Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

প্রাণিখামারঃজাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল রাখবে

প্রাণিখামারঃজাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল রাখবে

কৃষিবিদ ডক্টর এস এম রাজিউর রহমান

ঈদুল আজহার কোরবানির বাজারে গরু বিক্রয়ের জন্য দেশে অধিকাংশ প্রাণীসমূহ বছরব্যাপী বা মৌসুম কেন্দ্রীক গরু মোটাতাজাকরণ করা হয়। আর কিছু খামার বছরব্যাপী রেডমিট উৎপাদনের জন্য সচল থাকে। যা, দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব দূর করা, উদ্যোক্তা তৈরিসহ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রাণিসম্পদ খাত অপরিসীম অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের বিকাশের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। করোনা মহামারিকালেও প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদন, সরবরাহ, পরিবহন ও বিপণন অব্যাহত রাখা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র ও অনলাইন বাজার পরিচালনার মাধ্যমে খামারিদের উৎপাদিত মাংস, দুধ ও ডিম ন্যায্যমূল্যে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। নগদ প্রণোদনা প্রদান, স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আর্থিক প্রণোদনা বিতরণ, উপকরণ সহায়তাসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। ফলে প্রাণিসম্পদ খাতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভবপর হবে।
প্রাণী খামারগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ঈদুল-আজহার জন্য গড়ে ওঠা প্রাণী খামারগুলো বাংলাদেশের গ্রামের অর্থনীতিকে গতিশীল করে। প্রান্তিক খামারিরা চার-ছয় মাস করে বছরে দুই-তিনটা সার্কেল গরু মোটাতাজা করে থাকে। এ সময় কোরবানির পশুগুলো খুব যত্নে লালন পালন করা হয়। সব খরচ বাদ দিয়েও একটি গরুতে অন্তত ১০-১৫ হাজার টাকা আয় থাকে। গবেষকরা বলছেন, ঈদুল-আজহায় গবাদিপশু বিক্রি করে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হাতে নগদ টাকা পায়। 
করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে অনলাইন প্লাটফর্মে গবাদিপশু ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি গবাদিপশু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হয়েছে। ২০২১ সালে অনলাইনে মোট ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭৯টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ২৭৩৫ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার ৬৭৮ টাকা। গত বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গবাদিপশু বিক্রি হয়েছিল ৮৬ হাজার ৮৭৪টি, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৫৯৫ কোটি ৭৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮২৯ টাকা। প্রতি বছর গড়ে ৫০-৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো কোরবানির পশু বেচা-বিক্রি হয়। অল্পসময়ে আর্থিক আয় তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকে এসব খামারের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এ খাত বড় ভূমিকা রাখছে।
চামড়া শিল্প জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। চামড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। জিডিপিতে চামড়া শিল্পের অবদান প্রায় ০.৪০ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান ৩.৩২ শতাংশ। তৈরি পোশাক শিল্পের পর রপ্তানি আয় অর্জনের ক্ষেত্রে এ খাতের স্থান কখনও দ্বিতীয়, কখনও তৃতীয়। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে এ খাতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন উৎসাহব্যঞ্জকভাবে বর্ধিষ্ণু। এ খাত থেকে ২০১১-১২ সালের ৩৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আয় ২০২০-২১ সালে প্রায় চারগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,২৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এ শিল্পের অধীনে আছে  ট্যানারিসহ, অসংখ্য জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও সুদর্শন সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা। তাতে সরাসরিভাবে নিয়োজিত রয়েছে লাখ-লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। 
ওমাসম (তৃতীয় পাকস্থলীর) আর পিজল (পেনিস) এখন নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। গরু জবাইয়ের পর এক সময় নদী খালে ফেলে দেয়া হতো এসব উচ্ছিষ্ট। যা পরিবেশও দূষণ করত। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা মূল্যের ওমাসম রপ্তানি হয়। করোনা সঙ্কটেও ৩২০ কোটি টাকার ওমাসম বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। বহির্বিশ্বে বেড়েই চলছে দেশের গরু-মহিষের ওমাসম ও পিজলের চাহিদা। এ থেকে তৈরি হয় উন্নত মানের স্যুপ ও সালাদ যা চীন,হংকং, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে  বেশ জনপ্রিয় খাবার। রপ্তানির জন্য ওমাসম ও পিজলের সংগ্রহের ব্যাপ্তি শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশব্যাপী সংগ্রহযোগ্য বিশাল পরিমাণের ওমাসম ও পিজলের বৃহদাংশ রপ্তানি প্রক্রিয়ায় না আসতে পারায় বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গরু-মহিষ জবাইয়ের পরে চামড়া, ওমাসম ও পিজল লবণ দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এসব সংরক্ষণের জন্য আমাদের প্রতি বছর ১ লাখ মেট্রিক টন লবণ প্রয়োজন হয়। এদিকে এসময়  লবণের কৃত্রিম সঙ্কট হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পখাত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার অবদান রাখছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০-১৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লবণ শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল এক কোটি ১৯ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াসহ অন্যান্য গবাদিপশু। কিন্তু এবার সারা দেশে কোরবানি হয়েছে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু। অর্থাৎ প্রায় ২৮-২৯ লাখ গবাদিপশু (২৪%) অবিক্রিতই থেকে গেছে। কোরবানির জন্য সারা বছর গরুসহ অন্যান্য গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ করেও বিক্রি করতে পারেননি খামারি বা ব্যবসায়ীরা। আবার গবেষকরা বলছেন, ঈদুল-আজহায় পশু বিক্রির জন্য অধিক বিনিয়োগে লাভ বেশি  হলেও ঝুঁকি থাকে, আবার সবার ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। 
চ্যালেঞ্জ উত্তোরণের উপায়
গবাদিপশু উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত, বর্জ্যব্যবস্থাপনা, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণসহ ট্যানারিতে পৌঁছা পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অসংখ্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায় ও উপখাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিপুল জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হাউজহোল্ড অনুপাতে ২০২১ সালে গরু-মহিষ কোরবানির সংখ্যা চট্টগ্রাম বিভাগে বেশি হলেও ছাগল-ভেড়া কোরবানির সংখ্যা যথাক্রমে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে বেশি। অপরপক্ষে গরু-মহিষ কোরবানি সংখ্যা ময়মনসিংহ বিভাগে কম। আবার হাউজহোল্ড অনুপাতে গরু-মহিষ কোরবানি সংখ্যা সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে। আর সবচেয়ে কম দেখা যাচ্ছে বরিশাল বিভাগে। উক্ত তথ্য অনুযায়ী আমরা গবাদিপশু উৎপাদন কর্মসূচির পরিকল্পনা উন্নয়ন ও পরিমার্জন করতে পারি। এখানে প্রতিটি বিভাগে  কোরবানির সংখ্যা কমবেশি হওয়ার পেছনে কারণ সমূহ কি রয়েছে তা উদঘাটন করা প্রয়োজন। এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, প্রান্তিক ও অগ্রজ খামারি এবং ফড়িয়াসহ উপকরণ সরবরাহের সহিত জড়িত ব্যবসায়ীবৃন্দকে সমীক্ষার আওতায় এনে, প্রকৃত কারণসমূহ উদঘাটন করে একটি টেকসই গুণগতমানের কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, রংপুর বিভাগে কোরবানির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (প্রতিটি হাউজহোল্ডে ১.৪৬)। এর পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে যেমন উক্ত এলাকায় গবাদিপ্রাণী বাণিজ্যিকভাবে লালন পালন হচ্ছে; খামারি প্রাণিসম্পদ পালনে বেশি সচেতন; দারিদ্র্যের কারণে গরু-মহিষ/ভেড়া ছাগল উক্ত সময় বেশি-বেশি করে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে; ধর্মীয় সংবেদনশীলতার মাত্রা; আর্থিক সঙ্গতি বেশি থাকা; উৎপাদন খরচ কম থাকায় বাজার দর কম থাকা ইত্যাদি। আবার বরিশাল বিভাগে হাউজহোল্ড অনুপাতে কোরবানির প্রাণীর সংখ্যা সবচেয়ে কম (০.০১)। এখানেও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে যা আমাদের এই সমীক্ষার মাধ্যমে উদঘাটন করতে হবে। উক্ত সমীক্ষার আলোকে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে টেকসই প্রাণিসম্পদ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। 
২০৩০ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্বপ্নের উন্নত দেশের সম্মান পেতে হলে; প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের দরকার টেকসই পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে গবাদিপশু উৎপাদন, কোরবানির পশু প্রস্তুতকরণ, অনলাইন প্ল্যাটফর্র্মে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা, খামারি উদ্বুদ্ধকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরি, খোরপোষ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর, কোরবানীর পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা, সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপি), সুসংগঠিতভাবে দেশীয় বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনসহ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কার্যক্রমের সম্প্রসারণ এবং বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং শক্তিশালীকরণ এর দিকে নজর দিতে হবে। এসব সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হবে  বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আর তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের একটি স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশ।

লেখক : জাতীয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা। মোবাইল : ০১৭১৭৯৭৯৬৯৭, মেইল :smrajiurrahman@yahoo.com