Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সম্ভাবনার দ্বার : কন্দাল ফসল

সম্ভাবনার দ্বার : কন্দাল ফসল
কৃষিবিদ মোছাঃ মাহ্মুদা আক্তার

বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কৃষির উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার সময় এসেছে। বর্তমান সরকারও কৃষির বহুমুখীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়ন এর উপর গুরুত্বারোপ করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কিন্তু অন্যান্য ফসল উৎপাদনের এখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় শক্ত ভিত গড়তে ভূমিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও আয়ের উপর ভিত্তি করে কন্দাল ফসল হতে পারে শস্য বহুমুখীকরণের এক উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। বাংলাদেশ সুপ্রাচীনকাল থেকেই কন্দাল ফসল চাষের উপযোগী।  এ দেশের নিচু ও জলাভূমি বাদে প্রায় সমগ্র দেশেই এ জাতীয় ফসল চাষ সম্ভব যা শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার জন্যও এই ফসল সবচেয়ে উপযোগী হতে পারে। একক জমিতে এর উৎপাদন যেমন বেশি, আবার সংরক্ষণগুণ দীর্ঘ হওয়ার জন্য সহজেই দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এ ফসলের। এই ফসলের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে পারে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশে আলু, মিষ্টিআলু, কচু, গাছআলু বা মেটেআলু, কাসাবা, শটি ইত্যাদি কন্দাল ফসল হিসাবে আবাদ হয়। অধিক শর্করা সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এটি অনেক দেশে প্রধান খাদ্য এবং প্রধান সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।


বাংলাদেশে  প্রায় ৫.৬৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে কন্দাল ফসলের চাষ করা হয় যার বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৯৫ লক্ষ টন সারণি দ্রষ্টব্য।
কন্দাল ফসল দেশের খাদ্য ঘাটতি এবং পুষ্টির অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কন্দাল ফসলসমূহ ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ ও খনিজসহ অনেক পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ থাকে।
পুষ্টির দিক বিবেচনায় সাধারণত ধান  ও গমের পরই আলুর অবস্থান। এটি ভিটামিন ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ। বর্তমানে মিষ্টিআলু বাংলাদেশের খাদ্য ফসলের মধ্যে চতুর্থ স্থান দখল করে আছে। মিষ্টিআলুতে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, খনিজ ও ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন-এ রয়েছে । এক পরীক্ষায় দেখা গেছে রঙ্গিন শ্বাস যুক্ত ১২৫ গ্রাম মিষ্টিআলু প্রতিদিন খেলে এক জন পূর্ণবয়স্ক লোকের ভিটামিন-এর চাহিদা পূরণ হয়। মিষ্টিআলুতে
Glycemic index অনেক কম থাকার কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা ও সহজে খেতে পারেন। মিষ্টিআলুর ভিটামিন ই৬ রক্তনালীকে স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে। মেটেআলু বা গাছআলু ক্যালসিয়াম  ও ফসফরাসের খুবই ভালো উৎস। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম রয়েছে।


সকল ধরনের কচু ভিটামিন ও লৌহ সমৃদ্ধ । কচুর শাকে রয়েছে ভিটামিন-এ, বি, সি ক্যালসিয়াম ও লৌহ। ভিটামিন-এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং ভিটামিন-সি শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। কচুতে আছে আয়রন যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়া কচুর শাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ থাকে যা হজমে সহায়তা করে। কচুর ডাঁটায় প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে, তাই গরমের সময় কচুর ডাঁটা রান্না করে খেলে শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ হয়। কচুতে আছে প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন যা মানব শরীরের জন্য অনেক দরকারী উপাদান। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে । জ¦রের সময় রোগীকে দুধকচু রান্না করে খাওয়ালে জ¦র দ্রুত ভালো হয়। কচুর লতিতে রয়েছে প্রচুর পরিমান আয়রন ও ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করে ও চুলের ভঙ্গুরতা রোধ করে। কচুরলতিতে বিদ্যমান ভিটামিন-‘বি’ হাত, পা, মাথার উপরিভাগে গরম হয়ে যাওয়া, হাত-পায়ে ঝিঝি ধরা বা অবসভাব এ সমস্যাগুলো দূর করে। কচুর লতি উচ্চ আয়োডিন সমৃদ্ধ যা দাঁত, হাড় ও চুল মজবুত করে। এ ছাড়া এটি অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিরসনে খুব ভালো কাজ করে। এতে ডায়াটারি ফাইবার বা আঁশের পরিমাণ খুব বেশি যা খাবার হজমে এবং দীর্ঘ বছরের কোষ্ট কাঠিন্য দূরীকরণে সাহায্য করে।


ওল কচু ঔষধিগুণ সম্পন্ন। ওলকচু খেলে রক্তের কোলেস্টেরল কমে তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ওল কচুর রস বেশ উপকারী। এছাড়া ওলকচু অশ্র্বজনিত কোষ্টকাঠিন্য; অশের্^র রক্তস্রাব; অর্শজনিত অগ্নিমান্দ্য; শোথ; গেঁটেবাত; বাতেরব্যথা; দাদ ও ছুলি; মুখেরক্ষত; সর্দি ও কফপ্রবণতা; মৌমাছি বোলতা, ভিমরুল ও বিছার কামড়ের ক্ষেত্রে ওলের গুণ অসাধারণ।    


মুখীকচু এনার্জি ধরে রাখে ও ক্লান্তি হ্রাস করে; ওজন কমায়; হজমে সহায়তা করে; পাকস্থলী পরিষ্কার করে; হৃদ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী; হাইপারটেনশন কমায়; অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, বয়স বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে। এ ছাড়াও এতে ১৭ প্রকারের অ্যামাইনোএসিড এবং ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬  অয়েল থাকে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ও কার্ডিওভাস্কুলার রোগ এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে কন্দাল ফসলের চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক “কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প” হাতে নেয়া হয়, যা দেশের বিভিন্ন উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলায় কন্দাল ফসল (ওলকচু, মুখীকচু, লতিকচু ও  গাছআলু) ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় এবং এতে পরীক্ষিতভাবে দেখা গেছে যে দানাদার ফসলের চেয়ে কন্দাল ফসলে লাভের হার বেশি। কম বিনিয়োগ, অধিক ফলন ও অধিক আয় এ ফসলের অন্যতম বেশিষ্ট্য যা প্রান্তিক চাষিদের মাধ্যমে সহজেই উৎপাদন করা যায়।


যেমন মনিরামপুর উপজেলার মোঃ ফিরোজ আহমেদ (চালুয়াহাটি), মোঃ আব্দুল হালিম (মশি^মনগর), আকতার হোসেন  (খেদাপাড়া), মোঃ মোজাহার আলী (শ্যামকুড়) এবং ইব্রাহীম হোসেন  (রোহিতা) প্রত্যেকে ২০ শতক জমিতে মাদ্রাজি ওলকচু চাষাবাদ করেন। ৫ মাসের এই ফসলে তাদের উৎপাদন গড় ৫০-৬০ মন ( ২৫-৩০ মেট্রিকটন/হেক্টর), এতে খরচ হয়েছে ৩০০০০-৩২০০০ টাকা এবং লাভ হয়েছে ৩০০০০-৩৫০০০ টাকা।


একইভাবে কৃষক শেখ আব্দুল্লাহ  (ভোজগাতী), শেখ হাসান আলী  (রোহিতা) ২০ শতক জমিতে বারি মুখীকচু-২ জাতের মুখীকচু চাষাবাদ করে গড়ে ৫০-৫৫ মণ (২৫-৩০ মেট্রিকটন/হেক্টর) উৎপাদন করেন। যেখানে খরচ হয় ২২০০০-২৩০০০ টাকা এবং লাভ হয় ২৫০০০-৩০০০০ টাকা।
অপরদিকে কৃষক মো: কুতুবউদ্দীন  (পৌরসভা), মোঃ আমিরুল ইসলাম (পৌরসভা), মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (মশি^মনগর) ২০ শতক জমিতে লতিরাজ জাতের লতিকচু চাষ করেন। ১৮০ দিনের এই ফসলে তাদের গড়ে খরচ পড়ে ১৩০০০-১৫০০০ টাকা, উৎপাদন হয় ৫০-৫৫ মণ ( ২৫-৩০ মেট্রিক টন/হেক্টর) এবং লাভ হয় ৪০০০০-৪৫০০০ টাকা।


কন্দাল জাতীয় ফসলের মধ্যে অন্যতম একটি ফসল হচ্ছে মেটে আলু বা গাছ আলু। কৃষক মোঃ শরিফুল ইসলাম (চালুয়াহাটি),  মোঃ হাফিজুর রহমান (মশি^মনগর), সিরাজুল ইসলাম (মশি^মনগর), আব্দুল মান্নান (মশি^মনগর) এবং রিজাউল ইসলাম (চালুয়াহাটি) প্রত্যেকে ২০ শতক জমিতে স্থানীয় জাতের (সাদাচুপড়ি, লালচুপড়ি) মেটে আলু চাষা বাদ করেন। ফসলটির জীবনকাল ৮ মাস। খরচ হয়েছে  ১৬০০০-১৮০০০ টাকা এবং গড় উৎপাদন হবে আনুমানিক ৫০-৫৫ মণ (২৫-৩০ মেট্রিক টন/হেক্টর) এবং লাভ ৬০০০০-৭০০০০ টাকা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।


মেটে আলুর চাষাবাদে আর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এই ফসলটি চাষ করতে অনেক সময় মাচার প্রয়োজন হয় না। কৃষক বেগুন ক্ষেতের মাঝেই এটি চাষাবাদ করতে পারেন অর্থাৎ বেগুনের শেষ উত্তোলনের মধ্যেই মেটেআলুর কন্দ বপন করা হয় এবং বেগুন সংগ্রহ করা শেষ হলে মাঠে যে বেগুন গাছ থাকে সেই গাছই মেটেআলুর মাচার কাজ করে। এটি কৃষকের মাঝে “low-cost: প্রযুক্তি” নামে পরিচিত যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ছাড়া এটি বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গাতেও অনায়াসে জন্মানো যায়।


উপরোক্ত  কন্দালফসলগুলোর দিকে লক্ষ্যপাত করলে দেখা যাচ্ছে যে, ধানের চেয়ে কন্দাল ফসলের চাষ অনেক লাভজনক। এটিকে উচ্চমূল্যের ফসল হিসাবে এই এলাকার কৃষকগণ দেখছেন এবং তারা এই ফসলগুলোকে রপ্তানি করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কৃষির আধুনিকীকরণের কোন বিকল্প নেই এক্ষেত্রে কৃষির বহুমুখীকরণ হতে পারে সমস্যা নিরসনের অন্যতম একটি উপায়। কৃষির এই বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে কন্দাল ফসলের বিস্তার যোগ করবে নতুন মাত্রা যা খাদ্য নিরাপত্তায় যেমন যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে আবার প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।

লেখক : কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, মণিরামপুর, যশোর। মোবাইল : ০১৭৫৫৭১৬৫৩৯, ই-মেইল : kbdmahuda@gmail.com