Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টি নিরাপত্তায় পারিবারিক খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ

ড. সালমা লাইজু

আমরা জীবন ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করি। খাদ্যের সঙ্গে জীবন স্পন্দনের সম্পর্ক সরাসরি। নির্ভেজাল, পুষ্টিকর খাবার পরিমিত গ্রহণ করার মধ্যে রয়েছে আমাদের সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা। নিরাপদ খাবার হলো সেই খাবার যা কোন মানুষ গ্রহণ করলে তার ক্ষতি হবে না, তার শরীরের পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। মানুষ তার কঠোর পরিশ্রমের অর্জিত অর্থ দিয়ে খাদ্য কিনে প্রতারিত হয়, ভেজাল খাবার খেয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে। এ রকম অবস্থার সম্মুখীন আমরা সবাই।


অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় তৈরি; প্যাকেটজাতকরণ, স্টোর করার দরুন প্রকৃত গুণ নষ্ট হয়ে গেছে; বিষাক্ত হয়ে গেছে; পচা, গলা, রোগাক্রান্ত, পোকায় আক্রান্ত, প্রাণী আক্রান্ত সবজির অংশবিশেষ থাকার ফলে খাওয়ার অনুপযুক্ত; বিষাক্ত অথবা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান আছে; রং ব্যবহার করা হয়েছে যা অনুমোদিত নয়; প্রিজারভেটিভ  আছে যা অনুমোদিত না অথবা অনুমোদিত হলেও মাত্রাতিরিক্ত আছে এ রকম খাবার আমরা সবসময়  খাচ্ছি অথচ আমাদের দেশের জলবায়ুর বৈচিত্র্যের কারণে ঋতু ভিত্তিক নানা প্রকারের শাকসবজি উৎপন্ন হয়ে থাকে। মৌসুমে অনেক খাদ্যদ্রব্যের দাম খুবই কম থাকে। তখন পুষ্টিকর এ সব খাদ্য দ্রব্য হয়ে পড়ে উপেক্ষিত। অথচ এসব খাদ্যদ্রব্য যথাযথ সংরক্ষণ করতে পারলে সারা বছর পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যাবে, সেই সাথে অর্থ সাশ্রয় হবে।


আবহমানকাল থেকে গ্রাম বাংলার মেয়েরা খাদ্য সংরক্ষণ করতেন। বর্তমানে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবারের প্রাপ্যতা বেড়ে যাওয়া এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্য দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে প্রক্রিয়াজাত খাবার পাওয়া যায় না, সেখানেই কেবল কিছু মানুষ এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।


আমাদের গ্রামে গঞ্জের শিশুরাও আজকাল চিড়া, মুড়ি, খই, মোয়া, হাতের সেমাই, বিভিন্ন সাজ পিঠা, পাতা পিঠা, ছাতু, লাড্ডু, আচার, চাউলের ঝুরি, নারকেলের নাড়–, ছাতুর নাড়–, চালকুমড়ার মোরব্বা ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে পরিচিত নয়। আজকাল মায়েরা এইসব ঝামেলা করতেও চান না। উপকরণ প্রাপ্যতারও সমস্যা রয়েছে কিছুটা। দশ টাকা দিয়ে সহজেই চিপস, জুস, আইসক্রিম, বিস্কুট, আচার, ক্যান্ডি, শামুচা, সিঙ্গারা পাওয়া যায়, তাহলে এসব ঝামেলা কে করতে যায়? অথচ নিম্নমানের এসব খাবারে কোন পুষ্টি তো নেই-ই বরং তাতে রয়েছে নানা ধরনের রাসায়নিক বস্তু যা শরীরের পুষ্টি সাধনের পরিবর্তে নানা রকম রোগব্যাধির সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে।


আমরা জীবন ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করি। খাদ্যের সঙ্গে জীবন স্পন্দনের সম্পর্ক সরাসরি। নির্ভেজাল, পুষ্টিকর খাবার পরিমিত গ্রহণ করার মধ্যে রয়েছে আমাদের সুস্থ্য জীবনের নিশ্চয়তা। নিরাপদ খাবার হলো সেই খাবার যা কোনো মানুষ গ্রহণ করলে তার ক্ষতি হবে না, তার শরীরের পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। মানুষ তার কঠোর পরিশ্রমের অর্জিত অর্থ দিয়ে খাদ্য কিনে প্রতারিত হয়, ভেজাল খাবার খেয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে। এ রকম অবস্থার সম্মুখীন আমরা সবাই।


উদহারণস্বরূপ, মরিচের গুঁড়া বেশি লাল করার জন্য সুদান ডাই, ইটের গুঁড়া দেয়া হয়। কখনো এতে লাল রং ও কাঠের গুঁড়া মেশানো থাকে। যে কোনো গাছের পাতা গুঁড়া করে পিকরিক এসিড দিলে লাল রঙ হয়ে থাকে। অনেকে পিকরিক এসিড দয়ে মেহেদি তৈরি করে এ মেহেদি বেশি ব্যবহার করলে স্কিন ক্যান্সার হবে। আজকাল খাবারকে আকর্ষণীয় করার জন্য স্বাদ লবণের  টেষ্টিং সল্ট) ব্যবহার খুবই বেড়েছে। স্বাদ লবণ বেশি খেলে বাচ্চাদের আচরণ পরিবর্তিত হয়ে যায়।


সুজিকে ভারী করার জন্য লৌহ চ‚র্ণ দেয়া হয়। আয়রন ট্যাবলেটেও লৌহ চূর্ণ দেয়া হয়। সাগুদানার মধ্যে ট্যালকম পাউডার যোগ করা হয়। মশুর ডালকে বেশি লাল বানাতে লেড ক্রোমেট দেয়া হয়। ঘি/মাখনের মধ্যে ডালডা মেশানো থাকে।


টমোটোতে হরমোন, ক্যামিক্যালস দিয়ে কাঁচা টমেটো পাকানো হয়, রান্না করলে শক্ত হয়ে থাকে। আম, কলা কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয় যা খুবই বিষাক্ত। আম কলা গাছে ফরমালিন স্প্রে করা  হয়, এতে দীর্ঘদিন ভালো থাকে সহজে পচে না। সবজিতে এবং ফলে প্রচুর  হরমোন স্প্রে করা হয়। সুদান ডাই/লাল রঙ- যা তরমুজকে বেশি লাল করতে ব্যবহৃত হয়।


পটেটো চিপসে ওলেষ্ট্রা (Olestra) নামক কৃত্রিম চর্বি দেওয়া হয়। বাচ্চারা খুব পছন্দ করে। কিন্তু ওলেষ্ট্রা পাকস্থলী হজম এবং শোষণ করতে পারে না। যার ফলে পেটে অস্বাভাবিক গোলমাল দেখা যায়। গুড়ে জীবাণু নাশক ফিটকিরী দেওয়া হয়, চাল ধবধবে চিকন করার জন্য ইউরিয়া টিএসপি সার দেয়া হয়। মেশিনে চাল কেটে চিকন করা হয় ফলে পুষ্টিমান কমে যায়। লিচু অতিরিক্ত লাল করার জন্য কৃত্রিম ডাই দেয়া হয়।


এসব প্রায়ই আমরা পত্রিকাতে পড়ি খাবারে ভেজাল দ্রব্যের ছড়াছড়ি। কিন্তু বাহির থেকে দেখে আমরা বুঝতে পারি না।  অতিরিক্ত লবণ, ক্ষতিকর তেল বা ক্ষতিকর চর্বি দিয়ে এইসব খাবার তৈরি হয়ে থাকে। অপুষ্টিকর চর্বিযুক্ত এইসব খাবার সব বয়সের মানুষের জন্যই ক্ষতিকর, বিশেষ করে শিশুরা মারাত্মক ক্ষতিকর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। এগুলো খেয়ে প্রায়ই তাদের পেটের গোলযোগ হয়ে থাকে। এর ফলে তাদের ক্ষুধামন্দা, খিটখিটে মেজাজ, ওজনহীনতাসহ জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।


গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব খাবার পুষ্টিকর পরিচ্ছন্ন এবং মুখরোচক, এখানে ক্ষতিকর কোন রং বা প্রিজারভেটিভ দেয়া থাকে না। যুগ যুগ ধরে আমাদের দাদী নানীরা এই ঐতিহ্যের ধারকবাহক ছিলেন। রৌদ্রে শুকিয়ে লবণ, চিনি, তেল বা ভিনেগার দিয়ে, আগুনে ফুটিয়ে, বরফে রেখে নানা রকমের খাবার সংরক্ষণ করা সম্ভব।


আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে গোলআলু, মিষ্টিআলু উৎপাদিত হয়। আলু ভাতের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর অথচ আলু মৌসুমে তা রাস্তায় পড়ে থাকে। আলুর চিপস তৈরি করে রাখলে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়। টমেটো আরেকটি অতি উপকারী ফলজাতীয় সবজি, যা দিয়ে কেচাপ, সস, চাটনি তৈরি করা যায়। চালকুমড়ার মোরব্বা ও ক্যান্ডি, আনারস ও পেয়ারার জ্যাম-জেলি, মৌসুমী সব ফল যেমন আম, জলপাই, বরই, আমড়া, চালতা, জাম, পেয়ারা এবং বিভিন্ন সবজির মিশ্র আচার, তিল, নারকেল, বাদাম, চিড়া ভাজা দিয়ে মোয়া ইত্যাদি ছোট ছোট শিশুদের খাবারে বৈচিত্র্য আনে, সেই সঙ্গে পুষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করে।


ছোলার ডাল, গম, ভুট্টা, চাল সব কিছু একত্রে ভেজে গুঁড়া করে তৈরিকৃত ছাতু একটি আন্তর্জাতিক মানের পুষ্টিকর খাবার যা গর্ভবতী ও প্রসূতি মা এবং শিশু-কিশোরদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অত্যন্ত কার্যকর। পাকা চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, কচু, কুমড়ার বড়ি, শুঁটকী মাছ সারা বছর খাওয়া যায়, সেই সঙ্গে এগুলোর অনন্য স্বাদ যার তুলনা মেলা ভার।


শহরে যাদের সুবিধা আছে তারা বাঁধাকপি, মূলা, টমেটো, মটরশুঁটি, গাজর ইত্যাদি বঞ্চিং  (Blanching) করে সংরক্ষণ করতে পারে। সবজিগুলো ধুয়ে বড় টুকরা করে নিতে হবে, এর পর বড় হাঁড়িতে পানি গরম করতে হবে, পানি এমন গরম হতে হবে যাতে হাত পানিতে ডুবানো যায় কিন্তু রাখা যাবে না (৬০০ সে.), এর পর সবজিগুলো ৩-৪ মিনিট রেখে পানি থেকে উঠিয়ে নিতে হবে এরপর ঠাÐা করে প্যাকেট করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে।
হাতে তৈরি খাবার সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ। বর্তমান সময়ে যেখানে নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাবার পাওয়া দুঃসাধ্য সেখানে হাতে তৈরি খাবারের বিকল্প নেই। শিশুদের টিফিনে এবং বিভিন্ন সময়ে আমরা এই খাবার তাদের খেতে দিতে পারি কারণ পুষ্টি অর্জনের প্রথম শর্ত নির্ভেজাল এবং সুষম খাবার যা খোলা খাবার বা বাইরের খাবারে অনুপস্থিত।


পুষ্টি একটি ব্যাপক বিষয়-পুষ্টির সঙ্গে জীবনের সুস্থতা এবং কর্মক্ষমতা জড়িত। পুষ্টির ঘাটতি একটি পরিবার তথা জাতিকে রোগগ্রস্ত করে ফেলতে পারে। খাবারের রুচি, স্বাদ-গন্ধ ঠিক রেখে উন্নত খাবার নির্বাচন, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাত করতে হবে যাতে গুণগত মানও ঠিক থাকে সেই সঙ্গে খাবার হয় মুখরোচক এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ। যুগে যুগে প্রচলিত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হাতে তৈরি খাবার গুণে মানে সেরা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। য়

জেলা বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নেত্রকোনা, মোবাইল :  ০১৭১৫ ৭৯০৭৬৭,  ই-মেইল : slsnns@yahoo.com