Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ বিভাগ

বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০১৯ এর প্রতিপাদ্য ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ, পুষ্টিকর খাদ্যেই হবে আকাক্সিক্ষত ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী’। খাদ্য নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রূপকল্প হচ্ছে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্যসংযোজনের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত  ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করা। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে ঘোষিত ‘ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার’ অর্জনে টেকসই প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। ডড়ৎষফ ঋড়ড়ফ চৎড়মৎধস (ডঋচ) এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এরই মধ্যে যথেষ্ট উন্নতি করলেও, অনিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এখনও অধিক সংখ্যক মানুষ, যাতে নারী ও শিশুর সংখ্যা অত্যাধিক। শিশুদের এক- তৃতীয়াংশ ক্ষীণস্বাস্থ্য ও    পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাছাড়া, আর্থসামাজিক এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রণীত রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উল্লেখ্য যে, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য নিরসনে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ  এবং ৪৫% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সংরক্ষণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ গবাদিপশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা বিগত কয়েক বছর ধরে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত গবাদিপশু দ্বারা কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে। তা ছাড়া, বিগত এক দশকে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৩.১৯ গুণ, ৫.০ গুণ এবং ২.০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশব্যাপী  বিভিন্ন  কর্মপরিকল্পনার  বাস্তবায়ন  করে  যাচ্ছে।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ যদিও অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে কিছু প্রতিবন্ধকতা আমাদের এখনও অতিক্রম করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা  এবং সবার জন্য কর্ম নিশ্চিত করতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে সামনে অগ্রসর করা এবং সামগ্রিক     কৃষি ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক (যেমনÑ শস্য বহুমুখীকরণ, মূল্য সংযোজিত প্রাণিজাত খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি) উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের দাবি। ক্ষুধা দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ উন্নত সহজলভ্য পুষ্টির জোগান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য-২ বাস্তবায়ন    কৃষিখাতের ওপর অর্পিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকিঁতে কাক্সিক্ষত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রাণিজ আমিষের পর্যাপ্ত জোগান আমাদের আশাবাদী করছে। আগামীতে মানুষের কর্মস্পৃহা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের উন্নয়ন তথা নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহে প্রাণিসম্পদ খাত নির্ভরযোগ্য ভূমিকা ও অবদান রাখতে সক্ষম।
মানবসভ্যতা বিকাশের প্রতিটি স্তরে প্রাণিসম্পদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কৃষি কাজ শুরুর পূর্বে পশু শিকারই মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হলেও, সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পশুকে কর্ষণ, পরিবহন ও খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়েছে। ৭০ এর দশকে পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ, জমি কর্ষণ ও পরিবহন শক্তিই ছিল পশু-পাখির পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। ৮০ এর দশক থেকে এই খাতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়েছে উৎপাদনশীল পশু-পাখির বাণিজ্যিক পালন পদ্ধতি। ফলে, সামগ্রিক প্রাণিসম্পদ খাত শিল্পখাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গার্মেন্টের পর পোলট্রি শিল্প এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান খাত, যেখানে প্রায় ৭০ লক্ষের অধিক মানুষ সরাসরি কর্মরত।
বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ একটি     সম্ভাবনাময় ও লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিজাত উৎপাদন বেড়ে চলছে। স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লক্ষ মেট্রিক টন, ৫ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ১৫০ কোটি, যা বর্তমানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৯.২৩ লক্ষ মেট্রিক টন, ৭৫.১৪ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ১৭১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। উক্ত পরিসংখ্যানই বলে দেয়, পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব খাদ্য উপাদানসমূহ অর্থাৎ দুধ, মাংস ও ডিমের প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা যথাক্রমে ১৬৫.০৭ মিলি/জন/দিন, ১২৪.৯৯ গ্রাম/জন/ দিন এবং ১০৩.৮টি/জন/বছর ।
সম্প্রীতি বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে বাংলাদেশ নি¤œ আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। তাই পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশের তালিকায় উন্নীত হতে গেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের আধিক্য বাড়াতে হবে। কারণ উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সবার আগে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ।
দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। দুগ্ধজাতীয় পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং স্কুল ফিডিংয়ের মাধ্যমে দুধ পানের অভ্যাস জনপ্রিয়তা লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ পালন করে থাকে। প্রতি বছর ০১ জুন ‘দুধ পানের অভ্যাস গড়ি, পুষ্টি চাহিদা পূরণ করি’ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে বিশ^ দুগ্ধ দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে গাভী ক্রয় করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ডিমকে বিশে^ একটি উন্নতমানের ও সহজলভ্য আমিষ জাতীয় খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ইন্টারন্যাশনাল ঊমম ঈড়সসরংংরড়হ প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ^ ডিম দিবস পালন করে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশেও দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক, যুব মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে সম্পৃক্ত করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণে ও ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত দশকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৯১ লক্ষ বেকার যুবক, যুব-মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র খামারি ও কৃষকদেরকে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি লালন-পালনের ওপর প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রাণী চিকিৎসক কর্তৃক সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। দারিদ্র্যবিমোচন ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক নি¤œবর্ণিত প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হয়েছেঃ
ি স্বাস্থ্যসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ;
ি ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য বাণিজ্যিক লেয়ার ও বয়লার পালন মডেল;
ি স্ল্যাট/স্লট পদ্ধতিতে ছাগল পালন বাংলাদেশের সাধারণত উন্মুক্ত অবস্থায় ছাগল পালন করা;
ি গ্রামীণ পরিবেশে হাঁস পালন পদ্ধতি;
ি পারিবারিক পর্যায়ে কোয়েল/টার্কি/খরগোশ পালন প্রযুক্তি;
ি বায়োগ্যাস প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে নিরাপদ জ¦ালানি এবং জৈবসার উৎপাদন;
ি কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রাণিসম্পদ হতে উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে;
ি প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে দেশের আবহাওয়া উপযোগী সংকর জাতের বীফ ব্রিড উন্নয়নের লক্ষ্যে আমেরিকা থেকে ১০০% ব্রাহমা জাতের সিমেন আমদানি করে দেশি জাতের গাভীর সাথে প্রজনন করে মাংসল জাতের গরুর উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রয়েছে;
ি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য মোট ১৭ প্রকারের টিকা উৎপাদন, বিতরণ ও প্রয়োগ।        ই-প্রাণিসম্পদ সেবা, প্রাণিসম্পদ সহায়ক মোবাইল তা ইত্যাদি ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় সেবা প্রদান;
প্রাণিবর্জ্য, পশু জবাইজাত উপকরণ, ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবহার, পরস্পর সংক্রমণযোগ্য (জুনোটিক) রোগ দমন, আবির্ভূত ও পুনঃরাবির্ভূত রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রাণিসম্পদ খাতের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। ফলশ্রুতিতে সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা  বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

 

ডাঃ হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক ১ ফয়সাল মেহেদী হাসান ২

১মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা, ২উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ অর্থনীতি শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা, মোবা : ০১৭১৩৪০৩২১৩, ই-মেইল: hfaysal-1971@yahoo.com