আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে
ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন
মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
আজ ১৬ অক্টোবর ২০২১। বিশ্ব খাদ্য দিবস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) তার জন্মকাল ১৯৪৫ সাল থেকে ১৬ অক্টোবরকে বিশেষভাবে স্মরণ করে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সুষম খাদ্যের জোগান নিশ্চিতের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত নির্মল পৃথিবী গড়ার কাজে FAO নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. যার ভাবানুবাদ ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন।’
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন কৃষকদরদী নেতা। স্বাধীনতার পরপরই তিনি কৃষি উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গবেষণা, সম্প্রসারণ, শিল্প ও বাজার উন্নয়নে বিশেষ জোর দেন। তিনি ভূমির সুষম বণ্টনের জন্য ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে ভূমিস্বত্ব আইন জারি করে পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করেন। কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণ, কৃষির উৎপাদন খরচ কমাতে ভর্তুকি মূল্যে সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। কৃষির উন্নয়নে জাতির পিতা কর্তৃক গৃহীত কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নে নানা ধরনের কৃষিবান্ধব নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সার, বীজসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস করা হয়েছে। শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিস্তৃত করার পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ সুবিধা প্রদান, নগদ আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা প্রদান, নিত্যনতুন উপযুক্ত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, খরা, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি পেঁয়াজ উৎপাদনেও তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্প উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন কৌশল বের করতে হবে। এ লক্ষ্যে ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা, ক্রপ জোনিং, জীব প্রযুক্তি, লেজার প্রযুক্তি, দক্ষ ক্ষুদ্র সেচব্যবস্থা, মাটি পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক পুষ্টি উপাদানের জন্য এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট পুষ্টি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে হবে। টেকসই কৃষি এমনভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে যেন তা সম্পদ সাশ্রয়ী, সামাজিকভাবে সহায়ক, বাণিজ্যিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশবান্ধব হয়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ফসলের অবশিষ্টাংশ, জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে জৈব চাষকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা তখন এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। শস্য উৎপাদন থেকে ভোক্তাপর্যায় পর্যন্ত প্রায় ৩১ শতাংশ খাদ্যের অপচয় হয়ে থাকে। এ বিপুল পরিমাণ অপচয় যদি রোধ করা যায় তাহলে খাদ্যের জোগান অনেকাংশে টেকসই করা যাবে। গবেষণা কার্যক্রম এবং ব্যবস্থাপনায় আরও গতিশীলতা আনতে হবে। আশার কথা আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগণ ২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা যাবে মর্মে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
কৃষিশিক্ষা, গবেষণা এবং সম্প্রসারণের যে ভিত্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গড়েছিলেন তা আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় এবং বরেণ্য কৃষিবিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন কর্মপ্রচেষ্টায় আজ কৃষি ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আন্তর্জাতিক ক্ষুধা মুক্তির সংগ্রামে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সুশীলসমাজ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখবে সে প্রত্যাশা আমাদের সবার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী বাংলাদেশকে শান্তিপূর্ণ, সুখী সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, কৃষি হবে দুর্বার।
লেখক : সিনিয়র সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা। www.moa.gov.bd