নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
মোঃ আসাদুল্লাহ
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সকলের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সার্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঠিক পথে অগ্রসরের জন্য ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রাপ্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পর এ পুরস্কার পাওয়া দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সফলতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন অব দি ডে’ হিসেবেও অভিহিত করেন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাস চলাকালেও এসডিজি প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে এবং এ সাফল্যের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার অবসান, খাদ্যনিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে সাফল্য লাভের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমতার আওতায় এনে উন্নয়নের স্রোতধারায় যুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নের পথে কাজ করছে। এসডিজির ১৭টির মধ্যে ১০টি লক্ষ্যমাত্রা এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে কৃষি খাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। জমির উৎপাদনশীলতা তথা ফলন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের কৃষি খাতের সাফল্য বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম হলেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে ১১তম।
কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। আজকের কৃষির যে উন্নতি এটা সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বল্পকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পিতার অনুসৃত পথ অনুসরণ করে কৃষিকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে এই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মহোদয়ের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে সকল কাজের বাস্তবায়ন করার কারণেই এসেছে কৃষি ক্ষেত্রে অসাধারণ সফলতা।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. এর ভাবানুবাদ আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন। সময় বিবেচনায় উপযুক্ত প্রতিপাদ্য। এবারের খাদ্য দিবসের প্রেক্ষাপট অবশ্য অন্যান্যবারের তুলনায় আলাদা। বিশ্ব এক ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসজনিত রোগের সম্মুখীন। এই অতিমারি থেকে মুক্তি পায়নি বাংলাদেশও। রোগটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, যারা শারীরিকভাবে ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে আক্রান্ত তাদের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে খাদ্যের কোন অভাব না থাকলেও সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩% এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। কিন্তু এমনটি হবার কথা নয়। কারণ দেশে বিগত এক দশকে প্রায় প্রতিটি সেক্টরে অভাবনীয় সফলতার সাথে সাথে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি শাকসবজিও সবসময় সহজলভ্য। ফলের উৎপাদন ও প্রাচুর্যতা থাকায় বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। মানুষের খাদ্যক্রয়ে যথেষ্ট আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধু পুষ্টি বিবেচনা করে খাবার গ্রহণের সচেতনতার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। পুষ্টিবিদরা সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন সুষম খাবার গ্রহণের কথা বলেন। সুষম খাদ্যের অর্থই হলো দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিবেলায় খাদ্যের প্রত্যেকটি উপাদান খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিমিত পরিমাণ সবজি ও ফল খাওয়ার কোন বিকল্প নাই। সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে গেলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এখনো অনেক পিছিয়ে। এই ঘাটতি পুরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের কাক্সিক্ষত পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় ডাল, তেল, ফল ও সবজি ফসল সম্প্রসারণে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৭৩৬.২১৯২০ লক্ষ টাকা খরিপ-১/২০২০-২১ মৌসুমে পারিবারিক কৃষির আওতায় সবজি-পুষ্টি বাগান স্থাপনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ/চারা ও সার সরবরাহ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ফলে ৬৪ জেলার ৪৯১টি উপজেলার ৪৪৩১টি ইউনিয়নের ১ লক্ষ ৪১ হাজার ৭৯২ কৃষক পরিবার উপকার পাবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মুজিব শতবর্ষে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি উৎসব’ উপলক্ষ্যে ১৫২৯১.০৭৩৬০ লক্ষ টাকার পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে ৬৪ জেলার ৪৯১টি উপজেলার ৪৫৯৭টি ইউনিয়ন এবং ১৪০টি পৌরসভার ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার ৭ শত কৃষক পরিবার পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা উপকার ভোগ করবে। বসতবাড়ির বিদ্যমান সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হবে। বসতবাড়িতে পরিকল্পিত ফলগাছ লাগানো ও পরিচর্যার মাধ্যমে ফল-ফলাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫৩.৬০ লক্ষ বসতবাড়ি রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৫.৪০ লক্ষ হেক্টর জমি। এসকল বসতবাড়িতে শাকসবজি বাগান সৃজনের মাধ্যমে আমাদের পুষ্টির চাহিদার অনেকাংশ মেটানো সম্ভব। গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থিক সমৃদ্ধির পথকেও প্রসারিত করবে। তাছাড়া পতিত জমি চাষের আওতায় আনার ফলে শস্য নিবিড়তাও বৃদ্ধি পাবে।
কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে, তারই জের ধরে দেশে দেশে বাড়ছে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা। বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টির যেন কোন অভাব না হয় সে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ প্রদান করেছেন ফসলের সর্বাধিক উৎপাদনের জন্য। এজন্য তার নির্দেশ “এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে”। এই নির্দেশনাকে পালনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য উৎপাদন সর্বাধিক করার লক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পদক্ষেপগুলো রীতিমতো বিশ্ব নজির হিসেবে ইতোমধ্যেই সমাদৃত হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের এই অর্জন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরে দেশে প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্ব অবস্থানে তৃতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। শাকসবজি বাজারে সারা বছরই সহজলভ্য। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশ করোনাকালীন সময়ে কোনোরূপ খাদ্য সংকট যেন না হয় তার প্রস্তুতি নিয়েই ২০২০-২১ অর্থবছরে ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতি মৌসুমেই তার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত কার্যক্রমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের সকল পর্যায়ের কর্মচারীরা টেকসই সুষম খাদ্য উৎপাদন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিগত দুই বছরে করোনা অতিমারি সত্ত্বেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি মুহূর্তের জন্যও কৃষকের পাশ ছাড়েনি।
সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকাতে সুষম পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজন হয়। সেই সাথে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও খাদ্য তালিকায় রকমারি ফল ও সবজি জাতীয় খাবারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। খাদ্য যেন স্বাস্থ্যসম্মত বা মানসম্মত হয় তার জন্য সারাদেশে আবাদকৃত ফসল ও ফলমূলের ক্ষতিকারক রোগবালাই থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, রোগবালাই দ্বারা ফসল আক্রান্ত হলে ফসল রক্ষার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক কারিগরি পরামর্শদান ও সঠিক দমন ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে কৃষককে সহায়তা দান, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল উৎপাদন কলাকৌশল নিরূপণ, রোগবালাই সম্পর্কে জরিপ ও আগাম ব্যবস্থা গ্রহণে কৃষককে সতর্ক করাসহ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে ফসল উৎপাদনের উপর কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং রফতানিকারকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষরোপণ অভিযান চলমান রয়েছে। সম্প্রতি ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের বাগানে একটি ‘হানি লোকাস্ট’ বৃক্ষের চারা রোপণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃক্ষটি শোভাবর্ধনকারী ও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাকারী।
বিশ্বখাদ্য দিবস ২০২১ সফল হোক। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই বিশ্ব খাদ্য দিবসের স্লোগান অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন ও জোগানের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯, ইমেইল : dg@dae.gov.bd