Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

নিরাপদ ফল পেতে করণীয়

কৃষিবিদ মোঃ আবদুল্লাহ-হিল-কাফি

খেজুর হলো পৃথিবীর প্রথম চাষকৃত ফল । আজ থেকে প্রায় ৯০০০ বছর পূর্বে প্রথম খেজুর গাছ রোপণ করার রেকর্ড রয়েছে। প্রায় ৫৫০০ বছর পূর্ব থেকে ডালিম, ডুমুর, জলপাই ইত্যাদি ফল খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফল জন্মে, যার মধ্যে ৭০ রকমের ফল চাষ করা হয়। এছাড়া কিছু অপ্রচলিত ফল আছে যেমন সাতকরা, কুল, লটকন, লেবু এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। প্রচলিত ফলের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়, আম, লিচু, পেয়ারা, কলা, কাঁঠাল, আনারস, শরিফা, পেঁপে, কুল, নারিকেল, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ।
এ দেশে ফল উৎপাদন বছরব্যাপী সুষমভাবে বণ্টিত নয়। বেশিরভাগ ফলই উৎপাদিত হয় মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। বাংলাদেশে যে ফল উৎপন্ন হয় তার ৪০ শতাংশই কলা। এজন্য গ্রীষ্মকালকে বলা হয় মধুঋতু ও জ্যৈষ্ঠ মাসকে বলা হয় মধুমাস। প্রতিদিন আমাদের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ভিটামিন সি-এর দরকার হয় মাত্র ৩৮ মিলিগ্রাম। অথচ ১০০ গ্রাম কাগজিলেবুর মধ্যেই আছে ৬৩            মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং আমে জাতভেদে গড়ে প্রায় ২৫০ মিলিগ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমের মধ্যে ক্যারোটিন বা ভিটামিন-এ আছে প্রায় ৪৬০০ আন্তর্জাতিক একক। অথচ সেখানে আঙুরে আছে মাত্র ১০০ ও আপেলে আছে ৯৮ আন্তর্জাতিক একক। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলসায় ক্যালসিয়াম আছে ১২৯ মিলিগ্রাম, অথচ ওই পরিমাণ আপেলে আছে মাত্র ১১             মিলিগ্রাম। ভারতে এ ফলটাই এখন অনেক চাষি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন, ফলসার সিরাপ তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। তেঁতুলেও যথেষ্ট ক্যালসিয়াম রয়েছে। আমাদের পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ১০০-১১০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু ভিন্নতর দৈন্যতায় আমরা খেতে পারছি মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম।
ফল নিরাপদ কিনা তাই নিয়ে অনেক সময় আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তবে এ সকল দিক বিবেচনা করে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার অনেক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। যেমন- বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ গত ১০ অক্টোবর ২০১৩ দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ অনুমোদন করেছে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদান এবং নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে গত ২ ফেব্রæয়ারি ২০১৫ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। আইনের আলোকে এবং গৃহীত উৎকৃষ্ট পন্থায় খাবার সব সময় এবং সকলের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষায় ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পৌঁছানোর জন্য বর্তমানে এই কর্তৃপক্ষের কাজ করে যাচ্ছে।
আমারা ফল খাওয়ার সময় অনেকেই কার্বাইড আতংকে থাকি। ‘ক্যালসিয়াম কার্বাইড’ এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এর ব্যাপক অপব্যবহারের ফলে আমসহ অন্যান্য ফল সহজে পাকানো যায়। এটি খুবই শক্ত এক ধরনের যৌগ। যা বাতাসে বা জলীয় সংস্পর্শে এলেই উৎপন্ন করে এসিটিলিন গ্যাস। এটি ফলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানলে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম রোগে বিশেষ করে বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, ক্যান্সারসহ গর্ভবতী  মহিলারা এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুরা। যার ফলে বিষাক্ত খাদ্য নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে।
কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল চেনার উপায়
১. মৌসুমের আগে বাজারে আসা কোন ফল কিনে খাওয়া উচিত নয়। তাহলে টাকা দিয়ে বিষ কেনা হবে। কেননা ওই সময়ের সব ফল কৃত্রিম  উপায়ে কার্বাইড দিয়ে চকচকে রঙের ফল পাকানো হয়ে থাকে। যা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
২. যেসব ফলের গায়ের রঙ সর্বত্রই একই রকমের, দেখতে অনেকটা টকটকে কাঁচা হলুদ রঙের মতো। বুঝতে হবে তা   কৃত্রিম উপায়ে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল।
৩. কৃত্রিম উপায়ে কলা পাকানো হলে কলার রঙ হলুদ এবং কলার বোঁটা, কাঁদি গাঢ় সবুজ থেকে যাবে। টমেটোর রঙ ও চামড়া সমানভাবে টকটকে গাঢ় লাল হয়ে যাবে। আম ও পেঁপের রঙ কমলার মতো রঙ হয়ে যাবে। ধরে নিতে হবে তা কার্বাইড দিয়ে পাকানো। সুতরাং ফল কিনতে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ফল খেতে সতর্কতা ও সাবধানতা
১. মৌসুমের আগে বাজারে সরবরাহকৃত ফল না খেয়ে মৌসুম শুরু হলে ফল খাওয়া উচিত। যদি আমের কথায় বলি তবে সাধারণত বিভিন্ন জাতের আম ধারণ থেকে পরিপক্ব হতে যে সময় প্রয়োজন তা ছকের মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হলো।
সাধারণত ফজলি ১১২ -১২০ দিন, গোপালভোগ ৮৪- ৯১ দিন, ল্যাংড়া ৯৫-১০৫, খিরসাপাত ৮৭-৯৫ এবং ‘বারি আম -১ এর জন্য ৮৫-৯৩ দিন প্রয়োজন হয়। এ গুলি বিষয় প্রচার ও সচেতনতা প্রয়োজন।
২. ফল খাওয়ার আগে অন্তত ৩০ মিনিট ফল বিশুদ্ধ খাওয়ার পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
৩. টেপের নিচে রেখে কয়েক মিনিট পানিতে ধৌত করে ফল খেতে হবে।
৪. ফল কামড়িয়ে না খেয়ে টুকরা টুকরা করে, চামড়া ছিলে খাওয়া উচিত।
নিরাপদ উপাদান দিয়ে ও ফল পাকানো সহজ
ইথেফোনের জলীয় দ্রবণ বা ইথাইলিন গ্যাসের মাধ্যমে ফল পাকানো কিছুটা নিরাপদ বলে অভিহিত করা হয়। ইথ্রেল বা ইথেফোন ফলের মধ্যে ঢুকে ইথাইলিনে রূপান্তরিত হয় বলে ফল পেকে যায়। এ পদ্ধতিতে ফল পাকলে বিপদের ঝুঁকি কম থাকে। ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপাদান ব্যবহার না করেও             প্রাকৃতিক উপায়ে পরিপক্ব কাচা ফল পাকানো পদ্ধতি অতি  পরিচিত ও আদিম পদ্ধতি। যা স্বাস্থ্যসম্মত বলে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। কয়েকটি ছোট ছিদ্রযুক্ত বাদামি রঙের কাগজের থলেতে ভরে-তাতে ২/১টি আপেল ভরে মুখ বন্ধ করে দিয়ে খড় বা গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। আপেলে সাধারণত বিপুল পরিমাণে ইথাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে যা ফল পাকাতে সাহায্য করে ।  ফলে ভেজাল দূরীকরণে যে সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো-
ক. জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার,
খ. বাগানি, কৃষক, ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, আড়তদার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
গ. মোবাইল টিমের মাধ্যমে মূল উৎস খুঁজে তাতে হানা দেয়া।
ঘ. গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ মনিটরিং সেল গঠন করা ।
ঙ. ভেজাল পণ্য মনিটরিং, ভেজাল এবং মূল উৎস খুঁজে তাতে তাৎক্ষণিক মোবাইল টিমের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে দÐ ও জরিমানার মাত্রা বৃদ্ধি করে প্রয়োগ করা।
চ. ভেজালরোধী টিমে কার্বাইড, ফর্মালিন, বিষাক্ত  কেমিক্যাল, কীটনাশকের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য আধুনিক প্রয়োজনীয় কীট বক্স সরবরাহ।
স্বল্প সময়ের মধ্যে ফলদানে সক্ষম কয়েকটি ফল আবাদ করে সহজেই লাভবান হওয়া যায় যেমন:
কলা, পেঁপে, পেয়ারা, কুল, আম, আমড়া, লিচু- এসব আবাদকরে দ্রæত লাভবান হওয়া যায়। সবরি, সাগর এবং রঙিন মেহের সাগর এ তিন জাতের কলা চাষ বেশ লাভজনক। রেড লেডি ও কহিনুর নামক বিদেশি জাত দুটি বাগান আকার আবাদ লাভজনক। এ জাত দুটি উভলিঙ্গিক (বাইসেকসুয়াল) তাই প্রতি মাদায় এ জাতের মাত্র একটি করে চারা রোপণ করতে হয়। এখন সারা বছরব্যাপী আম পেতে বারি আম-১১ চাষ করা যেতে পারে। আর অতি ঘন পদ্ধতিতে আম চাষের জন্য বারি আম-৪ খুব উপযোগী।
অত্যাধিক তাপমাত্রা, বাগানের মাটিতে রসের অভাব, জলাবদ্ধতা, অতিমাত্রায় সার প্রয়োগ, খাদ্য ও হরমোন ঘাটতি, রোগ-পোকার আক্রমণ এবং সময় উপযোগী পরিচর্যার অভাবই ফল কম ধরা ও ঝরার প্রধান কারণ। এ ছাড়া অনুখাদ্য ও হরমোনের ঘাটতির কারণে ফুল-ফল ঝরে। ফল আবাদে ফল ধরা একটি মারাত্মক সমস্যা তাই এটি দূরীকরণে যা দরকার তা হলো-
কাজেই ঝরা রোধে গাছে ফুল আসার ৩ সপ্তাহ আগে প্রতি লিটার পানিতে ফ্লোরা ২ মিলি, ডেসিস-১ মিলি, গোল্ডাজিম ১ মিলি/ব্যাবিস্টিন-১ গ্রাম এবং লিবরেল বোরন ১.৫ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুস্থ ফুল ধরতে সহায়ক হয়।
ফুল (কুঁড়ি) বের হওয়া মাত্র প্রতি লিটার পানিতে ইমিটাফ ০.৫ মিলি, ডেসিস ১ মিলি, ক্যাবরিয়টফ১ গ্রাম, ফ্লোরা ২ মিলি এবং বোরন ১.৫ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুস্থ ফুল-ফল ধরবে।
কচি ফল আশা মাত্র প্রতি লিটার পানিতে ইমিটাফ ০.৫ মিলি, লিটোসেন ১ মিলি এবং ক্যাবরিয়টফ ১ গ্রাম মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর দুইবার স্প্রে করা দরকার।
পরে ফল একটু বড় হলে প্রতি লিটার পানিতে ডেসিস ১ মিলি, সিকিউর ২ গ্রাম এবং নাফা ২.৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করলে কচি ফল ঝরা বন্ধ হবে এবং ফলের গুণাগতমান বাড়বে।
প্রতি বছর দেশব্যাপী ফল মেলার আয়োজন ও প্রচারণার কারনে ফল সম্পর্কে জনসাধারণের উৎসাহ বৃদ্ধি ও চাষাবাদের আগ্রহ বেড়েছে। এর কারণে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্যিক ফল চাষ ও প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠছে। তবে দেশি ফলে দেশকে সমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের আধুনিক মানসম্মত নার্সারি, মানসম্মত মাতৃগাছের বাগান স্থাপন, দেশি ফলের মিশ্র বাগান প্রতিষ্ঠা, বহুস্তরী বাগান প্রতিষ্ঠা, অতি ঘন উপয়ে আম বাগান প্রতিষ্ঠা, বাজার বা বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ এগুলির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই আমরা আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, মোট ফলের উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম এসব গৌরবের পরিসংখ্যানের আরো উন্নতি করতে পারব। য়
আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক অফিস, রাজশাহী, ০৭২১৭৭৩২৭৭ ই-মেইল :rajshahi@yahoo.com