Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টিমান অক্ষুন্ন রেখে ফল গ্রহণ

ফারজানা রহমান ভূঞা
শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম করে তোলার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। শরীরের কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে খাদ্যকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- ক) তাপ ও শক্তিদায়ক খাদ্য; খ) শরীর বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরক খাদ্য; এবং গ) রোগ প্রতিরোধক খাদ্য। ফল একটি পুষ্টিকর খাদ্য। মূলত ফলমূলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ ফলমূলই হলো ভিটামিন ও খনিজ লবণসমূহের ভাÐার, যা আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে।
পুষ্টিবিদগণ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করার সুপারিশ করলেও বর্তমানে আমরা গড়ে দৈনিক চাহিদার অর্ধেকেরও কম ফল গ্রহণ করছি। যার ফলে  ভিটামিন ও খনিজ লবণের অভাবজনিত অপুষ্টি যেমন- রাতকানা, অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা, গলগÐ, স্কার্ভি, বেরিবেরি প্রভৃতি রোগসমূহে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ফলের পুষ্টিগত উপাদান ফলের প্রকৃতি, পরিপক্বতা, উৎপাদন কৌশল, সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়া আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে ফল রান্না ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুরো ভিটামিন ও খনিজ লবণই অটুট থাকে এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
টাটকা ফলের প্রধান অংশ হচ্ছে পানি (৮০-৯৫%)। ফলে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট তুলনামূলকভাবে কম থাকে, দ্রবণীয় শর্করা ও পেকটিন বাদে ফলের পুষ্টিমান প্রধানত খনিজ ও ভিটামিনের উপর নির্ভরশীল, এজন্য ফলকে দেহ রক্ষাকারী খাদ্য বলা হয়, ফলের উল্লেখযোগ্য ভিটামিন হচ্ছেÑ
ক্যারোটিন : দেশি হলুদ রঙের ফলে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন থাকে। আম, পেঁপে, কাঁঠাল, কমলা, লেবু, আমড়া প্রভৃতি ফলে প্রচুর ক্যারোটিন পাওয়া যায়, যেমনÑ প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা  ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা কাঁঠালে ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন থাকে, এ ক্যারোটিনের প্রায় ৬ ভাগের এক ভাগ রেটিনল সমতুল্য বা ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে কাজে লাগে। প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ও বাচ্চাদের ৩৭৫ থেকে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদা পূরণ হয়। দেশীয় অন্যান্য ফলে অল্প পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ থাকে। ভিটামিন ‘এ’ শরীরের চাহিদামতো গ্রহণ করলে রাতকানা রোগ ও অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বি-ভিটামিন : ফলে কিছু পরিমাণ ‘বি’ ভিটামিন বিশেষ করে থায়ামিন (ভিটামিন বি১) এবং রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২) থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে পাকা আম, কাঁঠাল, বাঙ্গি, আনারস, আমড়াতে ০.১০ থেকে ০.২৮ মিলিগ্রাম ও অন্যান্য ফলে ০.১০ মিলিগ্রামের কম থায়ামিন থাকে। থায়ামিন খাদ্যদ্রব্যকে ক্যালরিতে রূপান্তর, হজম পেশিগুলোকে সবল ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে পাকা কাঁঠাল ও আতাফলে যথাক্রমে ০.১৫ মিলিগ্রাম ও ০.১৪  মিলিগ্রাম এবং অন্যান্য ফলে ০.১০ মিলিগ্রামের কম রিবোফ্লাভিন থাকে, এর অভাবে মুখের কোণায় ও ঠোঁটে ঘা, ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা নষ্ট ও নাকের দুই পাশে চর্মরোগ হয়।
ভিটামিন ‘সি’: ভিটামিন ‘সি’ এর প্রধান উৎস লেবুজাতীয় ফল। দেশীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ থাকে। এই ভিটামিন মাঢ়িকে মজবুত, ত্বককে মসৃণ, সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমলকী ফলে প্রতি ১০০ গ্রামে ৪৬৩ মিলি গ্রাম ভিটামিন সি আছে। পুষ্টিবিদগণ একজন বয়স্ক লোকের দৈনিক ৪৫ মিলিগ্রাম ও শিশুদের ৩৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। দেশীয় ফল রান্না করে খেতে হয় না বলে, এ সব ফলের পুরো ভিটামিন ‘সি’ আমাদের শরীরে শোষিত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে।
খনিজ লবণ : ফলে সকল পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, যার পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ থেকে ৫০ মিলিগ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম তরমুজে ৭.৯ মিলিগ্রাম, জামে ৪.৩ মিলিগ্রাম ও অন্যান্য ফলে ১.৫ মিলিগ্রামের কম লৌহ থাকে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে। পাকা কলায় শ্বেতসার ছাড়াও প্রায় ২৫০-৫৭০ মিলিগ্রাম   পটাশিয়াম থাকে।
ফলের খনিজ উপাদান মুক্ত জৈব এসিড বা এদের লবণরূপে থাকে এবং দেহরসের ক্ষারত্ব রক্ষা করে। আনারসে ভিটামিন ‘সি’ ছাড়াও ব্রোমেলিন নামক এক প্রকার প্রোটিন পরিপাককারী এনজাইম থাকে, কাঁচা পেঁপের আঠায় প্যাপাইন নামক এনজাইম আছে, যা মাংসকে নরম করতে সাহায্য করে।
ফলের খোসায় বেশির ভাগ সেলুলোজ থাকে। কাঁচা ফলের শ্বেতসারই প্রধান কার্বোহাইড্রেট। পাকার সময়ে শ্বেতসার গøুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং সুক্রোজে পরিণত হয়। যার ফলে পাকা ফল মিষ্টি লাগে। উদ্বায়ী ও অনুদ্বায়ী জৈব এসিড, যেমন- সাইট্রিক, মেলিক, টারটারিক প্রভৃতির জন্য কাঁচা ফল টক হয় এবং পাকার সময় গøুকোজ, ফ্রুক্টোজের সাথে মিলে ফলের নিজস্ব গন্ধের সৃষ্টি করে। ফল পাকলে এসিডের পরিমাণ কমে যায় এবং চিনির পরিমাণ বাড়ে। কাঁচা কালোজামে মোট শর্করার পরিমাণ ৫.৮%, কিন্তু পাকা জামে ১২.৪% শর্করা থাকে। ফলের মধ্যস্থ এনজাইম ফল পাকাতে প্রভাবিত করে, ফল পরিপক্ব হওয়ার সময়ে এনজাইম ক্রিয়া পেকটিনোজেন পেকটিনে পরিণত হয়। পেকটিন সমৃদ্ধ ফল হতে ভালো জেলি তৈরি হয়। আপেল, পেয়ারা, লেবুজাতীয় ফল, আনারস প্রভৃতিতে পেকটিন বেশি থাকে, ফলের পেকটিন ডায়রিয়া, আমাশয়ে খুব উপকারী।
ফলের মতো ফলের রসেও সমান পরিমাণ গুণাগুণ বিদ্যমান। ফলের রসের পুষ্টি উপাদানগুলো শরীর দ্রæত শোষণ করে নিতে পারে। তবে ফলের রস পান ফল গ্রহণের মতো খুব একটা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস নয়। এ ছাড়া প্যাকেটজাত ফলের রস, ফলের প্রাকৃতিক উপকারী দিকসমূহ বিনষ্ট করে দেয়। এই সব রসে ফলের আঁশ থাকে না এবং উচ্চমাত্রায় চিনি থাকে। প্যাকেটজাত ও বোতলে সংরক্ষিত ফলের রসে প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ফল থেকে তৈরি করা ফলের রসে থাকে শরীরের জন্য  প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলস, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমূহ। তবে ফলের রস তৈরির ফল ও ফলের খোসার আঁশ একেবারেই বাদ পড়ে যায়। আঁশ খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে, রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে এবং ক্ষতিকর কোলস্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর জন্য ফলের রস এড়িয়ে যাওয়া উত্তম। ফলের রস খাওয়ার সময় অবশ্যই প্রস্তুত করার সাথে সাথে পান করা উচিত। প্রস্তুতির পর দীর্ঘ সময় ফেলে রাখলে ফলের রসে বিদ্যমান বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
প্রায় সবার মাঝেই একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, ফল যেকোনো সময় কেটে খাওয়া যায়। কিন্তু ফল গ্রহণের সুনির্দিষ্ট সময় অনুসরণ করা না হলে ফল থেকে অপকারই বেশি হয়। তাই ফল গ্রহণের সঠিক সময় সম্পর্কে জানা দরকার।
১। ভরা পেটে- খাওয়ার পরপরই ফল খেলে তা হজম হতে অনেক সময় লাগে। ফল হজম না হয়ে অনেকক্ষণ পেটে থাকলে বুক জ্বালা, ঢেঁকুরের সমস্যা দেখা দেয়।
২। সকালে উঠে- সকালে উঠে এক গøাস পানি খাওয়ার পর ফল খাওয়া উচিত। তবে সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন- কমলা, আঙ্গুর, বাতাবিলেবু, এগুলো খেলে অ্যাসিডিটি বাড়তে পারে। অন্যান্য মিষ্টি ফল যেমন- আপেল, কলা, নাশপাতি, আম ইত্যাদি খালি পেটে খেলে তা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা করে, শরীরে শক্তি জোগায় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
৩। খাওয়ার মাঝে- ফল খাওয়ার আসল নিয়ম খাওয়ার আগে ও পরে। সাধারণত আমরা দিনে তিন বার (ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার) ভরপেট খেয়ে থাকি। ফল খেতে হলে ভরপেট খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা দু’ঘণ্টার পর খেতে হবে। তবে খাবারের পরিমাণের উপর ফল খাওয়ার সময়ও নির্ভর করে। যদি খুব ভারী খাবার খাওয়া হয় তাহলে অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা পর ফল খেতে হবে। আর যদি সালাদ বা হালকা কোনো খাবার খাওয়া হয় তবে দেড় ঘণ্টার পরই ফল খাওয়া যেতে পারে।
৪। শোয়ার আগে- ঘুমোতে যাওয়ার আগেও ফল খাওয়া সঠিক নয়। ফলের মধ্যে থাকা শর্করা এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেয় এবং ঘুমাতে বাধা দেয়। এজন্য ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত তিন ঘণ্টা আগে ফল খেতে হবে।
ফল গ্রহণের কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে তা থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টি পাওয়া যায়। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিয়ম নিচে দেওয়া হলো :
ক্স প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত;
ক্স একই সময়ে অনেক ধরনের ফলের সমাহার খাবারে রুচি বৃদ্ধি করবে;
ক্স সাধারণত ফল গ্রহণের এক থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত ক্ষুধা নিবৃত্ত থাকে;
ক্স এসিডিটি বা পরিপাকজনিত অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ফলকে দই বা অল্প লবণের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়;
ক্স দুধের সাথে সাইট্রাস (টক) জাতীয় ফল খাওয়া উচিত নয়;
ক্স ফলকে বড় টুকরা করে কেটে সালাদের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়;
ক্স ফল খাওয়ার পর পরই পানি পান করা সঠিক নয়। য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারটান, সেচ ভবন, ঢাকা, মোবাইল : ০১৮৩২২৭২১৪২, ই-মেইল :  farjanarb@yahoo.com