Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাঙালির ঐতিহ্য খেজুরের রস ও গুড়

বাঙালির ঐতিহ্য খেজুরের রস ও গুড়
মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার


শীতকালের প্রধান আকর্ষণ খেজুরের রস ও খেজুরের গুড়। শীতের পিঠা পুলি তৈরিতে খেজুরের গুড়ের জুড়ি নেই। খেজুরের গুড়ের স্বাদ লাভের জন্য হেমন্তের শুরু থেকেই গ্রাম বাংলায় প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এ সময়ে গাছিরা (যারা খেজুর গাছে কেটে রস সংগ্রহ করে) বাড়িবাড়ি ঘুরে গাছ পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোন কোন গাছ হতে রস সংগ্রহ করবেন তা নির্ধারণ করেন। গাছ কাটার জন্য সংগ্রহ করেন ধারালো কাঁচি, ছোট ও মাঝারি আকারের ঘটি/হাঁড়ি, মোটা রশি,  চুন ইত্যাদি। মাটির হাঁড়ি সমূহের বহিরাংশে চুন দিয়ে কয়েক দিন রৌদ্রে শুকিয়ে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করেন। সেইসাথে শীতের শুরুতে ধারালো কাঁচি দিয়ে খেজুর গাছের পুরাতন ডালা কেটে দেন। যে দিকটায় রস সংগ্রহ করা হবে সেদিকে ত্রিভুজ আকৃতিতে বেশি করে কাটা হয়। যাতে গাছের দেহের সাদা অংশ স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়। ছাঁটাইকৃত ঢালাসমূহ ঘরের বেড়া ও রান্নাঘরে ছাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। শীতর তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে গাছের মাথার        ছাঁটাইকৃত অংশ হতে রস বের হতে শুরু করে। তখন গাছিরা প্রতিদিন/একদিন অন্তর অন্তর (গাছের বয়সভেদে) রস সংগ্রহ করার জন্য কেটে দেন। ত্রিভুজ আকৃতিতে কাটার সুবিধা হলো রস গড়িয়ে নিচের দিকের মধ্যখানে এসে জমা হয়। এ অংশে একটি বাঁশের নলা যুক্ত করে দেয়া হয়, যাতে সে নলা দিয়ে ঘটি/হাঁড়িতে রস জমা হতে পারে। এ ছাড়া উপরের দুইদিকে দুটি শক্ত বাঁশের কঞ্চি বা ফলা গাছে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়, যাতে নির্ধারিত হাঁড়ি/ঘটিটি রশির মাধ্যমে ঝুলিয়ে রাখা সম্ভব হয়। গাছে উঠা বা অবস্থানের জন্য শক্ত ও মোটা রশি ব্যবহার করা হয়। গাছের গায়ে নির্দিষ্ট উচ্চতা পরপর ছোট ছোট বাঁশের টুকরা  শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয় যাতে গাছের শীর্ষে উঠা সহজতর হয়। আর রসের হাঁড়ি উঠানো ও নামানোর জন্য গাছিরা তাদের দেহের পেছনে কোমড়ের দিকে একটি বাঁশের আংটা রশি দ্বারা ঝুলিয়ে রাখেন। সে আংটায় শূন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে বিকালে গাছে উঠেন আর ভোরে রস ভরা হাড়ি আবার সেই আংটায় ঝুলিয়ে নিচে নেমে আসেন। প্রতিদিন দুপুরের পর হতে গাছের গলার বাকল ছেটে দিয়ে শূন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেন। যা সন্ধ্যা অবধি চলতে থাকে। আবার পূর্ণ রসের হাঁড়ি কাকডাকা ভোর হতে নামানো শুরু হয়। রস সংগ্রহের জন্য ঘটি/হাঁড়িসমূহ সাধারণত মাটির তৈরি হয়ে থাকে। এসব হাঁড়ি হতে রস সংগ্রহের পর এগুলো প্রতিদিন ধুয়ে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকাতে হয় যাতে পোকা বা ছত্রাকের আক্রমণ না ঘটে।


শীতের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদে গাছিদের খেজুর গাছের শীর্ষে আহরণ এবং কুয়াশার চাদরে ঢাকা ভোরে রসের হাড়ি নামানো গ্রামীণ জনপদের একটি অতিসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর চিত্র। তবে এসব গাছির আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। এদের অধিকাংশই সাধারণত মধ্য বয়সি এবং গরিব। যাদের ভালো মানের গরম কাপড়ও নেই, যার দ্বারা শীত নিবারণ করতে পারেন। শীত নিবারণে গাছিরা সাধারণত  গায়ে একটি চাদর ব্যবহার করেন এবং প্রচণ্ড শীতের ভোরে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে কুয়াশাচ্ছন্ন ও শিশিরসিক্ত মাঠ পেরিয়ে রস সংগ্রহে এ পাড়া হতে ও পাড়ায় দোড়ান। বর্তমানের তুলনায় অতীতে শীতের তীব্রতা অনেক বেশি ছিল। প্রবাদ আছে মাঘের শীতে বাঘ পালায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। বৈশ্বিক উষ্ণতায় প্রভাব তখনও উপলব্ধি করা যায়নি। সে সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে খেজুরের রসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। দেশে ব্যবসা বাণিজ্য বা চাকরির সুযোগ খুব একটা ছিল না। তাই কর্মসংস্থান ও উপার্জনের জন্য কৃষিই ছিল প্রধান অবলম্বন। খেজুরের রস সংগ্রহ কৌশল বা জ্ঞান সবার জানা ছিল না। যারা একাজ করতেন তাদের গুরুত্ব ছিল অধিক। শীতে গরিব গাছিদের আর্থিক উপার্জনের প্রধান অবলম্বনই ছিল খেজুরের রস সংগ্রহ। সংগৃহীত রস গাছের মালিক ও গাছির মধ্যে আধা আধি ভাগ হতো। পরিবারের প্রয়োজনের চাহিদার পর যে উদ্বৃত্ত রস থাকতো তা আড়ৎ (সকালের বাজার) বা নিকট প্রতিবেশীদের নিকট বিক্রয় করা হতো। এ ছাড়া কাঁচা খেজুরের রস জাল দিয়ে ঘন করে তরল গুড় তৈরি করে সংরক্ষণ করা হতো। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গুড় ঘন করে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপ দিয়ে পাটালী (গুড়) তৈরি করা হতো। যেহেতু পূর্বে গ্রাম বাংলায় চিনির ব্যবহার খুব একটা ছিল না। তাই মিষ্টান্ন তৈরিতে আখের বা খেজুরের গুড়ের উপরই গ্রামের মানুষকে নির্ভর করতে হতো। শীতে আতপ চালের পায়েস রান্নায় কাঁচা খেজুরের রসের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। শীতের সকালে কাঁচা খেজুরের রস আর মুড়ি ছিল পাঠশালা/মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের সকালের প্রাথমিক নাশতা। পাঠশালা শেষে বাড়ি গিয়ে খেজুরের রস নিয়ে রান্না আতপ চালের  পায়েস ছিল শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ। কৃষকেরাও মাঠের কাজ শেষে কাঁচা খেজুরের রসের পায়েস খেতেন সকালের নাশতা হিসেবে।


বাংলাদেশের বেশকিছু জেলা খেজুরের গুড়ের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এসব এলাকা মূলত কৃষি প্রধান এবং জীবনযাত্রার মানও অন্যান্য জেলার তুলনায় নিম্ন। এসব অঞ্চলে শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহে পর্যাপ্ত গাছী পাওয়া যেতো। দেশের যশোর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ জেলায় খেজুর গাছের আধিক্য অদ্যাবধি লক্ষ করা যায়। এ সকল অঞ্চলে তৈরি  উন্নত মানের খেজুরের গুড় এখন দেশের সব নামী-দামি সুপার শপে বা দোকানে বিক্রি হতে দেখা যায়। যদিও দেশের সর্বত্র কমবেশি খেজুরের গাছ রয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরির প্রসার প্রভৃতি কারণে এ পেশায় লোকের সংকট দিন দিন তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। বর্তমানে গাছ থাকলেও রস সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত গাছি পাওয়া যায় না। আবার খেজুর গাছ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় এ গাছ সংরক্ষণ ও বিস্তারে মানুষ আর আগের মতো আগ্রহী নন।  জ¦ালানি হিসেবে ইটের ভাটায়ও রয়েছে গাছের ব্যাপক চাহিদা। তাই পুরাতন ও বয়স্ক খেজুর গাছ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নতুন করে আর খেজুর গাছ তৈরি হচ্ছে না। তাই খেজুরের রস ও গুড়ের জোগান প্রতিনিয়ত কমছে, অপরদিকে চাহিদা বাড়ছে। মানুষ এখনও বেশি দামেও ভাল মানের খেজুরের গুড়ের প্রত্যাশী। কিন্তু জোগান কম বিধায় প্রতি বছর শীত মৌসুমে খেজুরের রস ও গুড়ের দাম বাড়ছেই। সে সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী খেজুরের গুড়ের সাথে চিনি, ময়দা, রং, হাইড্রোজ, ফিটকিরি, সালফার, খাবার সোডা ও ফ্লেবার মিশিয়ে বাজারে ভেজাল খেজুরের গুড় সরবরাহ করছে।


খেজুরের গুড় উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে। বর্তমানে শ্রমের মজুরী অনেক বেশি। সেইসাথে এই কাজের জন্য উপযুক্ত জ্ঞানসম্পন্ন জনবলেরও অভাব রয়েছে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ভোরে গাছের চুড়ায় উঠে রস সংগ্রহ এবং বিকেলে আবার গাছে ঘটি/পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। একাজে বর্তমান প্রজন্মও আগ্রহী নয়। তবে খেজুরের গুড়ের কদর বা আগ্রহ রয়েছে দেশের প্রায় সর্বত্র। খেজুরের গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পেশায় পরবর্তী প্রজন্মকে আগ্রহী করাতে গাছের ডালা কাটা ও বাকল তোলার মতো কষ্টকর কাজটি যান্ত্রিক উপায়ে করতে হবে। এ ধরনের কাজের জন্য কোরিয়ায় লম্বা লাঠিযুক্ত কাঁচি বা করাত ব্যবহার করা হয়। এতে করে গাছে না উঠেই ভূমি হতে গাছের পরিচর্যা করা যায়। আবার থাইল্যান্ডে খেজুরের গুড় প্লাস্টিকের কৌটায় ঢালার পূর্বে উপরের স্তরের ও নিচের স্তরের গুড়কে একসাথে মিশাতে মোটরচালিত পাখা ব্যবহার করা যায়। এতে শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যায়। তাই খেজুরের গুড়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটাতে খেজুরের গুড় উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে। তবেই খেজুরের গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। পেশাটি হবে লাভজনক।


খেজুরের গুড়ের চাহিদা মিটাতে খেজুর গাছের সংখ্যা বহুগুণে বাড়াতে হবে। যেহেতু খেজুর গাছ তৈরি ও এর ব্যবস্থাপনা এখন আর লাভজনক নয়, তাই এ গাছের বংশবৃদ্ধিতে কৃষকেরা খুব একটা আগ্রহী নন। সরকারি জমিতে, মহাসড়ক ও সড়কের মাঝে এবং গ্রামীণ রাস্তার দুইপাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ গাছ লাগাতে হবে। সেইসাথে দেশীয় খেজুরের চারার সাথে সাথে বিদেশি (আরব) জাতের খেজুরের চারা সংগ্রহ করে   যুগপৎভাবে চাষ করতে হবে। যাতে শীতে দেশীয় জাতের খেজুরের গাছ হতে রস এবং গ্রীষ্মে বিদেশি জাতের খেজুরের গাছ হতে খেজুর পাওয়া যায়। যদি শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই এ পেশা হতে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে তবে  কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং এ কার্যক্রম অর্থনৈতিকভাবে উপযোগিতাও লাভ করবে। অপরদিকে খেজুর গাছ কাটা, ছাঁটাই ও ঘটি প্রদান কার্যক্রম প্রযুক্তি নির্ভর হতে হবে। নতুন গাছ তৈরি, রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি ও তা সংরক্ষণে কৃষকদের দিতে হবে প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ও আর্থিক  সহায়তা। নিশ্চিত করতে হবে খেজুরের গুড়ের যথাযথ মূল্য। তবেই খেজুরের গুড়ের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। আর তা না হলে নামেই থাকবে খেজুরের রস, খেজুরের গুড়, দক্ষিণের দ্বার মাদারীপুর এর মতো ব্রান্ডিং।

লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawseru11173@gmail.com