Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

নাবী পাট ও সাথী ফসল

পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। এই সোনালি আঁশ বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৫-৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ কারণে উন্নত মানের পাট একমাত্র বাংলাদেশে জন্মে। পাট ফসল উৎপাদনের একটি বড় উপাদান হলো উন্নত মানের পাট বীজ। আমাদের দেশে প্রতি বছর আঁশ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৩৫০০-৪০০০ মেঃ টন পাট বীজের প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনীয় বীজের মাত্র ৮-১০% বীজ  বিএডিসি সরবরাহ করে থাকে। বাকি বীজ কৃষকরা স্থানীয় বাজার বা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। কেউ কেউ আবার নিজেদের উদ্যোগে বীজ উৎপাদনও করে থাকেন। কাজেই যে সকল কৃষক ভাইয়েরা নিজেদের উদ্যোগে বীজ উৎপাদন করে থাকেন তার সাথে সাথী ফসল হিসেবে সবজি চাষ করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।

 

সাথী ফসল
কোন জমিতে এক মৌসুমে এক সাথে বা পর্যায়ক্রমিক ভাবে দুটি বা তার বেশি ফসল উৎপাদন করাকে সাথী ফসল বা রিলে ক্রপিং বলে। অর্থাৎ কোন মৌসুমে পাট বীজ ফসল যখন লালশাক, পুঁইশাক, মুলা, ঢেঁড়স, মরিচ  ইত্যাদি ফসলের সাথে উৎপাদন করা হয় তখন তাকে  সাথী ফসল বা রিলে ক্রপিং বলে।

 

নাবী পাট বীজ উৎপাদন পদ্ধতি  
নাবী মৌসুমে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে তিন পদ্ধতিতে পাট বীজ উৎপাদন করা যায়। পদ্ধতিগুলো হলো- ক) সরাসরি বীজ বপণ পদ্ধতি, খ) কা- ও ডগা রোপণ পদ্ধতি এবং গ) চারা রোপণ পদ্ধতি। এদের মধ্যে সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতি এবং  কা- ও ডগা রোপণ পদ্ধতি দুটিই পাট বীজের সাথে সাথী ফসল হিসেবে সবজি উৎপাদন এর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী।

 

সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতি  
এ পদ্ধতিতে ভালো বীজ পেতে হলে  দেশি পাট বীজ শ্রাবণ মাস অর্থাৎ মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট এবং তোষা পাটের বীজ ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি অর্থাৎ ৩০ আগস্ট এর মধ্যে বপন করতে হবে। সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬ গ্রাম তোষা এবং ২০ গ্রাম দেশি বীজ বপন করতে হবে। আর ছিটিয়ে বপন করলে শতাংশে ২০ গ্রাম তোষা এবং ২৪ গ্রাম দেশি পাটের বীজ বপন করতে হবে।


কা- ও ডগা রোপণ পদ্ধতি  
কৃষকের হাতে নাবীতে বপনের জন্য যখন কোন বীজ না থাকে সে বছর আঁশ ফসল থেকে বেছে কা- ও ডগা কেটে নিয়ে বীজ উৎপাদন করা যায়। আঁশ ফসলের জমি থেকে গাছের বয়স ১০০ দিনের মতো হলে সুস্থ সবল গাছ বেছে নিতে হবে। বাছাই করা গাছের কা- ও ডগাগুলো ধারালো চাকু, ব্লেড বা বঁটির সাহায্যে কাটতে হবে যাতে প্রতিটি টুকরার দৈর্ঘ্য  ২০-২৫ সেমি. বা ৮-১০ ইঞ্চি হয় অর্থাৎ প্রতি খ-ে কমপক্ষে ২-৩টি পর্ব বা গিট থাকে। টুকরাগুলো গোড়ার দিকে তেরছা করে কাটতে হবে যাতে বাকল থেঁতলে না যায়। টুকরার তেরছা অংশ যেদিন ডগা সংগ্রহ করা হবে সে দিনই রোপণ করা ভালো। তবে মেঘলা দিনে বা পড়ন্ত রোদে ডগা রোপণ করা উত্তম। দেড় ফুট দূরত্বে উত্তর-দক্ষিণে সারি করে এবং উত্তর দিকে ৪৫ ডিগ্রি কাত করে সেই টুকরাগুলো রোপণ করতে হবে। অতঃপর যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে উভয় পদ্ধতির বীজ যথাসময়ে সংগ্রহ করতে হবে।


পাট বীজের সাথে সাথী ফসল হিসেবে সবজি উৎপাদন
পাট বীজ সাথে লালশাক, পুঁইশাক, বাটিশাক, চীনাশাক, মূলা, গাজর, ঢেঁড়স, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পালংশাক, মরিচ, টমেটো জাতীয় বিভিন্ন রবি ফসলের সাথে বা ক্ষেতের আইলে অথবা নতুন সুপারির বাগান বা আম, লিচু এ জাতীয় বিভিন্ন নতুন বাগানে সাথী ফসল হিসেবে  উৎপাদন করা যায়। এই সমস্ত ফসল সারিতে বপন বা রোপণ করে দুটি সারির মাঝখানে সারি করে পাট বীজ বপন করতে হবে।


নাবী পদ্ধতিতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পাট বীজ উৎপাদনের জন্য সময় লাগে প্রায় ১২০ দিন। তবে আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে এই সময় কম বেশি হতে পারে। লালশাক, বাটিশাক, চীনাশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পালংশাক, পুঁইশাক ইত্যাদি ফসল আলাদাভাবে প্রয়োজনীয় দূরত্বে সারি করে বীজ বপন করতে হবে এবং সারির মাঝ দিয়ে আবার সারিতে সরাসরি পাট বীজ বপন করে অথবা কা- বা ডগা রোপণ করে পাটবীজ উৎপাদন করা যাবে। পাট বীজ সংগ্রহ করার আগেই এই সমস্ত শাক সংগ্রহ করে খাওয়া বা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যাবে। আবার পাট বীজ সংগ্রহ করার কিছু আগেই সেই জমিতে সারিতে ঢেঁড়স এর বীজ গর্ত করে লাগানো যাবে, পাট বীজ সংগ্রহ করার পর সেই ঢেঁড়স গাছ বড় হয়ে পরবর্তীতে ফলবান হবে। একই ভাবে টমেটো বা এ জাতীয় অন্যান্য ফসলও চাষ করা যাবে।


পাট বীজ ফসলের সাথে শাকসবজি চাষ পদ্ধতি  
-রবি মৌসুমেও বীজ ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবে শাকসবজি চাষ করা যায়। একই জমিতে পাট বীজ ফসলের সাথে শাকসবজি চাষ করে কৃষকের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও পাটের চাহিদা মেটানো যায়। এতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা যায়। শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি (আগস্টের প্রথম) থেকে পুরো ভাদ্র মাস চাষ (১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত উঁচু জমিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার উপযোগী।
-শীতকালে অর্থাৎ রবি মৌসুমে  আগাম শাকসবজির (লালশাক, মুলা, পালংশাক, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি) সাথে জমিতে পাট বীজ একই সাথে সারিতে চাষ করা যায়।
-শতাংশ প্রতি ২ কেজি জৈবসার বীজ বপনের ২০-২১ দিন  আগে প্রথম চাষের সময় প্রয়োগ করে ভালো ভাবে জমি চাষ করতে হবে। জমির শেষ চাষের সময় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়।
-শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ৯০০ গ্রাম, টিএসপি ৬০০ গ্রাম, এমওপি ৩৭৫ গ্রাম, জিপসাম ৬০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের দিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইউরিয়া (অর্থাৎ অর্ধেক   ইউরিয়া), টিএসপি, এমপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট সার জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করে মই দিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।


-দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর লালশাক সম্পূর্ণভাবে তুলে এবং আগাছা তুলে জমিতে  উপরিপ্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস থাকে।
- প্রথমে ক্ষেতের চার পাশে মুলা/পালংশাকের বীজ ক্ষেতের সীমানা থেকে ১০ সেমি. ভেতরে লাইনে বপন করতে হবে। তারপর মূলা/পালং শাকের ১৫ সেমি. ভেতরে প্রথমে দুই লাইন পাট এরপর দুই লাইন সবজি এবং প্রতি দুই লাইন ফসলের মাঝে এক লাইন করে লালশাক বপন করতে হবে।


এ ছাড়া উপযুক্ত সময়ের সাথে সমন্বয় করে  মুলা, গাজর, মরিচ এর বিভিন্ন জাতের বীজ সারিতে বপন করে সারির মাঝ দিয়ে পাট বীজ বপন করা যাবে। এ প্রক্রিয়ায় ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, জমি যেন সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। পোকামাকড়, রোগজীবাণু থেকে ফসলকে মুক্ত রাখার জন্য সঠিকভাবে আন্তঃপরিচর্যা ও আগাছা দমন করতে হবে।
আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য কোন জমিতে শুধু পাট বীজ উৎপাদন না করে এর সাথে সাথী ফসল হিসেবে এক বা একাধিক শাক বা সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন করে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যায়।

 

কৃষিবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বিজেআরআই, ঢাকা, মোবাইল : ০১৫৫২৯৯৯১৪৯, ই-মেইল :tanny.jannat92@gmail.com