Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

খাদ্য ও রোগের সম্পর্ক

অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই যে আপনি যা খাচ্ছেন তা আপনার অনুভূতিকে অনেকটাই নির্ধারণ করছে। একবার ভাবুন তো, বান্ধবীকে নিয়ে সিনেপ্লেক্সে বসে মুভি দেখছেন, সে সময় যদি একটা ঠোঙায় থাকে মাখনমাখা পপকর্ণ আর এক ক্যান কোকÑতাহলে মুভি দেখার অনুভূতিটা কেমন বদলে যাবে তাই না? তার মানে খাদ্যের সাথে অনুভূতির একটা সম্বন্ধ আছে। অনুভূতিটা তো আসে স্বাস্থ্য থেকে। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মনে সুখ ও আনন্দ লাগে, স্বাস্থ্য মন্দ থাকলে কষ্ট লাগে। এখনো সময় আছে, এবিসিডি- এই চারটা রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার।
‘এ’ মানে অ্যাজমা, ‘বি’ মানে ব্লাড প্রেসার, ‘সি’ মানে ক্যানসার এবং ‘ডি’ মানে ডায়াবেটিস। এই চার সমস্যা এখন অধিকাংশ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে। খাদ্য ও রোগ নিয়ে নানারকম উপদেশ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কোনটা মানবো, কোনটা শুনবো, কোনটা করবো না- ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকেই যখন বলছে, ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার সাহেব যখন এটা ওটা খেতে নিষেধ করছেন, তখন মনে হচ্ছে স্বাস্থ্যের ওপর খাদ্যের নিশ্চয়ই কোনো ক্রিয়া বা প্রভাব আছে- অনেক খাদ্য রোগ ডেকে আনে, আবার অনেক খাদ্য রোগকে ঠেকিয়ে দেয়। কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে? রোগ ও খাদ্যের মধ্যে সম্পর্কটাকে ভালো করে চিনে জানা দরকার- বিশেষ করে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের চোখে। অবশ্য এটা নিশ্চিত হওয়া মুশকিল যে, রোজ এক প্যাকেট চিপস বা চায়ে এক চামচ চিনি আমাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আসলে কতটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিংবা তিন বেলা বেশি করে ভাত খাওয়া- সেটাও কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, আর এ অধ্যায়ে আমি সেসব আলোচনা করার চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই ওজন কমানোর জন্য দামি ওষুধ খাওয়া ও ডাক্তারের বিল পরিশোধ করার চেয়ে কিছু খাদ্য-খাবার বেছে সেগুলো খাওয়া দীর্ঘমেয়াদি সুস্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
অ্যাজমা রোগ ও খাদ্য
সন্দেহ নেই যে সুষম খাবার আমাদের দেহ-মনকে সুস্থ-সবল রাখতে পারে। কিন্তু এমন কিছু খাদ্য আছে যেগুলো খেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, কিছু খাদ্য আছে যেগুলো খেলে শ্বাসকষ্ট কমে। অ্যাজমা বা হাঁপানি আমাদের মতো ধূলি-আবর্জনার শহরে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সেই সাথে যদি খাদ্যের কারণে এ রোগ বাড়ে তাহলে তা দুশ্চিন্তার বিষয়। ভিটামিন ডি সরাসরি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। দেহে    ভিটামিন-ডি কমে গেলে অ্যাজমা রোগের প্রবণতা বেড়ে যায়। ফর্টিফাইড দুধ, সামুদ্রিক মাছ (স্যালমন ফিশ), কমলার রস, ডিম ইত্যাদি ভিটামিন ডি-এর অন্যতম উৎস। ভিটামিন ই টোকোফেরল নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ ধারণ করে। টোকোফেরল অ্যাজমার লক্ষণ বিশেষ করে কাশিকে প্রশমিত করে। ভিটামিন ই-এর অন্যতম উৎস হলো আখরোট, কুমড়ার বিচি, সরিষা শাক, ব্রোকলি, বাটিশাক ইত্যাদি। বিটা ক্যারেটিনসমৃদ্ধ সবজি যেমন গাজর ও সবুজ শাক, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন পালংশাক ও কুমড়ার বিচি ইত্যাদি অ্যাজমা রোগের জন্য খাওয়া যেতে পারে। এসব খাবার খেলে অ্যাজমা রোগ প্রশমনে তা সাহায্য করে।
অন্যদিকে, সালফাইট উৎপন্নকারী বিভিন্ন খাবার যেমন চিংড়ি, কাঁকড়া, পুঁইশাক, আচার, বোতলজাত লেমন জুস, মদ ইত্যাদি খেলে অ্যাজমা রোগ বাড়ে। গ্যাস উৎপন্নকারী কিছু খাবার আছে যেমন কার্বোনেটেড সোডা ওয়াটার ও কোমল পানীয় বা কোল্ড ড্রিংকস, পিয়াজ, রসুন, তেলেভাজা খাবার (পুরি, পিয়াজী, বড়া, ফ্রেঞ্চফ্রাই, নাগেট, রোল) ইত্যাদি খেলেও অ্যাজমা বাড়তে পারে। ঠা-া পানীয় বা আইসক্রিম তো বাড়াবেই। অ্যাজমা হলে বিভিন্ন প্রকার শিম খাওয়াও ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত চা, কফি বা মসলা খেলেও এ সমস্যা হতে পারে।
যত দোষ নন্দ ঘোষ
সারা বিশ্বের বাজারে কত খাবার যে আছে! এসব খাবারের কোনটা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর কিভাবে প্রভাব ফেলছে তা জানা কঠিন। তবে এ কথা সত্য যে নির্দিষ্ট কোন খাদ্যের প্রতি আমাদের আসক্তি ও সেসব খাবার তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণ আমাদের মৃত্যুকে এগিয়ে আনে।
স্বাস্থ্য নষ্টের এখন সবচেয়ে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে তেল। আমাদের দেহের জন্য চর্বি বা ফ্যাটজাতীয় উপাদানের দরকার আছে সত্য, কিন্তু ওটা প্রকৃতিতে জন্মানো ও উৎপাদিত প্রতিটি খাবারের মধ্যেই কম-বেশি আছে। দেহের জন্য যতটুকু দরকার তা নিয়মমতো খাবার খেলে মানে তেলছাড়া রান্না করে খেলেও তা যথেষ্ট। অথচ প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন খাবার তৈরিতে প্রচুর পরিমাণে তেল ব্যবহার করছি ও খাচ্ছি। এটাই বাড়তি হয়ে দেহে মেদের আকারে জমছে ও উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদরোগ তৈরি করছে। বিশ্বব্যাপী এখন স্থূলতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসবের জন্য দায়ী আসলে অতিরিক্ত তেল বা চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া। অথচ যে খাবার আমাদের রোজ খাওয়া দরকার তা খাচ্ছি না। খাদ্য তালিকার বাইরে রয়ে যাচ্ছে সেগুলো। এর মধ্যে অন্যতম প্রয়োজনীয় একটি আদর্শ খাদ্য হলো দুধ। নারীদের হাড় মজবুত রাখতে বিশেষভাবে দুধ খাওয়া দরকার। হাড় মজবুত হলে নারীদের আথ্রাইটিস ও অস্টিওপোরেসিস প্রতিরোধ হয়। নিয়মিত টাটকা ফল ও শাকসবজি খেলে কোলস্টেরলের মাত্রা কমে, এতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
লাল মাংস খাওয়ার ঝুঁকি
রোজ লাল মাংস খেলে অবশ্যই আয়ু কমবে, বাঁচবো কম দিন। লাল মাংস হলো গরু-মোষ, খাসি-ভেড়ার মাংস। মাংস খেলে তা থেকে দেহ প্রোটিন বা আমিষ পায়। দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনের জন্য প্রোটিনের দরকার আছে সত্য। তবে সেই প্রোটিন চাহিদা বিকল্প উৎস থেকেও মিটানো যায়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, লাল মাংস অধিক গ্রহণের ফলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসার রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের একদল গবেষক ড. ফ্রাংক হুর নেতৃত্বে এক গবেষণা কর্ম সম্পাদন করেন। তারা ১৯৮০ সালে ৮৩০০০ জন নারী ও ১৯৮৬ সালে ৩৭,০০০ জন পুরুষের ওপর এক জরিপ চালান। গবেষণা শুরুর সময়ে তাদের কারোরই কোনো হৃদরোগ ও ক্যানসার ছিল না। তারা প্রতি ৪ বছর অন্তর তাদের খাদ্য গ্রহণ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্যাদি একটি জরিপ ফরমে পূরণ করে দিতেন। গবেষক দলের একটি গবেষণা পত্র ২০১২ সালের ১২ মার্চ আর্কাইভ অব ইন্টারনাল মেডিসিনে অনলাইনে প্রকাশিত হয়। গবেষণা চলাকালীন সময়ের মধ্যে ২৪০০০ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে ৫৯০০ জন মারা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ও ৯৫০০ জন ক্যানসারে ভুগে, যারা অধিক পরিমাণে লাল মাংস খেয়েছিলেন। খাদ্য তালিকায় এরা দিনে অন্তত একবার লাল মাংস গ্রহণ করেছিলেন। গবেষকরা গবেষণা শেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, যারা দিনে একবার লাল মাংস খায় তাদের মৃত্যুঝুঁকি ১৩% ও যারা দুবার লাল মাংস খায় তাদের মৃত্যুঝুঁকি ২০% বেশি। গবেষকরা এটাও দেখেছেন যে, যদি তারা প্রোটিনের জন্য বিকল্প উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে তাহলে পুরুষের ক্ষেত্রে ৯.৩% ও নারীদের বেলায় ৭.৬% মৃত্যুঝুঁকি কমানো যায়।
তবে এই গবেষণা থেকে এটা নিশ্চিত যে, লাল মাংস খাওয়ার ফলে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের হৃদরোগ বেড়ে গেছে, কিছু ক্যানসারও। কাজেই এ নিয়ে সাবধান হওয়া ভালো।
বেশি খাবারে বেশি ওজন
কথায় বলে ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’। তাঁতির কি হলো তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও এখন নিজের ওজন, মুটিয়ে যাওয়া, ভুড়ি- এসব নিয়ে এখন ভাবতে হচ্ছে। কেননা, বিশ্বব্যাপী দেহের ওজন বেড়ে যাওয়া ও মোটা হওয়া এখন বেড়ে চলেছে। ওজন বাড়া আর স্থ’ূলতা বা মোটা হওয়ার কারণে অনেক রোগ বিশেষ করে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
এখন আমাদের টাকা-পয়সা হচ্ছে আর আমরা বেশি বেশি খাবার খাচ্ছি, অখাদ্য-কুখাদ্যও খাচ্ছি, যা আমাদের এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও আশংকাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, বিশ্বে ২০১৬ সালে প্রায় ১.৯ বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওজন বেশি ছিল যাদের মধ্যে প্রায় ৬৫ কোটি লোক ছিল মোটা। যাদের ওজন বেশি তাদের মৃত্যু হার ওজন কমওয়ালাদের তুলনায় বেশি। শুধু যে প্রাপ্ত বয়স্ক বা বয়স্ক মানুষরা মুটিয়ে যাচ্ছে তাই নয়- বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি ১০ লক্ষ শিশু ¯ূ’’লতা নিয়ে বড় হচ্ছে। উন্নত ও ধনী দেশসমূহে এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি লোক প্রয়োজনীয় খাবার পায় না অথচ ২০০ কোটি লোক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খায়।
কানাডিয়ান কমিউনিটি হেলথ সার্ভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা রোজ সবজি ও ফল খায় তাদের ওজন কম, পক্ষান্তরে যারা বেশি মাংস খায় তাদের ওজন বেশি। কিন্তু এই সরল হিসাবের বাইরেও আছে আরও অনেক কারণ- অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে যে ক্যালরি নিচ্ছি তা ঠিকমতো পোড়াতে পারছি না। শারীরিক কাজ, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের প্রবণতা অনেক কমে গেছে। এটাও ওজন বাড়ার কারণ।
গবেষণায় দেখা গেছে সারা বিশ্বে ক্যানসার রোগীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ রোগীর ওজন বেশি ও মোটা। মোটা লোকেরা সাধারণত স্তন, জরায়ু, আন্ত্রিক, কিডনি, পিত্তথলি, গলা ও অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে বেশি ভোগে। এদের দেহে কোলস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তারা বেশি রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা করে উপর্যুপরি বেড়ে যাওয়া ক্যানসার রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। তাই কি খাবো, কতটুকু খাবো, দেহের ওজন তথা বিএমআই ঠিক বা কম রাখতে কি করতে হবে সেসব নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় এসে গেছে।
অতি ভাতে রসাতল
প্রাচীনকালের লোকেরা আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘ঊন ভাতে দুনো বল, অতি ভাতে রসাতল।’ ঊন মানে কম ভাত খেলে সুস্থ থাকা যায়, কিন্তু বেশি ভাত খেলে তা আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনে। ভাত তথা কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের পরিমাণ অতিরিক্তি হয়ে গেলে দেহের ভেতরে তৈরি হওয়া   ইনসুলিন তা পুরোপুরি রূপান্তর করতে পারে না। ফলে রক্তে চিনির পরিমাণ বা ব্লাড সুগার বেড়ে যায়, যা ডায়াবেটিস রোগ ডেকে আনে। অতিরিক্ত ভাত খাওয়ার ফলে দেহে কোলস্টেরল বেড়ে যায়। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ২৩২ গ্রাম চালের ভাতই যথেষ্ট, সেখানে আমাদের চালের দৈনিক চাহিদা গড়ে জনপ্রতি ৪৪৩ গ্রাম। আশার কথা, ধীরে ধীরে এ অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে, কমছে ভাত খাওয়ার পরিমাণ। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের দ্বারা এ অবস্থা বদলানো যায়। ভাতের বিকল্প রুটি খেলেও উপকার হয়। সুস্থ থাকার জন্য সেটা এখন অনিবার্য। বিশেষ করে কোলস্টেরল ও রক্তের চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিমাণ মতো ভাত খাওয়া দরকার। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক কমে।
নিজের হৃৎপি-কে ভালোবাসুন
ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে আর নেই- সেই ভালোবাসা দিয়ে আপনি আপনার হৃৎপি-কে রক্ষা করুন, হৃদস্বাস্থ্যকে ভালো রাখুন। দিন দিন বিশ্বব্যাপী বেড়ে চলেছে হৃদরোগের ঝুঁকি ও হৃদরোগে মৃত্যু। আপনার পরিবারে যদি হৃদরোগের ইতিহাস থাকে তবে সে বংশধারার ঝুঁকি এড়ানো কঠিন। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত কিছু সহজ উপায় মেনে তা অভ্যাস করলে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। যেসব বিশেষ কারণে হৃদরোগ হয় যেমন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রার কোলস্টেরল, ধূমপান, দেহের অতিরিক্ত ওজন, দৈহিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা ইত্যাদি। এর মধ্যে কোলস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক। কোলস্টেরলের মাত্রা যত বাড়বে, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও তত বাড়বে। এটা বাড়ল কি-না তা পরীক্ষা ছাড়া জানা সম্ভব নয়। নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে খউখ (খারাপ কোলস্টেরল), ঐউখ (ভালো কোলস্টেরল) ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হার্ট অ্যাটাকের আর এক নীরব ঘাতক। এসব দস্যু ও ঘাতক থেকে নিজের হৃৎপি-কে রক্ষা করতে হৃৎপি-ের জন্য যেসব খাদ্য ভালো সেগুলো খেতে হবে।   
সম্পৃক্ত চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট খুবই খারাপ, কেননা তা খারাপ কোলস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এই চর্বি থাকে মাংস, দুধজাতীয় খাবার, চকোলেট, বেকারি সামগ্রী (কেক, বিস্কুট, ডানোট, প্যাস্ট্রি), ভাজা, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ইত্যাদিতে। ট্রান্স ফ্যাট আর একটি খারাপ ফ্যাট। এটা খারাপ কোলস্টেরলকে বাড়িয়ে ও ভালো কোলস্টেরলকে কমিয়ে দিতে পারে। ট্রান্স ফ্যাট রয়েছে অধিকাংশ হাইড্রোজেনেটেড তেল ও চর্বি যেমন মার্জারিন, ক্র্যাকার্স, ফ্রেঞ্চফ্রাই ইত্যাদিতে।
এগুলোর বদলে ভালো ফ্যাট আছে যেমন-পাখি বা মুরগির মাংস, বাদাম, অসম্পৃক্ত তেল যেমন ক্যানোলা, অলিভ ও কুসুম তেল ইত্যাদি গ্রহণ করতে পারেন। যেসব খাবারে বেশি দ্রবণীয় আঁশ বা ফাইবার আছে সেসব খাবার খেতে পারেন নিশ্চিন্তে, যেমন-কলা, কমলা, জাম্বুরা, পেয়ারা, আনারস, নাশপাতি, আপেল ইত্যাদি ফল, ওটমিল বা যবের ভুসি, মটরশুঁটি, মসুর ডাল, ঝাড়শিম, বরবটি ইত্যাদি। মাছ ভালো, তবে যেসব মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড অধিক পরিমাণে আছে সেসব মাছ (স্যালমন, টুনা মাছ) খাওয়া ভালো। সব খাবারেই লবণের পরিমাণকে যথাসম্ভব কমাতে হবে। কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না। সারা দিনে বড়জোর একচা-চামচ লবণ খেতে হবে- এর বেশি নয়। মদ বা অ্যালকোহল পান হৃৎপি-ের জন্য ক্ষতিকর। কি খাবো তা ভাবা দরকার
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে ১ হাজার কোটি মানুষের টেকসই জীবনধারণ নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যাভ্যাসে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে বছরে ২৩.৬ শতাংশ বা ১ কোটি ১৬ লাখ লোকের অকাল মৃত্যু ঠেকানো যাবে। এজন্য তারা সুপারিশ করেছেন লাল মাংস খাওয়া অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি বাদাম, ফল, শাকসবজি খাওয়ার পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির গড়ে রোজ ২৫০০ কিলোক্যালরি শক্তির দরকার হয়। এ শক্তি আসে খাদ্য থেকে। সেটা শুধু ভাত খেলেও আসে, অন্যান্য খাবার খেলেও আসে। কিন্তু শুধু শক্তিদায়ক খাবার যেমন-চাল, আটা, রুটি, চিনি, মিষ্টি এসব না খেয়ে অন্যান্য খাদ্যের সমন্বয়ে একটি সুষম পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের পরিকল্পনা করে তা খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট রোজ কোন খাবার কতটুকু খেলে তা স্বাস্থ্যসম্মত হতে পারে ও রোগাক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারে সে বিষয়ে একটি তালিকা দিয়েছেন। সে অনুসারে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকে রোজ ৩০০ গ্রাম শাকসবজি, ২০০ গ্রাম ফল, ৫০ গ্রাম শ্বেতসারযুক্ত সবজি (যেমন আলু), ৪০ গ্রাম অসম্পৃক্ত তেল (সয়াবিন, রাই সরিষা, সূর্যমুখী, বাদাম তেল), ৩১ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম চীনাবাদাম, ১৪ গ্রাম গরু বা খাসির মাংস, ২৫ গ্রাম সয়াজাত খাদ্য, ২৫ গ্রাম আখরোট, ২৯ গ্রাম মুরগি বা হাঁসের মাংস, ৫ গ্রাম চর্বিজাতীয় খাবার, ৬.৮ গ্রাম পামতেল, ২৫০ গ্রাম দুধ বা দুধজাতীয় খাদ্য, ২৩২ গ্রাম খাদ্যশস্য (চাল বা আটা), ৫০ গ্রাম ডাল, ২৮ গ্রাম মাছ ও সপ্তাহে দেড়টা ডিম (দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯) খাওয়া উচিত।
তবু রোগ থেকে সাবধান থাকতে চাইলে সাধারণ পাঁচটা নিয়ম তো পালন করতে পারি, যেমন:
ি টাটকা শাকসবজি, ফল, দানাশস্য ও কম-ফ্যাটযুক্ত দুধ বা দুধজাতীয় খাবার খেতে হবে।
ি প্রোটিন বা আমিষ গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম, শিমের বিচি, বাদাম- এসব যতটা কম খাওয়া যায় তত ভালো।
ি তেল, ঘি, মাখন, লবণ ও চিনি না খাওয়া উত্তম, খেলেও তা ন্যূনতম পরিমাণে খেতে হবে।
ি প্রক্রিয়াজাত ও টিনজাত খাবার পারতপক্ষে পরিহার করতে হবে। এসব খাবারের মধ্যে অনেক খাবারে বিভিন্ন রঙ ও প্রিজারভেটিভ কেমিক্যাল থাকে, যা ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, যদি আমরা সুস্থ থাকতে চাই তাহলে প্রত্যেকেরই দিনে অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা দৈহিক পরিশ্রম বা কাজ করা উচিত। নিদান পক্ষে ৪৫ মিনিট হাঁটা।

 

মৃত্যুঞ্জয় রায়

উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবা : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityun@yahoo.com