Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পাটজাত ফসল ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শক্তি

বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাটের স্থান শীর্ষে। পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে ‘সোনালী আঁশ’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং প্রায় ১৬ লক্ষ টন (৬৫-৭০ লক্ষ বেল) পাট আঁশ উৎপন্ন হয়। পাট মৌসুমে বাংলাদেশে দেশি ও তোষা উভয় জাতের পাটের পাতাই সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাট ফসলের  বীজ বপনের পর ২০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ২ অথবা ৩ বার গাছ পাতলাকরণের মাধ্যমে সাধারণত এই কচি পাটপাতা সংগ্রহ করা হয়। বিভিন্ন  প্রয়োজনীয় কারণেই পাটের গাছের সংখ্যার চেয়ে জমিতে অতিরিক্ত বীজ বপন করা হয়। প্রায় ৫ থেকে ১০ লক্ষ কচি পাট গাছ এইভাবে পাট ফসলের জমি থেকে পাতলাকরণের মধ্যমে সরিয়ে ফেলা হয়। এইভাবে ১ হাজার থেকে ২ হাজার কেজি সবুজ পাতা যাহা ২০০ থেকে ৪০০ কেজি শুকনা পাতার সমপরিমাণ হয়। হেক্টরপ্রতি পাটশাকের ফলন প্রায় ৩.০-৩.৫ টন হয়ে থাকে। এই ভাবে সংগ্রহীত পাটপাতা সারা দেশে সবজি হিসেবে এবং কোন কোন স্থানে অতিরিক্ত হলে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভেষজ হিসেবে পাটপাতার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে। পাটের পাতার রস রক্তপিত্তনাশক, বাতনিরোধক, ক্ষুধাবৃদ্ধিকারক, আমাশয়, উদরাময় ও অম্লরোগের মহৌষধ। শুকনা পাতা ভেজে সবজি হিসেবে ভাতের সাথে খেলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কাঁচা পাতা শাক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত একটি ভেষজ। আজও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেটের  পাহাড়ি অঞ্চলে এবং মিসর, আরব, প্যালেস্টাইনে পাটপাতাকে বাগান সবজি হিসেবেই চাষ করা হয়। গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে পাটপাতার ব্যবহার এত হরেক রকম যে, তা বলে শেষ করা যায় না। কিন্তু এ কথা স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রাচীনকালে সবজি ও ওষুধ হিসেবেই প্রথম পাটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল।   


মেস্তা মূলত উষ্ণম-লীয় দেশে চাষ হয়। পাটের তুলনায় অনুর্বর মাটিতেও মেস্তা বেশ ভালোভাবেই জন্মানো যায়। অন্যান্য মৃত্তিকা  এবং জলবায়ুগত চাহিদা মোটামুটি পাটের অনুরূপ। প্রায় তিন শতাব্দী পূর্ব থেকেই মেস্তা এশিয়াতে চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই মেস্তার চাষ হয়ে আসছে। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও যশোহর জেলার উঁচু জমিতে বেশ সফলতার সাথে আবাদ করা যায়। অন্যান্য জেলার উঁচু জমিতেও মেস্তা আবাদ করা সম্ভব। মেস্তার পাতা আঙুলাকৃতি (খ-িত), গাঢ় সবুজ। পাতা মসৃণ এবং স¦াদ টক ও সুস¦াদু। পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো এবং পরিণত বয়সে তামাটে লাল হয়ে থাকে। ফুলের রঙ হলুদ, তবে ভেতরের মাঝখানে গাঢ় খয়েরি। ফুল আসতে ১৩০ থেকে ১৪০ দিন সময় লাগে, পাতা ও বৃতি সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। ফল ক্যাপসুল আকৃতির উপরের দিকে চোখা এবং  রোমযুক্ত। একটি গাছে ৪০-৬০টি ফল হয়। বৃতির ফলন ২.০০-২.৫ টন/হেক্টর। বীজ ধূসর রঙের কিডনি আকারের। মাঠে  ফসল হিসেবে চাষের পরিমাণ অনেক কম তবে বাড়ির আঙিনায় সবজি হিসেবে চাষ করা হয়ে থাকে।    
পাটশাকের পুষ্টিগুণ   
পাটের পাতার পুষ্টিগুণ খুবই অবাক হওয়ার মতো। তবে সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ার ফলে এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। বাজারে বহু শাক পাওয়া যায়। যেমন- পুঁইশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক, মুলাশাক ইত্যাদি। এসব শাকের মধ্যে পালংশাক আমাদের কাছে বহুল পরিচিত,  পুষ্টিকর, মূল্যবান ও প্রিয় শাক। এই পালং শাকের সাথে পাট শাকের পুষ্টিমানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে পাটশাকে  পুষ্টিমানের গুরুত্বের বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সারণি-১ এর মাধ্যমে তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে পাটশাকের পুষ্টিমান খুবই উন্নত। অন্যান্য শাকের তুলনায় পাটপাতায় প্রচুর পরিমাণে শক্তি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন ও ভিটামিন-সি বিদ্যমান। অতএব ওষুধ হিসেবে দাঁত ও পেটের নানাবিধ সমস্যায় বা সবজি হিসেবে পুষ্টিহীনতায় এবং রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে পাটপাতার ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম।
পাটশাকের ঔষধি গুণ
চিকিৎসা শাস্ত্র গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’ এ পাটের ঔষধি গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, পাটশাক রক্তপিত্ত বিনাশকারী, প্রস্রাবের কষ্টজনিত রোগ উপশমকারী এবং বাতের প্রকোপ হ্রাসকারী। কবিরাজি চিকিৎসা শাস্ত্র মতে, তিতা পাট অর্থাৎ দেশী পাটের পাতার রস আমাশয়, জ্বর ও অম্লবিনাশে অমোঘ ওষুধ। ইহা ক্ষুধা ও হজম বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ট পরিষ্কারক হিসেবে খুবই উপযোগী। আবার মিঠা বা তোষা পাটের পাতার রস ও হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে খেলে জটিল রক্ত আমাশয় নিরাময় হয়। মিঠা পাটের পাতা ভিজিয়ে পানি খেলে প্রস্রাব বৃদ্ধি, মূত্রাশয়ের জ্বালাপোড়া দূর হয় এবং শরীরের বল বা শক্তি বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাটের পাতার বহুল ব্যবহার প্রচলিত আছে। পাট সাধারণত বর্ষা মৌসুমের ফসল, তখন বেশির ভাগ এলাকায় পাটশাক সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যদি অন্য মৌসুমে পাতার প্রয়োজন হয়, তবে পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে সযতেœ সংরক্ষণ করা যেতে পারে।       
মেস্তাশাক ও চুকুরের পুষ্টিগুণ   
মেস্তার পাতা ও ফলের মাংসল বৃতি (শাঁস) টক ও সুস¦াদু। রান্না করে খাওয়া যায়। এর মাংসল বৃত্তি থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা জাতীয় পানীয় ইত্যাদি তৈরি করা হয়ে থাকে। এর ফলকে জনপ্রিয় নাম হিসেবে চুকুর বলা হয়। এই চুকুরের পাতা ও  ফলে প্রচুর পরিমাণ প্রেটিন, ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও  অন্যান্য খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। এক হেক্টর জমি থেকে ৭৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং  ২০০০-২০৫৫ কেজি প্রায় বৃতি উৎপন্ন হয়। মেস্তার খৈল গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকে প্রায় ২০% খাদ্য উপযোগী তেল পাওয়া যায়। এই তেলে ১৫.৮% পালমিটিক এসিড, ৬.৮% স্টিয়ারিক এসিড, ৫১% অলিক  এসিড ও ২৬.৮%  সিনোলিক এসিড থাকে। ফলে পৃথিবীর বহু দেশে সাবান তৈরিতে এবং পরিশোধিত তেল খাবার তেলে মিশাতে  ব্যবহৃত হয়।            
পাটশাক, মেস্তাশাক ও মেস্তাফলের (চুকুর) ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের বড় চাষিরা পাটের মৌসুমে জামিতে আন্তঃপরিচর্যার জন্য শত শত শ্রমিক নিয়োগ করে। এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের সকাল বা দুপুরের খাবার দেয়া হয় ভাতের সাথে পাট বা মেস্তাশাক, ডাল, মরিচ এবং কখনো কখনো অন্য কোন একটি তরকারি। এ ক্ষেত্রেও প্রচুর পরিমাণে পাটশাক সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শহর অঞ্চলের বড় বড় কাঁচাবাজারগুলোতে পাটের শাক প্রায় বছরের সব সময়ই পাওয়া যায় এবং বহুলভাবে কেনাবেচা হয়। একটি প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গেছে ৩২০ সেঃ তাপমাত্রায় ৮ ঘণ্টা ইলেকট্রিক্যাল ওভেনে পাটের পাতা শুকানোর ব্যবস্থা  করলে পাতার রঙ নষ্ট না হয়ে সবুজ থাকে। এই অবস্থায় পাতায় পানির পরিমাণ থাকে প্রায় শতকরা ৮ ভাগ। এই ধরনের শুকনা পাতা ১৬ ম্যাস ছাঁকনির পরিমাপে পাউডার করা সম্ভব। তবে সাধারণভাবে পাটপাতা ঘরের তাপমাত্রায় ছায়ার মধ্যে শুকানোর ব্যবস্থা করলেও এর সবুজ রঙ অটুট থাকে। বাংলাদেশে ভাত হলো আমাদের প্রধান খাদ্য, সেখানে পাট পাতা শাক হিসেবে, সুপ হিসেবে, ভেজিটেবল চপ এবং ভাজা পাতা হিসেবে খাওয়ার প্রচলন তৈরি করা খুবই সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ। পাট ও মেস্তা গ্রীষ্মের ফসল, তবে বছরের যে কোনো সময় সবজি হিসেবে পাট ও মেস্তা পাতার উৎপাদন করা সম্ভব। তা ছাড়া যে কোনো সময়ে উৎপাদিত পাতা শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে বছরের যে কোনো সময় চাহিদা মতো ব্যবহার করা চলে।  
উপরোক্ত বিষয়গুলো অনুধাবন করে পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে জাপান, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় পাটশাক ও মেস্তার ফল চুকুরকে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার সমস্যা ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে পাটশাক, মেস্তাশাক ও মেস্তাফলের ব্যবহার আরো  জনপ্রিয় করে তোলা গেলে সমস্যার কিছুটা হলেও সহজেই সমাধান করা সম্ভব। একটি প্রবন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায় ‘সেই রমনী ভাগ্যবতী, যিনি প্রত্যহ স্বামীকে গরম ভাতের সাথে ঘি, মাছের ঝোল ও পাটশাক সহযোগে আহার্য পরিবেশন করেন। এ যুগের রমনীদের বেলায় এ কথা কতটুকু পালনীয় সেদিকে দৃষ্টি না দিলেও, এ কথা বিশ্বাস অবশ্যই করতে হবে যে, প্রাচীন বাংলায় পাটশাকের জনপ্রিয়তা ও আভিজাত্যের উপস্থিতি ছিল। পাটশাক, মেস্তাশাক ও চুকুরফল ব্যাপক পুষ্টিগুণ ও বিভিন্ন ঔষধিগুণে গুণান্বিত। এসবের পুষ্টিগুণ, সুস্বাদুতা ও ঔষধিগুণের বিষয়াদি নিয়ে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ ও ব্যাপক প্রচারণা করা গেলে, পাটশাক, মেস্তাশাক ও চুকুর ফল পুনরায় তার প্রাচীন গৌরবে অভিজাত খাদ্য তালিকায় ফিরে আসতে পারবে এবং ভবিষ্যৎ পুষ্টি ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

 

কৃষিবিদ ড. মো: মাহবুবুল ইসলাম

মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭,  মোবা : ০১৫৫২৪১৬৫৩৭, ই- মেইল : mabbub_agronomy@yahoo.com