Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ভোক্তাপর্যায়ে উত্তম মৎস্য সরবরাহে সচেতনতা

কৃষিবিদ মোঃ আলতাফ হোসেন চৌধুরী

বর্তমানে সারা বাংলাদেশে শীতকালীন মৌসুমি হাওয়া বইছে এবং এ সময়ে তাপমাত্রাও অনেক কম থাকে বিধায় মাছ চাষে অনেক সমস্যা দেখা যায়। মাছ চাষ মূলত : তিনটি বিষয়ের ওপর ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিষয়গুলো হলো : ১. ফিড (খাবার), ২. সিড (পোনা), ৩. ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা)। ওই বিষয়গুলোর একটির ঘাটতি হলে মাছ চাষ ব্যাহত হয়। তাছাড়া মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাবলি মাছ চাষের জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাপমাত্রা কম ও ভৌত রাসায়নিক গুণাবলির সঠিক সমন্বয় মাটি ও পানিতে বিদ্যমান না থাকার কারণে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধি জটিল হয়ে পড়ে। অতীতে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ব্যাপক মৎস্য আহরণ সম্ভব ছিল কিন্তু বর্তমানে মনুষ্য সৃষ্টিকারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চাষের মাছের ওপর যেমন নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি ভোক্তাপর্যায়ে উত্তম মৎস্য খাদ্য সরবরাহের জন্য পূর্বের তুলনায় আমাদের দায়িত্ব ও অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ভোক্তাপর্যায়ে উত্তম মৎস্য সরবরাহের জন্য নি¤েœাক্ত কাজসমূহ অবশ্য পালনীয়।
 

উত্তম মৎস্য চাষ
উত্তম মৎস্য চাষ হলো মাছ চাষ ও আহরণোত্তর পর্যায়ে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত নিয়মাবলি অনুসরণ করে দূষণমুক্ত ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন করা। তবে এটি অর্থনেতিকভাবে লাভজনক, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং পরিবেশ সহনীয় হতে হবে। সামগ্রিকভাবে খামার পরিকল্পনা, পুকুর তৈরি, পোনার মান, খাদ্য ও পানির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা, আহরণ ও আহরণোত্তর পরিচর্যা, পরিবহণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্থাৎ মাছ চাষ থেকে ভোক্তার খাবার টেবিল পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলন করতে হবে ।

 

উত্তম মৎস্য চাষের উদ্দেশ্য
ভোক্তার জন্য নিরাপদ ও মানসম্পন্ন মাছ উৎপাদন করা। মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন রোগজীবাণুু দ্বারা যাতে মাছ সংক্রমিত না হয় তা ব্যবস্থা করা। ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক যেমন-ক্লোরাম ফেনিক্যাল, নাইট্রোফুরান বা কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যাদি (ফরমালিন) বা কীটনাশক দ্বারা দূষিত হবে না। মাছ চাষের শুরু থেকে আহরণ ও আহরণোত্তর পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা যাতে উৎপাদিত পণ্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

 

নিরাপদ মাছ
নিরাপদ মাছ হলো পুকুরে এবং খামারে উৎপাদিত এবং সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত এবং তাতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো উপাদান না থাকা। এ ক্ষেত্রে একজন মৎস্য চাষিকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তার চাষপদ্ধতি সম্পূর্ণ ক্রটিমুক্ত ছিল এবং তাতে পণ্য দূষণের কোনো উপাদান ছিল না।


নিরাপদ মাছ উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার কারণগুলো
পুকুরে ও ঘেরে রোগাক্রান্ত পোনা বা পিএল (পোস্টলার্ভি) মজুদ। রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটতে পারে এমন কোনো উপাদান যেমন-হাঁসমুরগির বিষ্ঠা, গোবর, মানুষের মলমূত্র ব্যবহার করা। মাছ চাষে নিষিদ্ধ ঘোষিত এন্টিবায়োটিক (যেমন-নাইট্রোফুরান) রাসায়নিক দ্রব্যাদি যেমন- ম্যালাকাইট গ্রীন, মিথিলিন বালু ব্যবহার করা। অনুমোদিত ওষুধ বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। পুকুরে বা ঘেরে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত শ্রমিক দিয়ে কাজ করা। সর্বোপরি মাছে অপদ্রব্য পুশ করা।


অনিরাপদ মাছ উৎপাদনের ক্ষতিকর প্রভাব
অনেক চাষি না জেনে অননুমোদিত ওষুধ  ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি মাছ চাষে ব্যবহার করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আহরণোত্তর পরিচর্যার কারণেও মাছ এ খাদ্য হিসেবে অনুপযুক্ত হয়।
পুকুরে এবং ঘেরে নিরাপদ এবং গুণগতমান সম্পন্ন মাছ উৎপাদনে চাষিদের করণীয়
চাষিদের রোগমুক্ত মাছের পোনা ও পিএল মজুদ নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাদ্যের গুণগতমান নিশ্চিত হয়ে লেবেলিং ভালো মানের খাদ্য ক্রয় করতে হবে এবং নিয়মিত ও প্রয়োজন মোতাবেক ব্যবহার করতে হবে। পচা, বাসি, নিম্নমানের এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার ব্যবহার করা যাবে না। অনুমোদিত এবং নিষিদ্ধ ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। আহরণের ৭-১০ দিন পূর্বে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিতে হবে। পুকুরে ব্যবহৃত সকল প্রকার খাবার, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ওষুধ, পোনা খাদ্য ইত্যাদির মাত্রা, নাম, উৎস, ব্যবহারের কারণ ও তারিখ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে রেকর্ড বইয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।


ঘের বা খামারে অনুসরণীয় প্রধান প্রধানভালো প্র্যাকটিসগুলো
আশেপাশের বাড়িঘর, গৃহপালিত পশুর খামার, আবর্জনা ইত্যাদি হতে পুকুর বা ঘের দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন স্থানে ঘের নির্মাণ করতে হবে। পার্শ্ববর্তী নদী, খাল, বিল অন্যান্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে ঘেরে বা পুকুরে পানি দূষণের সম্ভাবনা আছে কি না জানতে হবে। বন্যাপ্রবণ, ময়লা-আবর্জনার স্ত‚পের আশপাশে খামারের স্থান নির্বাচন করা যাবে না। খামার প্রাঙ্গণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি (জাল, বাকেট, বাস্কেট ইত্যাদি) পরিষ্কারও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। খামারে কর্মচারী ও মানুষের যথেচ্ছ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেবল নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে হবে। খাদ্যের মান এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে ২-৩ মাসের মধ্যে মজুদকৃত খাদ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অতিবর্ধনের জন্য হরমোন জাতীয় খাবার ব্যবহার করা যাবে না। কাঁচা খাবার সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না। কেবল সর্বশেষ উপায় হিসেবে অনুমোদিত ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। ওষুধ সংরক্ষণে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সঠিক ব্যবহার বিধি অনুসরণ করতে হবে এবং ওষুধ ব্যবহারের তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। অবশেষ নিঃশেষে (উইথড্রয়াল পিরিয়ড) সময় মেনে চলতে হবে। ভোরে অথবা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মাছ আহরণ করতে হবে। আহরণের ২ দিন আগে খাবার বন্ধ করতে হবে। আহরণের পূর্বে ক্ষতিকারক জীবাণুু ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যাদি আছে কি না পরীক্ষা করতে হবে। পুকুর ও ঘেরের জমির বৈধ মালিকানা থাকতে হবে। আশপাশের জনগোষ্ঠেীর জীবন-জীবিকা ও যাতায়াত ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন জায়গায় খামার ও চিংড়ির ঘের করা যাবে না। শ্রমিকের লিখিত নিয়োগপত্র থাকতে হবে। শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী খামারে ও ঘেরে শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। ফরমালিনযুক্ত মাছ  ব্যবহারকারী দায়ী ব্যক্তি দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে ধরা পড়লে ৫০০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। (মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৯৭  অনুযায়ী)


মাছ ক্রয়ের সময় ভোক্তা কর্তৃক লক্ষণীয় বিষয়গুলো
ফরমালিনযুক্ত মাছের চক্ষুগোলক ভেতরের দিকে থাকে, ফুলকা কালচে বর্ণের হয়, শুষ্ক ত্বক এবং মাছে মাছি পড়বে না ইত্যাদি লক্ষণীয় বিষয় স্মরণ রাখতে হবে।
মাছ উৎপাদনের বিষয়টি এখন আর শুধু আহরণোত্তর পরিচর্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। খামারে মাছ উৎপাদনের প্রতিটি স্তর এমনকি ব্যবহৃত উপকরণগুলোর উৎস যথাযথ মাননিয়ন্ত্রণ নিরাপদ মাছ প্রক্রিয়ার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। তাই ভোক্তাপর্যায়ে উত্তম মৎস্য সরবরাহ করতে উত্তম মৎস্য চাষের প্রতিটি ধাপ যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে এটাই  হোক উত্তম মৎস্য চাষের মূলকথা।

খামার ব্যবস্থাপক, মৎস্যবীজ উৎপাদন খামার, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা। মোবাইল : ০১৭১২৪০৮৩৫৩; ই- মেইল : Chowdhari_33@yahoo.com