Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

তালের চারা উৎপাদন কলাকৌশল

তালের চারা উৎপাদন কলাকৌশল
ড. মো. শামসুল আরেফীন

তালগাছ লম্বাকৃতির সোজা পাম ((Palm) জাতীয় উদ্ভিদ। তালগাছ বাংলাদেশের সকল এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে জন্মাতে দেখলেও সমুদ্রের তীরবর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপকভাবে জন্মে থাকে। এ গাছ পানি ছাড়াই দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। আবার গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়ালেও সহজে মারা যায় না। তাই তাল বরেন্দ্র এলাকা হতে শুরু করে ঝড়-ঝঞ্ঝা-লবণাক্তপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সকল অঞ্চলে জন্মে থাকে। বাংলাদেশে তালগাছ সাধারণত মিষ্টি রস ও সুস্বাদু গুড়ের জন্য জনপ্রিয় হলেও তালগাছের কোন কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। হাতপাখা ও ঘরের ছাউনি তৈরিতে তালের পাতার ব্যাপক ব্যবহার হয়। তালগাছের কাণ্ডও ঘর তৈরিতে ব্যবহার হয়। তালের রস গ্রামাঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন প্রিয় পানীয়। গ্রামবাংলায় পাকা তালেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তালের পিঠা গ্রাম বাংলায় খুবই জনপ্রিয় ও বহুল আদৃত। পাকা তালের পাশাপাশি কাঁচা তালও গ্রাম বাংলায় ছোট বড় সকল শ্রেণির মানুষের নিকট অতি জনপ্রিয়। কাঁচা তালের শাঁস গ্রীষ্মকালের একটি সুমিষ্ট খাদ্য। তালের রস থেকে তৈরিকৃত গুড় আখের গুড়ের চাইতে সুমিষ্ট, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। খাদ্য হিসাবে তালের রস, কাঁচা তালের শাঁস ও পাকা তাল জনপ্রিয় হলেও তালমিছরি আরও বেশি জনপ্রিয় এবং তালের রস থেকেই তালমিছরি তৈরি করা হয়। কাজেই বাংলাদেশে তাল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তালের উৎপাদন প্রযুক্তি অন্যান্য ফসলের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম ধরনের।
তালের উৎপাদন সাধারণত বীজ থেকে সরাসরি হয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে ইহার বেঁচে থাকার ক্ষমতা খুবই কম। অনেক সময় চারা গজালেও বিভিন্ন প্রতিকূলতায় বিশেষ করে লবণাক্ত পানির জোয়ারের কারণে চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। সুতরাং তাল চাষ বৃদ্ধি করতে হলে তালের চারা তৈরির সহজ কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফিজিওলজি এন্ড সুগার কেমিস্ট্রি বিভাগ পলি ব্যাগে তালের চারা তৈরির সহজ  কৌশল উদ্ভাবন করেছে, যা তালের চারা বেঁচে থাকার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
বীজ নির্বাচন
আগস্ট মাস থেকে তাল পাকতে শুরু করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায়। তালবীজ সংগ্রহ করে নির্বাচন করা উত্তম। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত মাতৃগাছ হতে তালের বীজ সংগ্রহ করা উচিত। মাতৃগাছ নির্বাচনকালে তালের আকার-আকৃতি, ফলের রসে চিনির পরিমাণ, ঘ্রাণ, স্বাদ, প্রতি গাছে তালের সংখ্যা, কাণ্ডের আকৃতি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
বীজ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ
উত্তম মাতৃগাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।  পরিপক্ব তাল হতে বীজ সংগ্রহ করে পাকা তালের উপরের শক্ত খোসা ছাড়িয়ে কিছু সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং পরে হাত দ্বারা কচলিয়ে আঁশ হতে রস বের করতে হবে। প্রতিটি তালে সাধারণত তিনটি করে বীজ থাকে এবং রস সংগ্রহ করার সময় বীজগুলো পৃথক হয়ে যাবে। বীজ সংগ্রহের পরপরই বীজতলায় বপন করতে হবে। বীজ শুকিয়ে গেলে অংকুরোদগম হবে না। তাই সংগৃহীত বীজ সতেজ অবস্থায় বীজতলায় রোপণ করতে হবে। পরিপক্ব তালবীজের অংকুরোদগমের হার সাধারণত    ৭০-১০০ ভাগ।
বীজতলা তৈরি ও চারা উৎপাদন
পাকা অথবা ইট বিছানো মেঝেতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। মাটির উপরও বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে চারার শিকড় যাতে বীজতলার তৈরি মাটিতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রথমেই মোটা পলিথিন শিট বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর ১২-১৩ ইঞ্চি বেলে মাটি অথবা কম্পোস্ট দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজতলার আকার হবে ১.২ মিটার প্রস্থ এবং ১২ মিটার অথবা জমির সাইজ অনুযায়ী দৈর্ঘ্য হতে পারে। এ আকারের একটি বীজতলা প্রায় ১০০০টি বীজ রোপণ করা যায়। সংগৃহীত বীজ পাশাপাশি রেখে বীজতলার উপর সাজিয়ে বীজকে ওপর থেকে হাল্কাভাবে চাপ দিয়ে বসাতে হবে এবং পরে বীজের উপর ২-৩ সেন্টিমিটার শুকনা খড় অথবা আখের মরা পাতা দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। বীজতলা সবসময় ভিজিয়ে রাখতে হবে। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই বীজ অংকুরিত হতে শুরু করবে। বীজ অংকুরোদগমের সময় বীজপত্রের যে আবরণী বের হয়ে আসে তা দেখতে শিকড়ের মতো কিন্তু আসলে তা শিকড় নয়। এই বীজপত্রের আবরণীর মাঝে ফাঁপা থাকে, অগ্রভাগে ভ্রƒণ অবস্থান করে এবং টিউবের আকৃতিতে বৃদ্ধি পায়। হলদে     রং-এর জার্মটিউবের অগ্রভাগে ভ্রƒণ আবৃত থাকে এবং তা সাধারণত মাটির নিচের দিকে বৃদ্ধি পায়। জার্মটিউব লম্বা হওয়ার পরেই ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব (ভ্রƒণের কাণ্ডের আবরণী) এবং ঈড়ষবড়ৎযরুধ (ভ্রƒণ মূলের আবরণী) এর বৃদ্ধি শুরু হয়। জার্মটিউবের মতো ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব ১৫-৪০ সেমি. লম্বা হয়ে থাকে। ঈড়ষবড়ৎযরুধ ও শিকড় এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, এদের পৃথক করা কঠিন এবং বীজতলার নিচের মেঝেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। জার্মটিউব লম্ব^া হওয়ার ১০-১৫ সপ্তাহের মধ্যে ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব এর উপরে একটি পাতলা আবরণীতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় চারায় কেবল ১টি ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব ও ১টি শিকড় থাকে। চারার গোড়া ও শিকড়ের গা হতে ছোট ছোট অনু শিকড়ও গজাতে শুরু করে। ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব এর বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হলে বীজের সাথে জার্মটিউবের সংযোগ স্থানে পচতে/শুকাতে আরম্ভ করলে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।
চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর ও নার্সারিতে পরিচর্যা
বীজতলার উৎপাদিত চারা পচা গোরব সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরা ১২ ইঞ্চি দ্ধ ৯ ইঞ্চি আকারের পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। ব্যাগের পুরুত্ব হবে ০.০৬-০.০৭ মিলিমিটার। প্রতিটি পলিব্যাগের নিচের দিকে চার জোড়া ছিদ্র রাখতে হবে। ব্যাগে ভরার জন্য ৫০% মাটির, ২৫% কাঠের গুঁড়া, ২০% পচা গোবর সার এবং ৫% ছাই (এ্যাশ) মিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে। এই মাটি ব্যাগে ভরার আগে মাটিতে তালের চারার শিকড় দ্রুত বৃদ্ধির জন্য শিকড়ের দ্রুত বর্ধনশীল হরমোন রোটন ব্যবহার করতে হবে। প্রতি ৪০ কেজি মাটিতে ৫০ গ্রাম রোটন পাউডার ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তালের চারা পলি ব্যাগে স্থানান্তর করার জন্য প্রথমে বীজতলা খনন করে বেলেমাটি/কম্পোস্ট সরিয়ে চারা উন্মুক্ত করতে হবে। বীজ থেকে চারা আলাদা করার জন্য জার্মটিউবের উপরে অর্থাৎ বীজ সংলগ্ন চিকন, পচা/শুকনো স্থানে কাটতে হবে। যদি চারার শিকড় বেশি লম্বা হয় তাহলে ১০-১৫ সেমি. শিকড় রেখে বাকি অংশ ধারালো চাকু দিয়ে কেটে ফেলতে হবে। পরবর্তীতে এই চারা ছত্রাকনাশক অ্যামিস্টারটব প্রতি লিটার পানিতে             ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে যাতে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করার পর ছত্রাক আক্রমণ না করে। এরপরে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। পলিব্যাগের প্রথমে ১/৩ অংশ গোবর মিশ্রিত মাটি ভরতে হবে। এরপর চারাটি পলিব্যাগের মাঝামাঝি এমনভাবে রাখতে হবে যেন চারার গোড়া প্রায় ৫ সেন্টিমিটার ব্যাগের মধ্যে থাকে। অতঃপর গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ব্যাগের বাকি অংশ ভরে দিতে হবে। পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরের পরে নার্সারিতে সাজিয়ে রাখতে হবে এবং ২-৩ সপ্তাহ আংশিক ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পানি দিয়ে পলিব্যাগের মাটি আর্দ্র রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। পলিব্যাগের চারা সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে এবং রোগবালাই দমন করতে হবে। রোগবালাই এর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতি লিটার পানিতে অ্যামিস্টারটব মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহে একবার তালের চারায় স্প্রে করতে হবে। পলিব্যাগে চারা লেগে যাওয়ার ৩০ দিন পর প্রতি ব্যাগে ৫-১০ গ্রাম ইউরিয়া সার দিলে চারার স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
মাঠে চারা রোপণ
মৌসুমি বৃষ্টিপাত আরম্ভ হওয়ার পরপরই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা পাতাবিশিষ্ট চারা মাঠে রোপণ করা উচিত। তবে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকলে অথবা পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা এপ্রিল-মে মাসেও লাগানো যেতে পারে। সমতল ভূমিতে অন্যান্য বৃক্ষ প্রজাতির পলিব্যাগের চারার মতোই এ চারা লাগাতে হবে। চারা লাগানোর ৭-১৫ দিন আগে চারা লাগানোর নির্দিষ্ট স্থানে ১৮ ইঞ্চি দ্ধ ১৮ ইঞ্চি দ্ধ ১৮ ইঞ্চি আকারের গর্ত করে গর্তের মাটির সাথে পচা গোবর সার বা কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে মাটি দ্বারা গর্তটি ভরাট করে রেখে দিতে হবে। ৭-১৫ দিন পর পুনরায় গোবর সার বা কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটি তুলে গর্তে পলিথিন ছিঁড়ে পলিব্যাগের মাটিসহ চারা গর্তে বসাতে হবে। গোবর সার বা কম্পোস্ট মিশ্রিত গুঁড়ো মাটি দিয়ে গর্তের ফাঁকা ভরাটসহ ভালোভাবে চারার গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে। চারাগুলো আগাছামুক্ত রাখা ও গবাদিপশুর উপদ্রব থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোপণের পর প্রথম তিন বছর রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণের হাত হতে চারা রক্ষা করা আবশ্যক। য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইলঃ ০১৭১১-৩০৩৯৪০
ই-মেইল : arefinbsri@gmail.com