Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধু : জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে

বঙ্গবন্ধু : জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১, ড. সুস্মিতা দাস২
‘জীবন মরণের সীমানা
ছাড়ায়ে রয়েছ দাঁড়ায়ে’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির যথার্থই খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করলে। যার ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সোনার বাংলা আজকে বিশ্বের মানচিত্রে গর্ব ও সম্মানের সাথে জায়গা করে নিয়েছে। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৫ সালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও তিনি বাঙালির অন্তরের গভীর সত্তায় মিশে আছেন। তাই তো আগস্ট আসলে বাঙালি প্রতি বছর শ্রদ্ধার সাথে বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণকে বেদনাবিধুর চিত্তে স্মরণ করে। সারা জাতি শোকাকুল হয়ে উঠে। নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি জাতি এই কান্ডারি ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ কিংবদন্তি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যিনি দীর্ঘ সংগ্রাম মুখর জীবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদের প্রতীক।  
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা ছিল আকাশচুম্বী। শৈশব থেকেই সেসব লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তিনি যে ত্যাগী নেতা হবেন তা ছাত্রজীবনেই সবাই উপলব্ধি করেছিল। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৬৬ ছয় দফা, ১৯৬৮ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ নির্বাচন-দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার নিরস্ত্র জনগণ ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। তিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মহান শহীদ ও ২ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন। এক কোটি বাঙালি-শরণার্থীর পুনর্বাসন, তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো, দশ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, একশোরও বেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘ, ন্যাম, ওআইসি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভসহ বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু আজন্ম ভালোবেসেছেন কৃষি ও কৃষককে। তাইতো তিনি কৃষিবিপ্লবের রূপকার হিসেবে তাঁর জাতীয় কর্মকাণ্ডে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাংলাদেশে ক্ষুধামুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কৃষিতে আজকের সাফল্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন মাত্র। বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও দর্শন ছিল এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের ও জীবনের মান উন্নয়ন করা। এ জন্য স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সবার আগে তিনি দেশ গড়ার প্রারম্ভেই কৃষির উন্নয়ন কাজে হাত দেন। এ দেশের কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরবর্তী নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। আর খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। সেই চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধু কৃষিবিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তিচর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর সময় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ১৯৭৩- জুন ১৯৭৮ সন) প্রণয়ন করা হয়। এতে কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করায় এদেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থাসহ কৃষি গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু সরকার শতকরা ৩১ ভাগ অর্থ কৃষিখাতে ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের হার পরবর্তী পাঁচশালা পরিকল্পনাগুলোতে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসে। এই সংকোচন নীতির ফলে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্জিত ৩ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যথাক্রমে ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুর বাস্তব ও গতিশীল পদক্ষেপের ফলে মাত্র দু’বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে কৃষিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ৭ শতাংশ যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরবর্তী বছরগুলোতে দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গবেষণার জন্য কৃষিবিদ তথা কৃষি গবেষকদের বঙ্গবন্ধু সরকারই প্রথম সংগঠিত করে কৃষি গবেষণার কাজে হাত দেন। ফলে এদের মধ্য থেকে আজ অনেক স্বনামধন্য কৃষি বিজ্ঞানী সৃষ্টি হয়েছে যারা কৃষির বহুমুখী উন্নয়নে সার্বিক অবদান রাখছে। বলা যায় স্বাধীনতা উত্তরকালে কৃষি সেক্টরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষি মন্ত্রণালয় অধীন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যা মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের এক অধ্যাদেশ বলে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক উদ্যোগের ফলে বিএআরসি প্রতিষ্ঠিত হয় যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটি মাইলফলক বলা যেতে পারে। দেশের সামগ্রিক কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে অধিকতর গতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল আইন ১৯৯৬ সালে এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে সংশোধনের মাধ্যমে দেশে কৃষি গবেষণা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হয়। বিএআরসি কৃষি মন্ত্রণালয় আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ কৃষি (ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সংস্থার সাথে কাজ করে। কৃষি গবেষণালব্ধ ফলাফল বা প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কর্মকাণ্ড বিএআরসিতে চলমান রয়েছে এবং কীটনাশক, সার, বীজ ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মান নির্ধারণসহ নীতি প্রণয়ন সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিএআরসি গত ১০ বছরে নোটিফাইড ৭টি ফসলের (ধান, গম, আলু, ইক্ষু, পাট, কেনাফ ও মেস্তা) ফলন ও মান নিশ্চিতপূর্বক বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৭০টিরও বেশি জাত ছাড় করেছে। দক্ষ কৃষি বিজ্ঞানী তৈরির লক্ষ্যে ফেলোশিপের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫১,৮৮৬ জন বিজ্ঞানী/কর্মকর্তাকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। বিএআরসি ১৯৭৯ সাল থেকে সার সুপারিশমালা  ‘হাতবই’ প্রণয়ন করে আসছে যা সার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ ২০২১, ২০৩১ ও ২০৪১ প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন নিয়ে ‘১০০ কৃষি প্রযুক্তি এটলাস’ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা তথা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
কৃষি গবেষণা ও প্রশিক্ষণে গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)-কে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১ এ ভূষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্র্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে বিএআরসির এই প্রাপ্তি কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এসেছে। তিনি তাঁর সততা, জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিকে বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কৃষির এই দুর্বার অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ কৃষির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে সত্যিকারের একটি স্বনির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তাইতো তাঁর মহাপ্রস্থানের দিনে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলায়ে বলতে চাই-
‘তোমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো,
ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরোথরো।
দুর্গম পথ সগৌরবে তোমার চরণচিহ্ন রবে সগৌরবে।’

১নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; ২প্রধান ডকুমন্টেশন কর্মকর্তা, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই-মেইল :susmitabarc@gmail.com