Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ফল গাছের পরাগায়ন ও করণীয়

ফল গাছের পরাগায়ন ও করণীয়
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন
ফল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। আমাদের পুষ্টির অত্যাবশকীয় উপাদান বিশেষ করে ভিটামিন, মিনারেলস এবং এন্টি-অক্সিডেন্টের প্রধান উৎস হচ্ছে ফল। আমাদের দৈনিক চাহিদার মাত্র অর্ধেক পরিমাণ ফল গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু পুষ্টি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে মাথাপিছু কমপক্ষে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম ফল প্রয়োজন। বিগত দশকে ফলের উৎপাদন এবং ফলন দুই-ই বেড়েছে।  কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আম উৎপাদনের এরিয়া ১,১০,০০০ একর হতে ২,৩৫,০০০ একরে বৃদ্ধি পেয়েছে তদ্রƒপ কাঁঠাল, পেঁপে, লিচু, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি ফলের উৎপাদনের এলাকা বেড়েছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক।
বিভিন্ন ফলের ফলন বৃদ্ধিতে সময়মতো রোগ ও পোকামাকড় দমন একটি কার্যকর ব্যবস্থা, যা আমাদের ফলের ফলনই শুধু বৃদ্ধি করেনি বরং মিটিয়ে যাচ্ছে পুষ্টির চাহিদা। বিভিন্ন ফলের ফলন বৃদ্ধি এবং ফলের আকার আকৃতি সঠিক রাখার জন্য উত্তম পরাগায়ন প্রয়োজন। আর এই পরাগায়নের প্রায় ৭০ ভাগ কার্য সম্পাদন করে বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ। ফলের বাগান বাংলাদেশে যত বৃদ্ধি পাবে আমাদের জন্য তা ততই মঙ্গলজনক। ফলের পোকামাকড় দমনে আমরা প্রায়ই বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকি। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহার না করলে পরাগায়কের সংখ্যা হ্রাস পায়, যা ফলের ফলন বৃদ্ধিতে অন্তরায়। 
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমের ফলনে পরাগায়কের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমে সাধারণত : মাছি, হুলবিহীন মৌমাছি, ঐধষরপঃঁং মৌমাছি, খধংরড়মষড়ংংঁস মৌমাছি, ইউরোপীয় মৌমাছি, ইন্ডিয়ান মৌমাছি ইত্যাদি পতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে আমের পরাগায়নে মাছির ভূমিকা বেশ। আমাদের দেশে আমের মুকুল অবস্থায় অনেক এলাকাতে বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় ফলে আমের পরাগায়কের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু তারপরও মৌচাষিরা তাদের পালনকৃত মৌমাছি বিভিন্ন আমের বাগানে নিয়ে যান না শুধুমাত্র বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি বাগানে আমের পরাগায়নের জন্য মৌমাছি ব্যবহার করা উচিত। আমের ফুল হতে সংগ্রহকৃত মধু অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। আম স্বপরাগী হলেও পরাগায়ক ব্যবহার করে আমের ফলন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।   
লিচুতে স্বপরাগায়ন হয়ে থাকে তবে পতঙ্গের মাধ্যমে পরাগায়ন সম্পন্ন হলে লিচুর ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। লিচুর ফুলে মাছি, বিটল, প্রজাপতি, পিঁপড়া ইত্যাদি বিচরণ করলেও মৌমাছি দ্বারা পরাগায়িত হলে লিচুর ফলন ২-৩ গুণ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে লিচুর বাগানে মৌবাক্স স্থাপন করে প্রায় ২,৫০০ টন মধু সংগ্রহ করা হয়। এজন্য লিচুর বাগান বৃদ্ধি করা উচিত যাতে মৌমাছির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় এবং মধুও অধিক পরিমাণে সংগ্রহ করা যায়।
লেবুজাতীয় ফসলে পরাগায়ন অপরিহার্য। তবে এতে মৌমাছির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবুও দেখা যায় কিছু কিছু লেবুজাতীয় ফুল সারা বছর ফোঁটে এবং বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ লেবুর ফুলে বিচরণ করে। লেবুর ফলন বৃদ্ধিতেও পরাগায়নের ভূমিকা রয়েছে, যা স্থান, আবহাওয়ার অবস্থা এবং ফসলের জাতের উপর নির্ভর করে।
পেয়ারার পরাগায়নের শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ মৌমাছির কারণে হয়ে থাকে। পেয়ারার ফলের আকার, গুণগতমান এবং ফলন বৃদ্ধিতেও পরাগায়কের ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৭,০০০ একর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়ে থাকে, যা ২০১৭-২০১৮ সালে ছিল মাত্র ১১,০০০ একর। 
ফলের মধ্যে তরমুজ খুবই সুস্বাদু বিশেষ করে গরমের সময় তা খুবই স্বস্তিদায়ক খাদ্য। তরমুজ চাষের আওতা দিন দিন বেড়েই চলছে। তরমুজের পরাগায়নে বিভিন্ন পরাগায়ক কাজ করে। তবে এক্ষেত্রে মৌমাছি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ফুলের মধুও সুস্বাদু। তবে সেক্ষেত্রে অধিক মৌকলনী কোন এলাকায় থাকলে সে সকল চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা দুরূহ।
বরই সুস্বাদু ফল। বরই গাছে প্রচুর পরিমাণ কীটপতঙ্গ দেখা যায়। আমাদের দেশে জুন-আগস্ট মাস পর্যন্ত উপকারী পতঙ্গের বিশেষ করে যে সকল পতঙ্গ গবষরঢ়যধমড়ঁং তাদের খাদ্যের স্বল্পতা থাকে। সেপ্টেম্বরের বরইর ফুল সকল পরাগায়কের প্রিয়। পরাগায়কের ব্যবহারে বড়ইর ফলন দ্বিগুণ পর্যন্ত করা সম্ভব। তবে বরইর বাগানে বালাইনাশক ব্যবহারে খুবই সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে শেষ বিকেলে বালাইনাশক প্রয়োগ করলে উপকারী পতঙ্গ কম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বরই বাগানের পরিমাণ বর্তমানে ৩৯,০০০ একর যা ২০১৭-২০১৮ তে মাত্র ৪,০০০ একর ছিল। আমাদের ফলের সমৃদ্ধি যে দিন দিন বাড়ছে এটিই তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্য এখানে কিছু সংখ্যক ফল গাছে পরাগায়কের ভূমিকা দেয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে এই সৃষ্টি জগতে প্রতিটি প্রাণীই কারো না কারোর জন্য। পতঙ্গকে অবহেলা করা উচিত নয়। এই ক্ষুদ্র পরাগায়ক পতঙ্গই আমাদের বিনামূল্যে লাখ কোটি টাকার শ্রম দিয়ে সহায়তা করছে।
ইদানীং আমাদের দেশে বিদেশি ফলের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ড্রাগন ফল, রাম্বুটান, অ্যাভোকেডো, বিদেশী আম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে ড্রাগন ফুলের পরাগায়ন একটি বড় সমস্যা। এক জাতীয় হক মথ দ্বারা ড্রাগন ফুলে পরাগায়ন হয় এবং খুব ভোরে কিছু প্রজাতির মৌমাছি ড্রাগন ফলের পরাগায়ন ঘটায়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ চাষিই হাতের মাধ্যমে ড্রাগন ফলের পরাগায়ন ঘটান। ড্রাগন ফলের বাগানে পরাগায়কদের আকৃষ্ট করতে প্রচুর ফুল  সমৃদ্ধ জাতীয় বৃক্ষ বা গুল্মজাতীয় গাছ লাগানো উচিত। এ ছাড়া বাগানে মৌবাক্স স্থাপন করে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। ফলের বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি বিশেষ করে প্রতি জেলায় বড় আকারের একটি করে মডেল বাগান স্থাপন করা উচিত। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টারগুলো এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে তবুও এই সেন্টারগুলো পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলায় বৃদ্ধি করা উচিত। একক গাছের ফলের বাগান না করে যথাসম্ভব বিভিন্ন ফল গাছের সমন্বয়ে বাগান করা উচিত। ফলের গাছ নির্বাচনের সময় বছরের প্রতি মাসে যাতে বাগানে ফুল থাকে সেটা বিবেচনা করা উচিত। এভাবে সারা বছর ফুলের উপস্থিতিসম্পন্ন বাগান পরাগায়কদের জন্য একেকটা কনজারভেশন সেন্টার হিসেবে কাজ করবে।
আমাদের দেশি ফলসমূহের প্রাধান্য অবশ্যই দিতে হবে। দেশি ফলসমূহ বিদেশী ফলের তুলনায় পুষ্টিকর এবং আমাদের ইকোসিস্টেমে আমাদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত। একেকটি ফলের বাগান তৈরি যেমনি আমাদের পুষ্টিতে ভূমিকা রাখবে তেমনি এই জাতীয় ফলগাছ রোপণের মাধ্যমে আমাদের বৃক্ষরাজির সংখ্যা বাড়বে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে বিশেষ করে আমাদের যে সকল পতঙ্গ পরাগায়ক হিসেবে কাজ করে তাদের জন্য হবে অভয়ারণ্য। তাই এই আসন্ন ফল দিবসে আমাদের চেষ্টা থাকবে যাতে প্রত্যেকে এমন একটি ফল গাছ লাগাই যেটি প্রচুর পরিমাণে ফুল দেয়। আপনিই নির্বাচন করুন আপনার পছন্দের দেশী ফল।

লেখক : প্রফেসর, কীটতত্ত্ব বিভাগ, শেরে-ই-বাংলা কৃষি বিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৭৪৩৫৫৭৮৭, ই-মেইল : ংধশযধধিঃ থংধঁ@ুযধড়ড়.পড়স