Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় এক পবিত্র ফল ত্বীন (ডুমুর)

বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় এক পবিত্র ফল ত্বীন (ডুমুর)
ড. শামীম আহমেদ
বাংলাদেশ আয়তনের তুলনায় বেশ ছোট একটি দেশ, তার উপর প্রবল জনসংখ্যার চাপ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনার কারণে ফসলি কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর। এত কিছুর পরও বাংলাদেশর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে সীমিত সাধ্য নিয়েই কৃষি খাতে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে। কৃষিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পাট রপ্তানিতে ১ম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, ধান ও সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপদনে ৮ম ও ফল উৎপাদনে ২৮ তম। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং  কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই এই সফলতা অনেকটা সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জমির বিবেচনায় মূল্যায়ন না করে  ছোট, মাঝারি ও মধ্যমমানের পাহাড়ি এলাকা এবং বাড়ির আঙ্গিনাতে ছোট ছোট ফলের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র গড়ে তোলার এক দুর্দান্ত সম্ভাবনা রয়েছে। আজকাল কিছু গ্রাহক তৈরি হয়েছে যাদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট বাজার রয়েছে যেখান থেকে তারা কৃষকদের নিজের উদ্ভিদ থেকে বা বাগান থেকে তাজা ফল সংগ্রহ করে উপভোগ করতে পছন্দ করেন। এসব ফলকে কেউ কেউ ফার্মফ্রেশ বা অর্গানিক বাগান নামে পরিচয় দেন। অনেক ক্ষেত্রে এসব স্থানে এগ্রো টুরিজমও গড়ে উঠেছে।  এসব বাগানে অনেক প্রকৃতির এক্সোটিক ফল বা গৌণ ফলের চাষাবাদ হচ্ছে। এমনই এক এক্সোটিক ফলের নাম ত্বীন বা ডুমুর। ইংরেজিতে এই ফলকে বলা হয় ঋরম যার  বৈজ্ঞানিক নাম ভরপঁং পধৎরপধ যা গড়ৎধপবধব পরিবারের অন্তর্গত। এর মধ্যে রয়েছে ৬০০  থেকে ১৯০০ এরও  বেশি জাত, যার বেশির ভাগ জন্মে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উদ্যানতত্ত্বের সাথে ডুমুর ফলের নাম দীর্ঘকাল ধরে জড়িত। সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এই ফলকে ত্বীন (ডুমুর) নামে ডাকলেও অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্দান ও যুক্তরাষ্ট্রে এটি আঞ্জির নামে পরিচিত।   
পবিত্র কুরআন মাজিদের আত-ত্বীন সূরায় বর্ণিত ত্বীন ও জয়তুন ফলের গুণাগুণ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। সেই ত্বীন বা ডুমুর গাছগুলো সাধারণত পাতলা, দ্রুত বর্ধনশীল এবং বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যার ফলে গাছগুলো উচ্চতার চেয়ে প্রস্থে বেশি হয়ে থাকে। ত্বীন চরম জলবায়ু অর্থাৎ শুষ্ক ও শীত প্রধান দেশে চাষ হলেও আমরা প্রমাণ করেছি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতেও ৩৬৫ দিন এ ফল উৎপাদন সম্ভব।
ডুমুরের অনুমোদিত কোনো জাত নাই। তবে বাংলাদেশে গ্রামেগঞ্জে ডুমুরের যে গাছগুলো হয় সে ডুমুরগুলো হলো জগডুমুর। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঋরপঁং ৎধপবসড়ংধ। জগডুমুরের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। কোনোটি বিশ-ত্রিশ গ্রাম, আবার কোনোটি   পঞ্চাশ-ষাট গ্রাম ওজনের হয়। পাকলে কোনোটি লাল, আবার কোনোটি হলুদ রঙ ধারণ করে।
এ ছাড়াও আরেক প্রজাতির মূল্যবান ডুমুর আছে, যেটিকে   মিসরীয় ডুমুর (ঊমুঢ়ঃরধহ ঋরপঁং) বলা হয়। এটি খুব রসালো ফল ও অনেক বড় হয়। এটি দু’ভাবে খাওয়া যায়। একটি হলো কাঁচায় সরাসরি খাওয়া যায়। অন্যটি হলো রোদে শুকিয়ে কাঁচের কন্টেইনারে রেখে সারা বছর খাওয়া যায়।
প্রতিটি গাছ থেকে প্রথম বছরে এক কেজি, দ্বিতীয় বছরে        ৭  থেকে ১১ কেজি, তৃতীয় বছরে ২৫ কেজি পর্যন্ত ফল ধরে। এভাবে ক্রমবর্ধিত হারে একটানা ৩৪ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে। গাছটির আয়ু হলো প্রায় ১০০ বছর। তিন মাসের মধ্যেই শতভাগ ফলন আসে। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ডুমুর আকৃতির এই ফল সবার দৃষ্টি কেড়েছে। প্রতিটি পাতার গোড়ায়  গোড়ায় ত্বীন ফল জন্মে থাকে।
ত্বীন বা ডুমুরের জৈবিক বৈশিষ্ট্য
ডুমুর ফল একটি সমন্বিত বা কম্পোজিট আকৃতির ফল যা মূলত : ফাঁকা শেলের মধ্যে অভ্যর্থনা টিস্যু বা ৎবপবঢ়ঃধপষব ঃরংংঁব   দ্বারা ঘেরা পৃথক পৃথক স্ত্রী ফুল থেকে শত শত পৃথক পেডিকেলেট ড্রপলেটস আকারের অভ্যর্থনা প্রাচীরের আস্তরণ থেকে বিকাশ লাভ করে।  কম্পোজিট আকৃতির ফলকে বলা হয় ‘ংুপড়হরঁস’। একটি পরিপক্ব ডুমুর ফলের ত্বক শক্ত চামড়া বিশিষ্ট সাদা রঙের হয়ে থাকে। ভেতরে একটি মিষ্টি জিলেটিনাস সজ্জা সমন্বিত পৃথক পৃথক পাকা ড্রপলেটের অস্তিত্ব বিশিষ্ট বীজ বিদ্যমান। এই পুরো অভ্যন্তরীণ অংশটিই ভক্ষণযোগ্য। স্বতন্ত্র ফলের পাশাপাশি ডুমুর পরাগায়ন বায়োলজিও বেশ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। জংলি ডুমুর গাছে একই  ‘ংুপড়হরঁস’ এ কার্যকরী পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ফুলই বিদ্যমান। ভক্ষণযোগ্য ডুমুরের স্ত্রী ফুল সাধারণত বড় আকৃতির হয় এবং রসালো ফ্রুটলেট তৈরি করে।
ত্বীন বা ডুমুর গাছের আকৃতি ও চারা মূল্য
ত্বীন গাছগুলো দ্রুতবর্ধনশীল, ঝোপালো আকৃতির হওয়ায় এই গাছগুলো যেমন বৃদ্ধি কম হয়, তেমনি এর কাণ্ড খুব নরম     প্রকৃতির হয়। তাই ত্বীন বা ডুমুরের যেমন কাটিং করে বংশবিস্তার করা যায় তেমনি বীজ থেকেও চারা উৎপাদন করা যায়। প্রতিটি গাছ ছয় থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছে ন্যূনতম ৭০ থেকে ৮০টি ফল ধরে।  খোলা মাঠ ছাড়াও টবের মধ্যে ছাদ বাগানে ত্বীন চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। দুই মাস বয়সি চারার পাইকারি মূল্য ৫২০ টাকা ও খুচরা মূল্য ৭২০ টাকা।
মাটিতে কিংবা টবে ত্বীন বা ডুমুর ফলের চাষাবাদ পদ্ধতি
কোনো রাসায়নিক সার ছাড়াই, মাটিতে জৈব ও কম্পোস্ট সার মিশিয়ে রোদে মাঠে ও ছাদে টবে লাগিয়ে ত্বীন ফল উৎপাদনে সাফল্য পাওয়া গেছে। তাই ছাদবাগানীদের মধ্যে  বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ফল গাছের তুলনায় ডুমুর গাছে খুব দ্রুত ফল ধরে। একটি ডুমুরের কাটিং চারা লাগানোর      ৪-৫ মাস পর থেকেই ফল দিতে শুরু করে। তাই গাছ লাগানোর ২-৩ মাস পর থেকেই টবের গাছকে নিয়মিত অল্প করে সরিষার খৈল পচা পানি দিতে হবে।  সে অনুযায়ী ১০-১৫ দিন পর পর সরিষার খৈল পচা পানি প্রয়োগ করতে হবে। সরিষার খৈল গাছে দেওয়ার কমপক্ষে ১০ দিন আগেই পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে সেই পচা খৈলের পানি পাতলা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। ১ বছর পর টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করে দিতে হবে। ২ ইঞ্চি প্রস্থে এবং ৬ ইঞ্চি গভীরে শিকড়সহ মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তা ভরে দিতে হবে। টবের মাটি পরিবর্তনের কাজটি সাধারণত শীতের আগে ও বর্ষায় শেষ করাই ভালো হয় । টব বা ড্রামের মাটি ১০-১৫ দিন পর পর কিছুটা খুঁচিয়ে দিতে হবে।
ত্বীন বা ডুমুরের পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
পোকামাকড়ের মধ্যে গবষড়রফড়মুহব, ঘবসধঃড়ফধ দ্বারা ডুমুর গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। অৎঃযৎড়ঢ়ড়ফ এর দ্বারাও ডুমুর গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে ফল ভেঙে যাওয়া রোগ (ভৎঁরঃ ংঢ়ষরঃঃরহম) হতে দেখা যায়। অষঃবৎহধৎরধ,    অংঢ়বৎমরষষঁং, ইড়ঃৎুঃরং, এবং চবহরপরষষরঁস  ছত্রাক রোগ দমনে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়। ডুমুরের আর একটি কমন রোগ হলো ভরম সড়ংধরপ ফরংবধংব (ঋগউ) যা হলে ডুমুর গাছ মোজাইকের মতো হলুদ রং ধারণ করে। এ সমস্ত রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে নিকটবর্তী কৃষি অফিসে   যোগাযোগ করে পরিমিত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
ত্বীন বা ডুমুর ফলের পুষ্টি গুণাবলি
ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ২, ছাড়াও প্রায় সব রকমের জরুরি নিউট্রিশনস যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ইত্যাদি আছে। ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাবজনিত রোগে এটি বেশ কার্যকরী। কার্বোহাইড্রেট, সুগার, ফ্যাট, প্রোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ছাড়াও বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ডুমুর। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি ডুমুরের অনেক ঔষধি গুণও রয়েছে। ডুমুর কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে সহায়তা করে। ডুমুর দেহের ওজন কমানো, পেটের সমস্যা দূর করা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখাসহ নানা উপকার করে থাকে। মৃগীরোগ, প্যারালাইসিস, হৃদরোগ, ডিপথেরিয়া, প্লীহা বৃদ্ধি ও বুকের ব্যথায় ডুমুর কার্যকরী। ডুমুর শরীরে এসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। শরীরে পিএইচের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ডুমুর পাতা ডায়াবেটিক রোগীদের ইনসুলিন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালের নাশতার সঙ্গে ডুমুরের পাতার রস খেতে হবে। ডুমুর ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও ডুমুর গাছের কষ পোকার কামড় বা হুল ফুটানো ব্যথা নিরাময়ে কার্যকরী।
ত্বীন বা ডুমুরের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ব্যাপক ত্বীন চাষাবাদের ফলে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি বিকল্প আরেকটা সম্ভাবনা হিসেবে ত্বীন ফলের চাহিদা দেখা দিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই ফল রপ্তানি করে আন্তর্জাতিকভাবে বাজার ধরা সম্ভব। ত্বীন একটি সম্ভাবনাময় ফসল। যা চাষ করে দেশের বেকারত্ব দূর এবং রপ্তানি করে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে চাষাবাদকৃত ত্বীন বা ডুমুরের জাতগুলোর মধ্যে ফল নীল, মেরুন, লাল, হলুদসহ বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। এখানকার গাছে প্রতিটি ত্বীন ফল ওজনে ৭০ থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ডুমুরের প্রতি কেজির মূল্য এক হাজার টাকা। ফলের পাশাপাশি শৌখিন চাষিরা চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায় টবসহ ফল ধরা চারা বিক্রি হচ্ছে। রমজানে পবিত্র ফল হিসেবে খেজুরের পাশাপাশি ত্বীন ফলকে নিয়েও অনেকে ভাবছেন। দেশের প্রচার মাধ্যমে ত্বীন ফলের চাষ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়াও বিদেশ থেকে ত্বীনের আমদানি নির্ভরতা কমে আসার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া বাজারেও এই ত্বীন ফলের একটি বড় ব্যবসায়িক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্সোটিক বা গৌণ ফল হিসেবে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুটস কিংবা এভোকেডোর চেয়ে ত্বীন ফলের চাহিদা বেশি। য়
অতিরিক্ত উপপরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫
ইমেইল : ashamim.uni@gmail.com