Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পরিবেশবান্ধব ও পুষ্টি সমৃদ্ধিতে পাট

কৃষিবিদ মোঃ মুকুল মিয়া

পাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় অর্থকারী ফসল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পাটখাতের রপ্তানি আয় ছিল ৮৯.৮৬ শতাংশ। তখন পাটজাত দ্রব্যের চেয়ে কাঁচা পাট রপ্তানি করে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো যা দেশের অর্থনীতিতে সোনালি যুগের সৃষ্টি করে। কাঁচা পাট রপ্তানি করে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো বলে এই বাংলার পাট বা পাটের আঁশ ‘সোনালি আঁশ’ নামে পরিচিত হয়।


বিশ্বে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় হলেও রপ্তানিতে ১ম স্থান দখল করে নিয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ পাটের ঐতিহ্য রক্ষার্থে পাটের প্রতি বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোবাসার কারণেই ক্রমাগত পাটের চাষ বেড়ে যাচ্ছে। পাট ছাড়াও বাংলাদেশে অন্যান্য আঁশ ফসল যেমন কেনাফ Hibischus cannabinus ও মেস্তার (Hibischus sabdariffa চাষ করা হয়। এ ফসলগুলো প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী এবং কম খরচে পতিত জমিতে চাষাবাদযোগ্য। পাট গাছের ছাল থেকে উৎপন্ন হয় আঁশ যা ফ্লোয়েম তন্তু বা বাস্ট ফাইবার নামে পরিচিত। গাছের ভেতর থেকে উৎপন্ন হয় কাঠি। এ দেশে তোষা পাটের চেয়ে দেশি পাটের চাষ বেশি হতো যার অনুপাত ছিল ২০ ঃ ৮০, কিন্তু বর্তমানে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণে এটির অনুপাত বিপরীত অর্থাৎ তোষা ঃ দেশি = ৮০ ঃ ২০। বিজেআরআই কর্তৃক এ পর্যন্ত দেশি পাটের ২৭টি (আঁশের জন্য ২৪টি, দেশি শাকের জন্য ৩টি), তোষাপাটের ১৮টি, কেনাফের ৪টি এবং মেস্তার ৩টি জাতসহ সর্বমোট ৫২টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৮-৯ লাখ হেক্টর জমিতে পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের চাষ হয়ে থাকে যা থেকে প্রায় ৮৫-৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। দেশের কৃষি জিডিপিতে পাটের অবদান ১.৪ শতাংশ; জিডিপিতে পাট খাতের অবদান ০.২৬ শতাংশ। বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র অধিক পরিমাণে কাঁচা পাট আঁশ রপ্তানিকারক দেশ। এর মূলে রয়েছে বিশ্বব্যাপী পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহারে অনাগ্রহ। পাট একটি পরিবেশবান্ধব আঁশ ফসল। পাটের আঁশমূলত সেলুলোজ এবং লিগনিন দ্বারা গঠিত। এই সেলুলোজ সংগ্রহ করে এক ধরনের বায়ো ডিগ্রেডে বল শিট উদ্ভাবন করা হয় যা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই বায়ো ডিগ্রেডে বল প্লাস্টিক শিট থেকে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এক ধরনের পলিথিনব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ‘সোনালিব্যাগ’ নামে পরিচিত। এই সোনালিব্যাগ এর উদ্ভাবক বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা  ড. মোবারক আহমদ। ‘সোনালিব্যাগ’ নামটি দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও, এই বিজ্ঞানী ২০০৯ সালে পলিমারের মিশ্রণে পাট থেকে আবিষ্কার করেন জুটিন (পাটের ঢেউটিন)। দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বা পলিথিন বা পলিইথাইলিন থেকে উৎপাদিত পলিথিনব্যাগ মাটিতে সহজে মিশে যায় না। এর ক্ষতিকর উপাদানগুলো প্রায় ১০-১৫ বছর মাটিতে থেকে যায় যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে, ফসলের উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে, পলিথিন পোড়ানোর পরে এ থেকে উদ্ভ‚ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বনমনোঅক্সাইড পরিবেশের ব্যাপক দূষণ ঘটায়, শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। অপরদিকে, পাটের আঁশের সোনালিব্যাগ ৪-৫ মাস পরে সহজে পঁচে যায়, মাটিতে সারের কাজ করে এবং পরিবেশেও কোনো ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে না। সোনালিব্যাগে  খাদ্যসামগ্রী ও পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী বহন করা যাবে স্বাচ্ছন্দ্যে। পাটের তৈরি পলিমারের ব্যাগ সাধারণ পলিব্যাগের চেয়ে দেড়গুণ টেকসই ও মজবুত। পানি নিরোধক এই পলিব্যাগ পলিথিন ব্যাগের চেয়ে কম মূল্যে পাওয়া যাবে। সহজলভ্য উপাদান এবং সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এ সোনালিব্যাগ বিদেশে রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য সোনালিব্যাগের উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে বাড়াতে হবে এবং সেইসাথে বাজারে পলিথিনব্যাগ নিষিদ্ধ করে সোনালিব্যাগ ব্যবহারের  জন্য আইন করা জরুরি।


পরিবেশের ভারসাম্য এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় এর অবদান অপরিসীম। পাটগাছের মূল মাটিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ সেমি. গভীরে প্রবেশ করে মাটিতে থাকা অজৈব তরল খাদ্য মাটির উপরে নিয়ে আসে। এর ফলে অন্যান্য অগভীর মূলবিশিষ্ট ফসল সমূহের চাষাবাদে মাটির পুষ্টির সমস্যা হয় না এবং মাটির গুণাগুণও ঠিক থাকে। পাট ফসলের চাষাবাদে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে মিশে নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম যোগ করে। এছাড়াও, পাটগাছ কাটার পর জমিতে থাকা পাটের গোড়া মাটিতে পচে গিয়ে জৈব সারে পরিণত করে। পাট পচানো পানি জমির জন্য উপকারী। পাট ফসল চাষে কৃষকের খরচ খুব কম লাগে। সার ও কীটনাশক খুব কম লাগে। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট চাষে ১০০ দিন বয়সে পাটগাছ প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে। পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের আঁশ ও কাঠি থেকে পেপার পাল্প তৈরি করা যায়, জ্বালানি হিসেবে, ঘরের বেড়া, ছাউনি তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। বাঁশ ও কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মÐ ও কাগজ তৈরিতেও পাটকাঠি ব্যবহৃত হয়। পাটকাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের ফলে বন উজাড়ের প্রবণতা কমবে, পরিবেশ ও প্রাণিকুল ভালো থাকবে। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বনের গুণগতমান সর্বাধিক। তাই বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ও মূল্য দুটিই বাড়ছে। এছাড়াও পাট কাঠি থেকে কয়লা/চারকোল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাল্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিএমডবিøউ কোম্পানি পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিনকার’ যার চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি।


পাটের বহুবিদ ব্যবহারের পাশাপাশি শুকনো পাটপাতার পানীয় ‘চা’ হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। এছাড়াও মেস্তার মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা উদ্ভাবন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে এই ঐতিহ্যবাহী স¦নামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখ্য যে, পাটপাতা এবং মেস্তারবৃতি থেকে উৎপাদিত পানীয় ‘চা’ এর কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বলে জানা যায়। তাছাড়া, বিজেআরআইসহ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে এই পানীয় ‘চা’ ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং খুব কম মূল্যে পাটপাতা এবং মেস্তারবৃতি থেকে উৎপাদিত পানীয় ‘চা’ ব্যবহার করা যেতে পারে।


পাটফসল শুধু আঁশের উদ্দেশ্যেও চাষ করা হয় না, শাক হিসেবেও পাটপাতা খাওয়া যায়। দেশিপাট পাতা স্বাদে তিতা, আর তোষাপাট অনেকটা মিষ্টি লাগে। বর্তমানে প্রচলিত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দেশিপাট শাকের পুষ্টিসমৃদ্ধ ৩টি জাত : বিজেআরআই পাট শাক-১, সম্প্রতি উদ্ভাবিত বিজেআরআই পাটশাক-২ (ম্যাড়ালাল) এবং বিজেআরআই পাট শাক-৩ (ম্যাড়াসবুজ)। এই জাতগুলো শাকের জন্যই চাষ করা যায়, আঁশের জন্য নয়। কারণ, এ জাতগুলো খাটো এবং ঝোপালো হয়। দিন নিরপেক্ষ বলে এ জাতগুলো দেশের সব ধরনের জমিতে প্রায় সারাবছর চাষ করা যায়। মৃদু লবণাক্ত এলাকাতেও চাষ করা যায়। রোগবালাই ও প্রতিক‚ল পরিবেশ সহনশীল এই জাতসমূহ অল্প যত্ন ও কম খরচে চাষ করে ২৫-৩০ দিন পর কয়েক বার শাক খাওয়া যায়। গড়ে প্রতি ১০০ গ্রাম পাটশাকে ক্যালরি থাকে ৭৩ গ্রাম, আমিষ ৩.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২.১৫ গ্রাম, পটাশিয়াম ১.৬৪ গ্রাম, প্রোটিন ২০.৫ গ্রাম; প্রতি কেজিতে থাকে আয়রন ০.৭৯ গ্রাম, ভিটামিন-এ ১২৬.৪৫ মিগ্রা., ভিটামিন-সি ৭৫১.১৭ মিগ্রা.। তাছাড়া পাটশাকে রয়েছে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যানসার প্রতিরাধী উপাদান, ক্যারোটিন এবং খাদ্যআঁশ। এ সকল উপাদান মানুষের শরীরে হাড় ভালো রাখে; হজমে সাহায্য করে; খাবারে রুচি বাড়ায়; কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে; স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখে; নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হয়; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে; কোলেস্টেরল কমায়; হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়; হিমোগেøাবিন তৈরি করে; তাপমাত্রা এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়; বাতব্যথা দূর করে; উচ্চমাত্রার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। এর ফলিক অ্যাসিড ত্বক ও চুল সতেজ রাখে। তাই এই সকল রোগের জন্য পাটশাক একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ্য।


পাট বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। পাটের   সোনালিআঁশ ও রূপালীকাঠি দুইয়েরই বহুমুখী ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এনে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার পথ। ‘সোনালিআঁশের সোনার দেশ, পাটপণ্যের বাংলাদেশ’ এই স্লোগান বাস্তবায়িত করলে অবশ্যই বাংলাদেশ একদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশে পরিণত হবে বলে আশা করি। পলিব্যাগের বিকল্পে সোনালিব্যাগ করি ব্যবহার, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করি সবার, এটাই হোক সবার অঙ্গীকার।

সাইন্টিফিক অফিসার, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিকমিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল:  ০১৫২০-০৮৩০৮৮, ই-মেইল: mukulbjribreeding@gmail.com