Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ঠান্ডাজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষিতে করণীয়

ঠান্ডাজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষিতে করণীয়
প্রফেসর ড. মো. ফারুক হাসান১ কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম২

সারাদেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ঘনকুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীত এসে উপস্থিত আমাদের মাঝে। কথায় আছে, ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’। কিন্তু কৃষক ভাইদের মাঠ ছেড়ে পালানোর কোন উপায় নেই। বাংলার মানুষের অন্ন জোগাতে শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় লেপের উষ্ণতাকে ছুড়ে ফেলে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠের কাজে। আর তাই তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কবল থেকে আমাদের কৃষিকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়ে। আসুন জেনে নেই ঠান্ডাজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।


বোরো ধান
শৈত্যপ্রবাহের সময় সাধারণভাবে কাদাময় বা ভেজা বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিনের ছাউনি দিয়ে সকাল ১০-১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। তীব্র শীতের সময় বীজতলায় সব সময় ১ থেকে ২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করা উত্তম। বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে রশি টানা দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে চারা থেকে কুয়াশার পানি বা শিশির ঝরিয়ে দিলে চারা শীত থেকে রক্ষা পায় এবং ভালোভাবে বাড়তে পারে। ঠান্ডার কারণে বীজতলায় কিছু কিছু জায়গায় চারা ধসে পড়ে বা বসে যেতে পারে। চারায় ধসে বা বসে পড়া রোগ দেখা দিলে বীজতলা থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে এবং এক শতাংশ বীজতলা জন্য ৫০ গ্রাম হারে এমওপি বা পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। তীব্র শীতের সময় চারা পোড়া বা ঝলসানো রোগ দেখা দিতে পারে। চারা পোড়া বা ঝলসানো রোগ দমনের জন্য রোগের প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ শুরুর দিকে অ্যাজঅক্সিস্ট্রবিন জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন- এমিস্টার টপ ২ মিলি এক লিটার পানিতে মিশিয়ে দুপুরের পর স্প্রে করতে হবে। বীজতলার চারা হলুদ হলে এক শতক জমিতে ২৮০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পর চারা সবুজ না হলে এক শতক জমিতে ৪০০ গ্রাম হারে জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের সময় শৈত্যপ্রবাহ থাকলে কয়েক দিন দেরি করে আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে চারা রোপণ করতে হবে। রোপণের জন্য কমপক্ষে ৩৫-৪৫ দিনের চারা ব্যবহার করতে হবে। এ বয়সের চারা রোপণ করলে শীতে চারা কম মারা যায়, চারা সতেজ থাকে এবং ফলন বেশি দেয়। রোপণের পর শৈত্যপ্রবাহ হলে জমিতে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। থোড় ও ফুল ফোটার সময় অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়া থাকলে জমিতে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখলে থোড় সহজে বের হয় এবং চিটার পরিমাণ কম হয়। ভেজা বা কাদাময় বীজতলার পাশাপাশি অনেকে আবার বোরো মৌসুমে শুকনা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে থাকেন।


শুকনা বীজতলা তীব্র শীতের সময় সার্বক্ষণিক স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজতলায় রসের অভাব হয়েছে কি না। বীজতলায় রসের অভাব হলে স্প্রে করে হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কৃষিতে আধুনিক ও লাগসই যন্ত্রের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।


রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চারা রোপণ তারই অংশ। তবে এ কাজের জন্য ট্রে-তে সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত চারা উৎপাদন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রে-তে অংকুরিত বীজ ফেলানোর ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত এবং শৈত্যপ্রবাহ চলাকালীন সার্বক্ষণিক স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এরপর প্রতিনিয়ত বিকেল ৪টা হতে সকাল ৯টা পর্যন্ত স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এ ছাড়া শুকনা মাটিতে পাতা ঝলসানো রোগটি বেশি হয় কাজেই ট্রে-তে পরিমাণমতো পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে।


আলু ও টমেটো
ঘন কুয়াশার কারণে আলু ও টমেটো ফসলে লেইট ব্লাইট (মড়করোগ) রোগের আক্রমণ হতে পারে। এ ধরনের আবহাওয়ায় আলু ও টমেটো ফসলে প্রতিরোধক হিসেবে মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন- ডায়থেন এম ৪৫ বা ইন্ডোফিল এম ৪৫ এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। এ রোগের আক্রমণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে আক্রান্ত গাছ তুলে মাটি চাপা দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। প্রতিষেধক হিসেবে ডায়মেথিওমর্ফ বা প্রোপামোকার্ব জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন- সিকিউর ২ গ্রাম অথবা সিকিউর ১ গ্রাম + মেলোডি ডুও ২ গ্রাম একত্রে এক লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ হতে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া এন্টিস্পোরুলেন্ট হিসেবে এক্রোবেট এমজেড ৪ গ্রাম হারে এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। সম্প্রতি আলুর মড়ক রোগের জীবাণুর জিনোমে মেটাল্যাক্সিল জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতিরোধী জিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কাজেই এ জাতীয় ছত্রাকনাশক আলুর মড়ক রোগের বিরুদ্ধে আর কার্যকর হচ্ছে না। শুধু সঠিক ওষুধ সঠিক মাত্রা হলেই চলবে না সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। সম্ভব হলে পাওয়ার স্প্রেয়ার দিয়ে পাতার ওপর-নিচ ও ডালপালা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।


সরিষা ও শিম
সরিষা ও শিম গাছে জাবপোকার আক্রমণ দেখা দিলে আঠাযুক্ত হলুদ ফাঁদ অথবা আঁধাভাঙ্গা নিমবীজের পানি (১ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম নিমবীজ ভেঙ্গে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নিতে হবে) আক্রান্ত গাছে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। তবে আক্রমণের মাত্রা খুব বেশি হলে এক লিটার পানিতে এ্যাডমায়ার/টিডো/এমিটাফ ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।


আম-লিচু-কাঁঠাল
ঘন কুয়াশার কারণে আম ও লিচুর মুকুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরূপ আবহাওয়ায় প্রতিরোধক হিসেবে বর্দোমিক্সার অথবা সালফারঘটিত ছত্রাকনাশক যেমন-থিওভিট ৮০ ডব্লিউজি এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া এরূপ আবহাওয়ায় আমের শোষক পোকার (হপার) বংশ দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে পারে তাই গাছের কাণ্ডে ও পাতায় সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি গ্রুপের যেকোনো একটি কীটনাশক এক লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আম-লিচু-কাঁঠালে মিলিবাগ পোকার নিম্ফ বা বাচ্চা যেন মাটি থেকে কাণ্ড বেয়ে গাছের উপরের দিকে উঠতে না পারে সে জন্য এ সময় গাছের গোড়া পিচ্ছিল পলিথিন বা টেপ দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে।


সুপারি ও নারকেল
তীব্র শীতের কারণে অনেক সময় নারকেল-সুপারির পাতা পুড়ে যেতে পারে, এটি ঠান্ডাজনিত আঘাত। শৈত্যপ্রবাহকালীন সেচের পানি বা হালকা গরম পানি স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

 

পান
তীব্র শীতের কারণে অনেক সময় পানের পাতা ঝরে যেতে পারে। পানের বরজের চারপাশে বিশেষ করে উত্তর দিকের বেড়া পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিলে তীব্র শীতের হাত হতে রক্ষা করা যায়।

 

শাকসবজি
বেশি ফলন পেতে শীতকালীন শাকসবজি যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে।


শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। আর তাই নিয়মিত সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ ও যত্নআত্মি নিতে পারলে গাছপালা ও ফল-ফসল সুস্থ সবল থাকে এবং যেকোন খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। সর্বোপরি, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে তীব্র শীতে ঠান্ডাজনিত অভিঘাত হতে বিভিন্ন ফল-ফসল যেমন রক্ষা পায় ঠিক তেমনি অধিক ফলনও নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

লেখক : ১চেয়ারম্যান, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর। ২অতিরিক্ত উপপরিচালক (এলআর), ডিএই প্রেষণে পিএইচডি ফেলো (এনএটিপি)। মোবাইল : ০১৭১৯৫৪৭১৭৯, ই-মেইল : sayemdae@yahoo.com