Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মৎস্য খাত : আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ

কাজী শামস আফরোজ

‘সবাই নিয়ে একসাথে বিকশিত হোন, শরীরের যতœ নিন, সুস্থ থাকুন। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ’। এ প্রতিপাদ্যে উদযাপন হচ্ছে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও কাক্সিক্ষত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জনে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের আপামর জনগণের পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের যোগান আজ অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ দেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু ১৬ কোটির অধিক জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহের মাধ্যমে সুষম খাবারের নিশ্চয়তা বিধানে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি সেক্টর-সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্যখাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট জিডিপির ৩.৫০ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি (২৫.৭২ শতাংশ) মৎস্যখাতের অবদান (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)। বিগত ৫ বছরে মৎস্যখাতে গড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬.২৮ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ আসে মৎস্যখাত হতে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক মানুষ এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের সাফল্য আজ বিশ্বজন স্বীকৃত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ধীরগতিসম্পন্ন হলেও বিগত এক দশকে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৯.১%, যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় এবং বিশে^ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ ৩য় স্থান এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান যথারীতি ধরে রেখেছে। পাশাপাশি বিশ্বে সামুদ্রিক ও উপক‚লীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স ও ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম স্থান অধিকার করেছে।


সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মৎস্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার ১৪২৩ এ স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়েছে। এসব অর্জন সরকার কর্তৃক মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বাস্তবায়িত যথোপযুক্ত কার্যক্রমেরই ফলাফল।


ভিশন-২০২১, বাংলাদেশ ঃ সমৃদ্ধ আগামী প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত অগ্রাধিকারমূলক সেক্টর-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসমূহ বিশেষত- পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, দারিদ্র্য নির্মূল, আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থা- লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ, বøু-ইকোনমি- সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন-কে সামনে রেখে সমন্বিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এর মৎস্য সেক্টর-সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনের উদ্দেশ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে টেকসই করার লক্ষ্যে সরকার চলমান বহুবিধ সমাজ ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য সময়োপযোগী ও লাগসই কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে গৃহীত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমসমূহ হলো:


অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের আবাসস্থল উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ; বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে উৎকর্ষতা সাধন; পরিবেশ ও সমাজবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ; সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সহনশীল আহরণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা; জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থার উন্নয়ন; পুষ্টি-সংবেদনশীল মৎস্যচাষ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও সচেতনতা বৃদ্ধি; সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের পরিধিসম্প্রসারণ; এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।


নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি যোগানে মাছ
বিবিএস’র ২০১৬-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জনপ্রতি প্রতিদিন মাছ গ্রহণের পরিমাণ ঈপ্সিত চাহিদার (৬০ গ্রাম) চেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৬২.৫৮ গ্রাম-এ উন্নীত হয়েছে। আমাদের খাদ্যে প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের  প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ। মাছ একটি উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ দামে সস্তা ও সহজ পাচ্য, কম চর্বি ও শ্বেতসার যুক্ত নিরাপদ খাদ্য। মানুষের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলোর সবগুলো উপাদানই সুষম পরিমাণে মাছে বিদ্যমান।  
কোভিড-১৯ কালীন মৎস্য সাপ্লাই চেইন উন্নয়ন: কোভিড-১৯ কালীন মৎস্যচাষিদের মাছ বাজারজাতকরণ গতিশীল করতে মৎস্য অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কতিপয় ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করে; যা মৎস্যচাষিদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি সুধীমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়। কার্যক্রম হলো ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রয় কেন্দ্র/ গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যমে মাছ বিক্রয়; অনলাইনে মাছ বাজারজাতকরণ এবং দরিদ্র্য ও অসহায় মানুষকে ত্রাণের সাথে মাছ বিতরণ।


স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহে গৃহীত পদক্ষেপ
 

১. আইনি পরিকাঠামো তৈরি : জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানির দ্রব্য মৎস্য অধিদপ্তর বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। আইনি কাঠামোর আওতায় প্রণীত হয়েছে আইন, বিধিমালা, নীতি ও গাইডলাইন এবং এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তন্মধ্যে মৎস্য হ্যাচারি আইন, ২০১০ ও মৎস্য হ্যাচারি বিধিমালা, ২০১১; মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ ও মৎস্য খাদ্য বিধিমালা, মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮৩, এবং মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও  মাননিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৭); জাতীয়  চিংড়ি নীতিমালা, ২০১৪; মৎস্য সঙ্গনিরোধ আইন, ২০১৮; ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান ও পলিসি গাইডলাইন্স ২০১১; ফিস এন্ড ফিসারি প্রোডাক্টস অফিসিয়াল কন্ট্রোল প্রোটোকল ২০১৫; অ্যাকোয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস কন্ট্রোল গাইডলাইন্স ২০১৫ অন্যতম।
 

২. উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন ও ব্যবস্থাপনা : বাজারে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ/চিংড়ি সরবরাহের অন্যতম শর্ত হলো উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের পাশাপাশি উত্তম ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন। সঠিক উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি এ ব্যবস্থাপনার আওতায় নি¤œবর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ ধাপসমূহ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জৈবনিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে খামার স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা। মজুদপূর্ব এবং মজুদকালীন ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপে উত্তম চাষ ব্যবস্থা অনুসরণ।


৩. ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান বাস্তবায়ন ((NRCP)) : ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান  কার্যক্রমের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভোক্তার জন্য বাংলাদেশী মৎস্যপণ্য নিরাপদ করা। এনআরসিপি কার্যক্রমের মাধ্যমে মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য হলো দূষণের সহনশীল সীমা ও সর্বোচ্চ অবশিষ্টাংশের সীমার জন্য নির্ধারিত সম্মত নীতির সামঞ্জস্যতা মূল্যায়ন করা, নিষিদ্ধ/অননুমোদিত পদার্থের অবৈধ ব্যবহার উদঘাটন করা এবং দূষণ অবশিষ্টাংশের উৎস নির্ণয় করা।


৪. মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালনা
আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালিত হচ্ছে। মৎস্য ও মৎস্যজাতপণ্যের মাননিয়ন্ত্রের সাফল্যের স্বীকৃতস্বরূপ ২০১৫ সালে
EU-FVO Audit Team –এর সুপারিশে মৎস্যপণ্য রপ্তানিতে প্রতিটি কনসাইনমেন্টের সাথে টেস্ট রিপোর্ট পাঠানোর বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়।  


মৎস্য অধিদপ্তর আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাণিজ আমিষের চাহিদাপূরণে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ মাছ সরবরাহে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে একক প্রয়াস এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত সকলের সমন্বিত উদ্যোগ। এর ফলে অর্জিত হবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন। বাস্তবায়িত হবে সরকারের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।

মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রমনা, ঢাকা, ফোন : ৯৫৬২৮৬১, (ইমেইল: dg@fisheries.gov.bd)