Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে মিষ্টি ফসলের গুরুত্ব

পুষ্টিকর খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রথম এবং প্রধান উপজীব্য। যা প্রথম শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি কৃষিকে ঢেলে সাজানোর প্রয়াস নিয়েছিলেন। কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন এদেশের মিষ্টি ফসলের ভিত্তি। কারণ  মিষ্টি ফসলের সব উদ্ভিদ উৎসই পুষ্টিক এবং এগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। ফলে ভবিষ্যতের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অল্প জমিতে অধিক পুষ্টিকর খাবার উৎপাদন করতে মিষ্টি ফসলই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি ফসল আখ। আখ থেকে হয় রস, গুড়, চিনি। আখের পাশাপাশি রয়েছে তাল, খেজুর, গোলপাতা, স্টেভিয়া, সুগারবিট, মধু, যষ্টিমধু প্রভৃতি। তাল থেকে হয় রস, গুড়, তালমিছরি প্রভৃতি। খেজুর ও গোলপাতা থেকেও হয় রস, গুড়। সুগারবিট থেকে হয় গুড়, চিনি, মাছের খাবার, গবাদি পশুর খাবার প্রভৃতি। স্টেভিয়া, যষ্টিমধু এবং মধুর পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সর্বজনবিদিত। আর বড় কথা হলো এসব খাবারের পাশাপাশি ওইসব ফসলভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের খাদ্য শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। তাতে রয়েছে দারিদ্র্য মোচনেরও অপার সম্ভাবনা। এসব ছাড়াও তাল থেকে তৈরি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি তাল গাছ বজ্রপাতের বিপদ থেকে রক্ষা করে। এখানে আলোচিত ফসলগুলোর মধ্যে আখ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু। তবে তাল ও খেজুর গাছও প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে। বিশেষ করে বজ্রপাত নিরোধে তালগাছের ভূমিকা অপরিসীম।
পরিবারের আয় এবং পুষ্টির চাহিদা মেটাতে আখ চাষ
আখ মিষ্টি ফসল এবং পুষ্টিকর ফসল। আজকাল সারা দেশে সারা বছর উপজেলা শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটি বাজারের কোণায় কোণায় চিবিয়ে খাওয়া আখ ব্যাপক হারে বিক্রি হয়। যার বাজারদর এলাকা ভেদে ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিটি আখের দাম অপেক্ষাকৃত কম হলেও মধ্য, দক্ষিণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে দাম ও চাহিদা খুবই বেশি। এক বিঘা জমিতে ৩০০০টি চিবিয়ে খাওয়া আখের চারা রোপণ করা যায়। এক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ১ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি.। এক বিঘা অর্থাৎ ১৩৪৯ বর্গমিটার জমিতে ওই মাপে লাগানো হলে ২৯৯৮ বা ৩০০০টি চারা লাগানো যাবে। সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে এটা রোপণ করে, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে গাছ প্রতি কমপক্ষে ৫টি কুশি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ঝাড় প্রতি ১টি মাতৃগাছ এবং ৫টি কুশি অর্থাৎ ৬টি আখ পাওয়া যাবে। সুতরাং ৩০০০টি ঝাড়ে ৩০০০ী ৬=১৮০০০টি আখ পাওয়া যাবে) তা থেকে ১৮০০০টি সুস্থ ও সবল আখ উৎপাদন করা সম্ভব। সর্বনিম্ন বাজারদরে (১০টাকা) তা বিক্রি করেও এ থেকে ১,৮০,০০০/-টাকা আসবে যার চাষাবাদ থেকে বিক্রি পর্যন্ত মোট খরচ হয় প্রায় ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা। অর্থাৎ নিট লাভ হয় ১,৫০,০০০ টাকা। এটা গেল আখের হিসাব। আখ ছাড়াও ওই জমিতে সাথী ফসল চাষ করে প্রায় ১০,০০০-১৫০০০ টাকা নিট লাভ হবে। এ টাকা দিয়ে চাষি তার আখ চাষের ওই খরচ মিটাতে পারবে। যদিও বলা হয় আখ ১২-১৪ মাস মাঠে থাকে কিন্তু এর পরিপক্বতার জন্য  ১০-১২ মাসই যথেষ্ট। তদুপরি যদি চিবিয়ে খাওয়ার আখ হয় তাহলে তা ৭-৮ মাসেই বিক্রির উপযোগী হয়। সে কারণেই সঠিক জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আখ চাষ করে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা যেমন সম্ভব তেমনি সম্ভব অধিক উপার্জন এর মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা এবং এভাবেই সম্ভব দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা।
বিভিন্ন মিষ্টি ফসলের পুষ্টিমান
আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের (অর্গানিক লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন) মতে আখের রসের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৪৩। অর্থাৎ এটি নি¤œমাত্রার গ্লাইসেমিক খাবার। তাই ডায়াবেটিক রোগীরাও আখের রস নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় নির্ভয়ে খেতে পারেন। বিভিন্ন ফসলের গুড় ও চিনির পুষ্টিমান    সারণি-১ দেয়া হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রতিকূল এলাকায় যেখানে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করা যায় না কিংবা করেও তা লাভজনকভাবে ধরে রাখা যায় না সেখানেও পুষ্টিকর এসব   মিষ্টি ফসল আবাদের মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
ক) খরাপীড়িত এলাকা
উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকায় আখ ফসল সবচেয়ে বেশি টিকে থাকতে পারে। শুধু তাই নয় যেখানে অন্য সব  ফসল পানির অভাবে মারা যায় সেখানেও আখ ফসল বেঁচে থাকতে পারে এবং পানি পেলে তা আবার পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে। সেজন্যই উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকায় আখ চাষের ব্যাপকতা বেশি। শুধু আখই নয়, খরাপীড়িত এলাকার জন্যও আখের সঙ্গে সাথী ফসল চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আখের পাশাপাশি তাল, খেজুরেরও রয়েছে এই খরাসহিষ্ণু ক্ষমতা।
খ) চরাঞ্চলের বালুময় পতিত জমি
চরের বালিময় পতিত জমিতে আখ চাষ করে, আখের সাথে সাথী ফসল করে এবং গুড় তৈরি করে যথেষ্ট লাভ করার সুযোগ রয়েছে। এর কারণ আখের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গভীরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া চরে অন্যান্য ফসল চাষ করে চাষিরা ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ বন্যায় তা ডুবিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অথচ আখ এমন একটি ফসল যা ১২ -১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যায় এর নিম্নাংশ ডুবে থাকলেও কোনো ক্ষতি হয় না। আবার চরে যেসব স্বল্পমেয়াদি ফসল হয় সেগুলো সাথী ফসল হিসেবে আখের সাথে চাষ করা যায়।
গ) দক্ষিণাঞ্চলের  লবণাক্ত এলাকা
লবণাক্ততার কারণে যেখানে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করা যায় না সেখানেও আখ ফসল বেড়ে উঠতে পারে। একমাত্র আখ ফসল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতি মিটারে ১৫ ডিএস মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই লবণাক্ত এলাকারও লাভজনক ফসল আখ। আখ ছাড়া সুগারবিটও লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
ঘ) পাহাড়ি এলাকা
পাহাড়ি এলাকায় আখের বাজার দর অপেক্ষাকৃত বেশি। অল্প জমি ব্যবহার করে সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে এত বেশি আয় করা শুধু আখ চাষের মাধ্যমেই সম্ভব। একইভাবে পাহাড়ি এলাকায় গুড়ের দামও বেশি। তাই ওখানকার মানুষ গুড় করেও বেশি লাভ করতে পারেন। পাহাড়ি এলাকায় তাল ও খেজুর ফসল চাষের সম্ভাবনাও যথেষ্ট।
ঙ) পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা
হাওর এলাকার অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে অল্প কিছুদিন পরেই পানি নেমে যায়। এসব জায়গাগুলো নির্বাচন করে সেখানে জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু আখের জাত রোপণ করা যেতে পারে। যেমন ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ২১ প্রভৃতি। তাছাড়া হাওরে প্রতি বছর বজ্রপাতের কারণে অনেক সংখ্যক মানুষ মারা যায়। তাই এই এলাকায় অধিক তালগাছ রোপণের মাধ্যমে একদিকে যেমন তালের রস, গুড়, তালমিছরি প্রভৃতি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায় তেমনি এরই পাশাপাশি বজ্রপাত প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
চ) দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা
সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকা যেখানে প্রায় প্রতি বছরই মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়ে ক্ষেতের সব ফসল ল-ভ- করে দেয়, সেখানে আখ ফসল থাকলে তা ওই এলাকার জীবন রক্ষাকারী ফসলে পরিণত হয়। কারণ ঘূর্ণিঝড়ে ল-ভ- সবকিছুতে রান্না করার উপকরণও চলে যায়, ঘরের শুকনা  খাবারও (যদি থাকে) শেষ হয়ে যায়, আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পানীয় জলের। ওই এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে চিবিয়ে খাওয়া আখ থাকলে ঝড়ে তা যত ক্ষতিগ্রস্তই হোক না কেন তা থেকে পানি ও পুষ্টি উভয়ই পাওয়া যেতে পারে। সংকটকালীন ওই সময়ে বাড়ির শিশুদের জন্য তা হয় জীবন রক্ষাকারী খাদ্য। সেকারণেই সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই চিবিয়ে খাওয়া আখের আবাদ করতে হবে। এছাড়া সেখানে তাল গাছের প্রতিরক্ষা বেষ্টনীও গড়ে তোলা যেতে পারে।
অর্থাৎ সারা দেশেই পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য মিষ্টি ফসল চাষ করা প্রয়োজন। বরং উল্টা করে বলা যায় আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে যখন বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরিবর্তনসহিষ্ণু ফসল, সেখানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনসহিষ্ণু ফসল হচ্ছে আখ এবং অন্যান্য মিষ্টি ফসল। আখের রস যেমন  পুষ্টিকর, আখের চাষও তেমনি লাভজনক। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে এলাকাভিত্তিক আখের জাত নির্বাচন করে তার ভালো বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি করা। মনে রাখতে হবে যে আখ চাষের উপকরণ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি-জ্ঞান এবং উৎপাদিত কাঁচামালের বাজার সবই আমাদের দেশেই যথেষ্ট ভালো রয়েছে। তাই দেশের যেকোনো এলাকায় আখচাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। আর এটা করতে পারলেই দেশের চিনি ও গুড় এর জোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা এবং দারিদ্র্যবিমোচনেও যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখা সম্ভব।

 

ড. মো. আমজাদ হোসেন১  ড. সমজিৎ কুমার পাল২
১মহাপরিচালক, ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ফোন : ০৭৩২৬৬৬৬২৮, ই-মেইল : bsridg123 @gmail.com