়ী প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০০ টির মত ইঁদুরের প্রজাতি। প্রজাতি ভেদে ইঁদুর ১৫-৪১ সেমি. লম্বা এবং ওজনে ১৫-৩২৬ গ্রাম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যে সকল প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর, বাতি বা সোলাই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতি করে থাকে, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য, ফলজাতীয় ফসল এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে, বাতি বা সোলাই ইঁদুর ঘরের বইপত্র, কাপড়-চোপড় এবং শস্যদানা নষ্ট করে থাকে, মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসলের ক্ষতি করে থাকে, মাঠের বড় কালো ইঁদুর বোনা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানাজাতীয় ফসল পাকার পর ফসলের ক্ষতি করে থাকে, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর ধান, গম ভুট্টার ক্ষতি করে থাকে এবং প্যাসিফিক ইঁদুর ফলদবৃক্ষ বিশেষ করে নারকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের ৫-৭ %, গম ফসল ৪-১২%, গোল আলু ৫-৭%, আনারস ৬-৯ % নষ্ট হয়। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে থাকে।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত পাঁচ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুফল এই অভিযানের ফলে রক্ষা পাওয়া আমন ফসলের পরিমাণ ছকে বর্ণিত হয়েছে।
সারাবিশে^ পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে।


ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৯ এর উদ্দেশ্য
*কৃষক, কিষানি, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান,  আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীগণের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
*ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্প কারখানা ও হাঁস-মুরগীর খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
*আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা।
*গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা।
*রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইঁদুর বাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।


অভিযানের সময় ও উদ্বোধন
১০ অক্টোবর ২০১৯ জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান উদ্বোধনের আয়োজন করা হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছেÑ ‘আসুন, সম্পদ ও ফসল রক্ষায় সম্মিলিতভাবে ইঁদুর নিধন করি।’ এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান, ২০১৯ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের  অঞ্চল,  জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করা হবে। গত বছরের অভিযানের কার্যাবলীর উপর ভিত্তি করে  বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চসংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অঞ্চল, জেলাপর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য/ চেয়ারম্যন, পার্বত্য জেলা পরিষদ/জেলা পরিষদ প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যন/ পৌরসভার চেয়ারম্যান/মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করা হয়। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য/ উপজেলা চেয়ারম্যান/ তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করা হয়।


ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান
মাসব্যাপী অভিযান বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। অঞ্চলে অতিরিক্ত পরিচালকগণ নিজ অঞ্চলের পুরস্কার  পাবারযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই বাছাইপূর্বক মনোনয়নের তালিকা সদর দপ্তরে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে সদর দপ্তরে প্রেরিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় ও অঞ্চল পর্যয়ের পুরস্কারের প্রার্থীদের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রদান করেন, যা কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। যারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়।


ইঁদুরের সমস্যা দীর্ঘদিনের, এ সমস্যা পূর্বে যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। ইঁদুর চালাক প্রাণী এবং এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যার কারণে ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সঠিক স্থানে ও সময়ে একযোগে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না (মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও গণচীনে নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট সময়ে এভাবে ইঁদুর নিধন করা হয়)। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিকসংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী     কৃষি কর্মকর্তা তার ব্লকের কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ কর্মসূচিতে  ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে পুস্তিকায় সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলোন ও জিংক  ফসফাইড গ্রুপের ইঁদুরনাশক (যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, রেটক্স, জিংক  ফসফাইড ইত্যাদি) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সম্প্রসারণকর্মীগণ এলাকার চাষি, ছাত্রছাত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে একযোগে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে এই কর্মসূচি সফল করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

কৃষিবিদ এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান

পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, ফোন : ৯১৩১২৯৫, ই-মেইল : dppw@dae.gov.bd