Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

স্বাধীনতার ৫০ বছর ও আমাদের কৃষি

স্বাধীনতার ৫০ বছর ও আমাদের কৃষি

মোঃ আসাদুল্লাহ১  ড. শামীম আহমেদ২

এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীন হওয়ার পরপর অনেক তীব্র সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল শূন্য থেকে। সে সময় যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য দিয়েছিল বহু দেশ। কিন্তু তার অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের নাম দিয়েছিলেন ‘তলা-বিহীন ঝুড়ি।’ তার ধারণা ছিল যে, যতোই সাহায্য করা হোক না কেন, বাংলাদেশ কখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আজ বাংলাদেশকে দেখে সমগ্র বিশ্ব বিস্মিত হচ্ছে। উন্নয়নের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। সে ক্রমে উপরে উঠছে, আরও উপরে যাবে। অজস্র তার অর্জন। বাংলাদেশের বিগত পঞ্চাশ বছরের কৃষিকে আমরা স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর তুলনাচিত্রে চিহ্নিত করতে পারি। এই পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের কৃষি যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা এককথায় অনন্য। এই অগ্রগতি অর্জনের প্রধান প্রেরণা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ ও জাতির মর্যাদা অর্জন, আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার সামর্থ্য।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব মানুষ। সমৃদ্ধ ও স্বনিভ্রর উন্নত বাংলাদেশ এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য কৃষির উন্নতির কোন বিকল্প ছিল না তাঁর কাছে। সেই লক্ষ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। তিনি জানতেন মানুষের প্রথম চাহিদা খাদ্য আর খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তিনি কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশকে কৃষি অর্থনীতিতে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন।


সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সবার আগে দরকার আমাদের টোটাল জরিপ। জরিপ ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। সেজন্য সব কাজ করার আগে আমাদের সুষ্ঠু জরিপ করতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল। তার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ “এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে” এই প্রতিপাদ্যকে পালনের জন্য দেশের এই মহামারিতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর পদক্ষেপগুলো রীতিমতো বিশ্বে নজির হিসেবে ইতোমধ্যে সমাদৃৃত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন দানাদার শস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে ৩য় স্থান অর্জনকারী দেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৮.১৫ লক্ষ হেক্টর জমির আবাদ লক্ষমাত্রাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন চাহিদা ছিল ৩৯৬.৪৪ লক্ষ মে. টন, সেখানে আমরা এখন পর্যন্ত উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি ৩৮৬.০৮ লক্ষ মে. টন। এবছর জাতীয় গড় ফলন পাওয়া গেছে প্রতি হেক্টরে ৪.২৯ মেট্রিক টন। গত বছর দেশে বোরো ধানের জাতীয় গড় ফলন ছিল প্রতি হেক্টরে ৪.১২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে উৎপাদন বেড়েছে এবছর ০.১৮৫ মেট্রিক টন (৮.০৬ শতাংশ)। গত কয়েক বছরের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। ফলে বোরো ধান উৎপাদনে দেশ এবার নতুন রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়েছে। এই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের ধারাবাহিক সফলতার কারণে গত বছর আমাদের ১৯.৩ লক্ষ টন ধারণক্ষমতার মধ্যে ১২.৬৫ লক্ষ টন মজুদ করা সম্ভব হয়েছে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ফসলের আবাদ এলাকা (মিলিয়ন হেক্টর) চিত্র এবং উৎপাদন ( মিলিয়ন মেট্রিকটন/হেক্টর) সারণি দ্রষ্টব্য।


চিত্র : বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ফসলের আবাদ এলাকা (মিলিয়ন হেক্টর)
কৃষিনির্ভর এই বাংলাদেশ যেন করোনাকালে কোনরূপ খাদ্য সংকটে না পড়ে তার পূর্ণ প্রস্ততি ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে করোনার বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ করতে গিয়ে গত  ১২ জুলাই, ২০২০ তারিখের হিসাব মতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এতো ভয়াবহতার পরও থেমে নেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম। গত ৭ জুলাই ২০২০ তারিখে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কর্তৃক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে গণভবন প্রাঙ্গণে একটি ফলদ একটি বনজ এবং একটি ঔষধি গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে সারাদেশে ১ কোটি চারা বিতরণ ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ সালের হিসাব মতে মোট ৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের আবাদ হয়েছিল, যার মধ্যে প্রধান ফল হিসেবে আম আবাদের জমি ছিল প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর আর উৎপাদন ছিল ২২ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর ২০১৯-২০ সালে সেই লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২২ লক্ষ ৩২ হাজার মে.টন। দেশে প্রতি বছর আমের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে আম উৎপাদনে ৭ম স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি হলেও এর পরিমাণ উৎপাদনের তুলনায় অনেক কম। ২০১৯-২০ সালে দেশে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হলেও রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৭৯ মেট্রিক টন। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে থাইল্যান্ড সর্বোচ্চ ৭৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আম রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ১৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও পাকিস্তান ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আম রপ্তানি করেছে। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ৫০ হাজার ডলারের আম রপ্তানি করেছে। কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধাসমুহ নিরসনে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। রপ্তানি বৃদ্ধিতে আধুনিক কৃষি চর্চা মেনে ফসল উৎপাদন, রপ্তানি উপযোগী  জাতের ব্যবহার, আধুনিক প্যাকিং হাউজ নির্মাণ, অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপনসহ বহুমুখী  কাজ চলমান আছে। ইতোমধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ লাখ ৫০ আলু রপ্তানি ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ২টি খসড়া রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে।


ইউরোপের বাজারে কৃষিপণ্যের রপ্তানি এবং কৃষি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে সম্প্রতি বিগত ০৯-১৮ নভেম্বর ২০২১ নেদারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সফর করেছেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি এর নেতৃত্বে সরকারি ও বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি প্রতিনিধিদল। এ বিদেশ সফর ও কৃষির সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, নেদারল্যান্ডস বেসরকারি খাত থেকে উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি, সংগ্রহ, সংগ্রহত্তোর প্রযুক্তি, বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ তৈরির প্রযুক্তিগত দিক, রিয়েল টাইম স্বয়ংক্রিয় রিপোর্টিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষায় সহায়তা পাওয়া যাবে। এসব বিষয়ে ওখেনিঙেন বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চের সাথে সমঝোতা স্মারক শিগগিরই স্বাক্ষর হবে। এ ছাড়া দেশে ঘাটতি হলে সেপ্টেম্বর মাসে নেদারল্যান্ডসে উৎপাদিত নতুন পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণে ডাচ বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে (সোমবার, ১৬ নভেম্বর  ২০২১, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, কৃষি মন্ত্রণালয়)।


অপরদিকে কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে কৃষি প্রণোদনা অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় এবার সরকারে ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। করোনাকালে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকের আস্থা ধরে রাখতে এই প্রণোদনা প্রাণের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করেছে।  চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৭ অক্টোবর ২০২০ রবি/২০২০-২১ মৌসুমে বোরো ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, পেঁয়াজ ও পরবর্তী খরিপ-১ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন মুগ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ সহায়তা প্রদান বাবদ কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ৮৬৪৩.০০ লক্ষ (৮৬ কোটি ৪৩ লক্ষ ৩০ হাজার) টাকার অর্থ ছাড় করা হয়। এই অর্থ দেশের ৬৪টি জেলায় ৮ লক্ষ উপকারভোগীর মাঝে উল্লিখিত ৯টি ফসল চাষের জন্য সহায়তা বিতরণ করা হয়। ফসলভেদে বিভিন্ন পরিমাণে বীজ সহায়তা, ডিএপি ও এমওপি সার সহায়তা এই করোনাকালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি কৃষকের মাঝে পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে একইভাবে এই প্রণোদনা ১৭ নভেম্বর ২০২০ রবি মৌসুমে বোরো ধানের হাইব্রিড জাতের বীজ ব্যবহারকারীদের মাঝে ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চৌদ্দ লক্ষ সাতানব্বই হাজার কৃষকের মাঝে ৭৬ কোটি ৪ লক্ষ ৬০ হাজার ৭৬০ টাকা, ২৩ নভেম্বর ২০২০ রবি মৌসুমে পেঁয়াজ ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে পঞ্চাশ হাজার কৃষকের মাঝে ২৫ কোটি ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ও ২৫ মার্চ ২০২১ খরিফ-১ মৌসুমে আউশ ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কৃষকের মাঝে ৩৯ কোটি ৩৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার সার ও বীজ সহায়তা বিতরণ করা হয়। করোনা মোকাবিলায় এই প্রণোদনার সুফল বাংলাদেশের কৃষক পেতে শুরু করেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ১ লাখ ২০ হাজার  হেক্টরের বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। একই সাথে, গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে। হাইব্রিড ধানের আবাদ এবার বেড়েছে তিন লাখ হেক্টর। প্রতি হেক্টরে হাইব্রিডের উৎপাদন প্রায় পাঁচ টন করে হয়। ফলে তিন লাখ হেক্টরে প্রায় ১৫ লাখ টন ধান বেশি উৎপাদন হয়েছে।


কৃষিবান্ধব সরকার বিশ্বাস করেন, যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষি হবে প্রধান রক্ষাকবোজ হাতিয়ার। ‘কৃষিতেই হবে সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ’ মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

 

লেখক : ১মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ২অতিরিক্ত উপপরিচালক (কন্দাল, সবজি ও মসলাজাতীয় ফসল), হর্টিকালচার উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫, ই-মেইল : ashamim.uni@gmail.com