Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ধান উৎপাদনে খরচ কমানোর উপায়সমূহ

ধান উৎপাদনে খরচ কমানোর উপায়সমূহ

কৃষিবিদ অসিত কুমার সাহা

আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনে অনেক অর্জন রয়েছে। স্বাধীনতার আগে দেশের লোকসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি বা তার চেয়ে বেশি কিছু হবে। তখন দানাজাতীয় ফসল উৎপাদন ১ কোটি টন থেকে দশ-পনেরো লাখ টন কম ছিল। দানাজাতীয় ফসলের মধ্যে ধান ফসলই প্রধান ছিল। সামান্য কিছু জমিতে গম চাষ হতো। এখন আমরা  ধান,  গম, ভুট্টা চাষ করে প্রায় ৪ কোটি টন উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি। প্রায় চার গুণ দানাজাতীয় ফসল উৎপাদন করেছেন এদেশের কৃষক। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা এবং প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ লোকসংখ্যা যোগ হচ্ছে। বর্তমান সরকারের অদম্য প্রচেষ্টায় ধান উৎপাদনে বিশে^ তৃতীয় স্থান অধিকার করে নিয়েছে। এ অর্জন করার পরও আমাদের ধানচাষিরা ধানের যথাযথ মূল্য না পাওয়াতে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। সে কারণে ধান উৎপাদনে খরচ কমানোই আজকের আলোচ্য বিষয়। ধান উৎপাদনে বীজ নির্বাচন, জমির ধরন, স্থানীয় আবহাওয়া, ধানের জীবনকাল, ধানের ফলন এর টার্গেট (লক্ষ্যমাত্রা) বিবেচনায় এনে ধান বীজের জাত নির্বাচন করলে খরচ কমানো সম্ভব। স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে ক্রয় করার সময় অবশ্যই বীজের মূল্য, বীজ গজানোর হার হেক্টরপ্রতি ফলন অবশ্যই ধানবীজের বস্তার গায়ে উল্লেখ থাকতে হবে। ক্রয় রসিদে বীজের মূল্য উল্লেখ থাকতে হবে। বিএডিসির বীজের ট্যাগ লাগানো আছে কি না দেখে কিনতে হবে।
বীজ শোধন : বীজ শোধন করে নিলে বীজে রোগের আক্রমণ কম হয়। চারা সুস্থ, সবল হয়। বীজ শোধনকারী দিয়ে অথবা প্রতি কেজি ধান বীজের জন্য ১ গ্রাম হারে তুতের গুঁড়ো দিয়ে বীজ শোধন করা যেতে পারে।
বীজতলার যত্ন : বীজতলা উত্তমরূপে চাষ দিতে হয়, উপরিভাগ  সমতল হতে হবে। দুটি বীজতলার মধ্যে নালা বা ড্রেন রাখলে বীজতলায় সেচ প্রদান করতে সুবিধা হয় এবং অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব।
আদর্শ বীজতলায় ১০-১৫% কম বীজ প্রয়োজন  হয়। এতে উৎপাদন  খরচ কম হয়।
চারার বয়স : মৌসুম, ধানের জাতের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে চারার বয়স। বেশি বয়সের চারা রোপণ করতে নাই। আমন মৌসুমে ২০-২৫ দিনের, বোরো মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ দিনের চারা নির্বাচন করতে হয়।
চারার সংখ্যা : প্রতি গর্তে সুস্থ-সবল-নিরোগ চারা, রোপা আমন মৌসুমে ২টি দিতে হয়। গর্তে বেশি চারা দিলে ফলন বেশি হয় না। সে কারণে সঠিক চারার সংখ্যা নির্ধারণ করে উৎপাদন খরচ কমানো যায়।
রোপণ দূরত্ব : মৌসুম, জাতের বৈশিষ্ট্য জীবনকালের ওপর ভিত্তি করে ধানের চারার রোপণ দূরত্ব নির্ধারণ করতে হয়। সারি থেকে সারি ২৫ সেন্টিমিটার, গাছ থেকে গাছ ২০ সেন্টিমিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করা হলে চারার সংখ্যা কম লাগে। এতে চারার খরচ কমে যায়।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : সার হলো গাছের খাদ্য। গাছ মাটি থেকে শিকড়ের মাধ্যমে সার গ্রহণ করে। জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করা হলে অতি সহজে শিকড় মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। ধান ফসলে ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কাজে লাগে। ধানের জমিতে সার প্রয়োগের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে। ধানের চারা রোপণের ১০ থেকে ১২ দিন পর প্রথম ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করলে ভালো হয়। ওই সময় জমিতে ছিপছিপে ২ ইঞ্চি পানি থাকলে ভালো হয়। গুটি     ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে, ফলন বাড়ে। ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ইউরিয়া সারের পরিমাণ কম লাগে। এতে করে সারের খরচ অনেকটা কমে যায়।
খরচ কমাতে সেচ ব্যবস্থাপনা : সেচ খরচ কমানোর জন্য সঠিকভাবে ধানের জীবনকাল এর স্তর অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হয়। যদি সম্ভব হয় পর্যায়ক্রমে জমি শুকনো ভেজা করলে ভালো হয় (কাঁইচ থোড় আসার পূর্ব পর্যন্ত)। বীজতলা তৈরির সময়, বীজ বপনের পর শুকিয়ে গেলে ২বার। জমি কাদা করবার সময় ১ বার। রোপণের সময় প্রায় ৭.৫ সেমি. পানি থাকা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ৪-৫ বার সেচ দেয়া যেতে পারে। রোপণের পর হইতে দানাপুষ্ট হইবার পূর্ব পর্যন্ত ৫-৭.৫ সেমি. পানি থাকা প্রয়োজন। ফসলে সার প্রয়োগের সময় পানি  বের করে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ২-৩ দিন পর পুনরায় পানি দিতে হবে ৭-৮ বার।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধানের স্তর হলো ফুল ও দুধ অবস্থা। ফুল অবস্থায় বোরো ধানের/রোপা আমন ধানের জমিতে কমপক্ষে ২ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখলে ভালো হয়। বিকালে সেচ দিলে পানি বাষ্পীভবন কম হয়। মাটির গর্ত বা ফাটল বন্ধ করা উচিত। জমির আইল ঠিক রাখতে হবে। রোপা আমন মৌসুমে বর্ষার অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় খরচ কমানোর উপায় : ধান ফসল উৎপাদনে রোগ ও পোকা মাকড়ের আক্রমণে প্রায় ১৫ থেকে ২০% উৎপাদন খরচ হয়। ধানক্ষেত থেকে ২০০ থেকে ৩০০ মিটার দূরে আলোক ফাঁদের ব্যবস্থা করতে হবে। সবুজপাতা ফড়িং, মাজরা পোকার মতো পাতা মোড়ানো পোকা আলোকে আকৃষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। পার্চিং বা ডাল পুঁতে দিতে হবে ধানক্ষেতে। হাতজাল দ্বারা পোকার মথ ধরে মারতে হবে।
লোগো পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণ করতে হবে। এতে ধানক্ষেতে আলো ও বাতাস প্রবাহিত হবে। বাদামি গাছফড়িং এর আক্রমণ কম হবে। বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণকালে ধানের জমিতে পানি থাকলে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া। এই সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ বন্ধ রাখুন। কীটনাশক প্রয়োগ করার সময় গাছের গোড়ায় কীটনাশক দিতে হবে। জমির আইলে কিছু নাড়া খড়কুটো দিয়ে রাখলে শীষকাটা লেদা পোকার কীড়া এখানে আশ্রয় নেয়।
ধান কাটার পর ধানের খড় সম্ভব হলে পুড়িয়ে ফেলুন। শীষকাটা লেদাপোকা গাছ বেয়ে ওপরে উঠে এবং শীষ কেটে দেয়। সম্ভব হলে ধানগাছ বাঁশ দিয়ে শুইয়ে দিন। চুঙ্গি পোকার ধানক্ষেতে দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে দিন। ক্ষেতে পানি না থাকলে পোকার কীড়া পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না।
ধানের রোগ দমন ব্যবস্থাপনা : ধানের রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার বাড়াতে হবে। অধিক মাত্রায় নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। ঝড়ের পর নাইট্রোজেন জাতীয় সার উপরিপ্রয়োগ করা যাবে না। ফসল সংগ্রহের পর জমির নাড়া পুড়িয়ে দিতে হয়।
ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে বিঘাপ্রতি (৩৩ শতাংশ) ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করে  দিতে হবে। ব্লাস্ট রোগসহনশীল ধানের জাত ব্রি ধান ২৮, বিআর১৬ ব্যবহার করতে হবে। এই রোগ দেখা দিলে জমিতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। যে সকল ধানের জমিতে নাইট্রোজেন ও পটাশ সারের ঘাটতি রয়েছে, ঐ সব জমিতে বাদামি দাগ রোগ দেখা যায়। সে কারণে দাগি ধানবীজ ব্যবহার করা যাবে না। সুস্থ-সবল বীজ ব্যবহার করুন। জমিতে অনুমোদিত মাত্রায় ইউরিয়া ও পটাশিয়াম ব্যবহার করুন। খোল পচা রোগের ক্ষেত্রে রোগ সহনশীল জাত যেমন- ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১ ব্যবহার করতে হবে।
উফরা রোগ, এটি কৃমিবাহিত (নিমাটোড) রোগ। আক্রান্ত ক্ষেতের পানি অন্য ক্ষেতে দেওয়া যাবে না। জমির ফসল সংগ্রহের পর অন্য ফসল চাষের পূর্বে জমি চাষ দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন ফেলে রাখতে হবে।
ধানের জমিতে  আগাছার আক্রমণে নিচু জমিতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০% ফলন কম হতে পারে। আগাছা মুক্ত ধানবীজ ব্যবহার করতে হবে কৃষি যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে হবে, আইল, সেচনালা পরিষ্কার রাখতে হবে। আধা পচা গোবর সার ব্যবহার না করা।  সার উপরি প্রয়োগকালীন একই সময় হাত দিয়ে আগাছা তুলে মাটি চাপা দেয়া যেতে পারে।
ধানক্ষেতে চারা রোপণের পর কিছুদিন পানি রাখলে আগাছা কম হয়। আগাছার ফুল অথবা পরিপক্ব হওয়ার আগে তুলে ফেলতে হবে।
ওপরের ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করলে ধান উৎপাদনে খরচ অনেকটা কম হবে। য়

 সাবেক উপপরিচালক, ডিএই, গোপালগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭১২২৫৭০৬২  ই-মেইল : ashit.saha001@gmail.com