Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশে প্ল্যান্ট টিসু কালচার এর সম্ভাবনা

বাংলাদেশে প্ল্যান্ট টিসু কালচার এর সম্ভাবনা
ড. মো. সাইফুল ইসলাম১ ড. শামীম আহমেদ২
উদ্ভিদের যেকোনো ক্ষুদ্রতম দৈহিক অংশ (somatic part) বা পৃথকীকৃত (isolated) কোনো কোষ (cell) টেস্টটিউবে বা যেকোনো পাত্রে কৃত্রিম মাধ্যমে (MSmedia) লালন (culture) করে মাতৃ উদ্ভিদের মতো অবিকল নতুন চারা উৎপন্ন করার এ কৌশলের নাম দেয়া হয় ক্ষুদ্র বংশবিস্তার (micro-propagation)। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এতে কিছু নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত করে পরে এর নাম দেওয়া টিসু কালচার।
জার্মান উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ববিদ হ্যাবারল্যান্ড কর্তৃক ১৯৯২ সনে প্রথম টিসু কালচারের জৈবিক মূলনীতিসমূহ (biological principles) বর্ণিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সনে তিনজন বিজ্ঞানী নোবকোর্ট, গেদার হাট এবং হোয়াট কৃত্রিম জীবাণুমুক্ত মাধ্যমে ক্যালাস কলাকে (callus tissue) স্বতন্ত্রভাবে লালন (culture) করতে সমর্থ হন।
কৃত্রিম বংশ বিস্তার (artificial propagation) বা টিসু কালচার প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য সুবিধাজনক দিকটি হল যেখানে একবীজপত্রী উদ্ভিদ (monocot) সাধারণত বীজ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বংশ বৃদ্ধি ঘটানো যায় না সেখানে এ পদ্ধতিতে খুব সহজেই এসব উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল খুব কম সময়ে এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণে চারা উৎপাদন করা যায়। স্ট্রবেরির মতো একটি ফল গাছের একটি একক কোষ (single cell) বা ক্ষুদ্রতম কোনো অংশ থেকে বছরে প্রায় দুই মিলিয়ন চারা পাওয়া সম্ভব।
তাছাড়া টিসু কালচার প্রক্রিয়া উৎপন্ন চারার আকারে খুব ছোটো হয়। স্বাভাবিক উৎপন্ন কলার চারার কথা বলা যায়। যেখানের এক হাজার কলার চারা পরিবহন করতে একটি বিশালাকার ট্রাকের প্রয়োজন, সেখানে টিসু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন এক হাজার চারাকে বহন করতে ছোট আকারে রিকশা ভ্যানই যথেষ্ট। যার ফলে এ ধরনের চারা বহনে পরিবহন খাতে ব্যয় যথেষ্ট কম হয়। টিসু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন চারা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় না। অপর পক্ষে এ প্রক্রিয়ার দ্বারা রোগ জীবাণু মুক্ত ও বীজ উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মাতৃ উদ্ভিদের শীর্ষস্থ (epical) ও পার্শ্বস্থ (lateral) মেরিস্টেমেটিক টিসু (Meristematic Tissue) হতে বীজ উৎপন্ন হয় বলে এতে ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগ জীবাণুর আক্রমণ কম হয়। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও এসব বীজ হতে চারা ও সুস্থ সবল উদ্ভিদ জন্মানো যায়। আমেরিকা মহাদেশ আজ ‘বিশ্বের রুটির ঝুড়ি  বলে খ্যাত যে কারণে তার প্রধান কারণ তাদের টিসু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন বীজের ব্যবহার। কেননা এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন গমের বীজ হতে প্রচ- নিম্ন তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে চারা ও পূর্ণাঙ্গ গাছ হয়।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ধরনের বীজ উৎপন্ন হলে তার মূল্যও কম হয়। তবে সেক্ষত্রে টিসু কালচার ল্যাব তৈরির খরচের পরিমাণ বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে আনতে হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের একটি টিসু কালচার ল্যাব তৈরি করতে ১ কোটি হতে ১.৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হবে। এসব ল্যাবে মূল কাজ পরিচালনা করার জন্য দক্ষ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন যারা একটি সুস্থ সবল গাছের একটি অংশের মেরিস্টেমেটিক টিসু হতে কয়েক লক্ষ হতে কয়েক বিলিয়ন চারা উৎপন্ন করে। এ কাজ পরিচালনার পূর্বে প্রজননবিদদের প্রথমে সমস্ত দেহে জীবাণুনাশক মেখে নিতে হয়। প্রক্রিয়াটির চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ হতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়।
বর্তমানে চীন, জাপান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে বাণিজ্যিকভাবে টিসু কালচার ল্যাব হতে বীজ/চারা উৎপন্ন করা হচ্ছে। জাপান ও থাইল্যান্ড এশিয়ার এ দুটি দেশ এ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে প্রাপ্ত অর্কিড ও ফুল বিক্রি করে বিশ্ব বাজার হতে মোটা অংকের অর্থ নিজেদের ঘরে তুলছে। এক জরিপে দেখা গেছে যে, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড টিসু কালচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে যে আলুর বীজ উৎপন্ন করে তার প্রতিটির বীজের মূল্য পড়ে দশ পয়সা। এ স্বল্প মূল্যের বীজ হতে পরবর্তীতে তার সুস্থ সবল আলু গাছ হতে ফসলের সর্বোচ্চ ফলন পেয়ে থাকে। ১৯৫৪ সালে আলুর লেইট ব্লাইট রোগের কারণে আয়ারল্যান্ডে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে ৭-৮ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল এবং সেখান থেকে তার শিক্ষা নিয়েছিল যে রোগ জীবাণু মুক্ত বীজ হচ্ছে সন্তোষজনক ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত। আর তখন থেকে তার টিসু কালচার প্রক্রিয়ার উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল এবং সফলও হয়েছে।
১৯৫৪ সালের দুর্ভিক্ষে শুধু আয়ারল্যান্ড-ই নয় গোটা উত্তর আমেরিকা সুস্থ বীজের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তখন থেকে টিসু কালচারের প্রতি গুরুত্ব সহকারে নজর দিয়েছেন। যার দরুন আজ তারা কৃষি প্রধান দেশ না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
আমাদের দেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে টিসু কালচার পদ্ধতিতে চারা উৎপাদিত হলেও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে না। আশার কথা মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক টিসু কালচার ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছে এবং বিগত দুই বছরে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এখান থেকে প্রায় চার লক্ষ কলা চারা ও কয়েক হাজার জারবেরা ও অর্কিড চারা তৈরি করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে উক্ত ল্যাবরেটরিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর ব্যবস্থাপনায় কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান চলছে এবং এরকম আরও ছয়টি টিসু কালচার ল্যাবরেটরি তৈরির প্রক্রিয়া বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

লেখক : ১অতিরিক্ত পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, ২উপপরিচালক, গণযোগাযোগ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি মন্ত্রণালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫। ই-মেইল : ashamim.uni@gmail.com