বাংলাদেশে কৃষি খাতের সম্ভাবনা
ড. রফিকুল আলম খান
কৃষির নিরন্তর সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যার ফলে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন প্রয়োজন একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা এবং নতুন নতুন এলাকা চাষের আওতায় আনা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান দুই শর্ত। নতুন নতুন স্বল্পমেয়াদি জাত চাষের মাধ্যমে এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চল বিশেষে প্রায় চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে ফলে দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ২০৫%। সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে কৃষি খাতের সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করা যাবে।
কৃষিখাতে সময়োপযোগী পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে: ১. এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চলভেদে চার ফসলি জমিতে পরিণত করা এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা; ২. পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষের উপযোগী এবং ঘাত সহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণ; ৩. মানসম্পন্ন উচ্চফলনশীল আধুনিক জাতের বীজ ব্যবহার করে ফসলের ফলন ১৫-২০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব; ৪. টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্প জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব; ৫. বীজ বপনের সময় আউশে এবং খরার সময় আমনে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করলে নতুন নতুন এলাকা আউশ এবং আমনের আওতায় আনা সম্ভব; ৬. যান্ত্রিক চাষাবাদের মাধ্যমে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের সাথে সাথে একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব; ৭. জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট, খামারজাত সার, সবুজসার ও অন্যান্য জৈবসারের ব্যবহার জনপ্রিয়করণ; ৮. ক্ষতিকর রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য পার্চিং, আলোক ফাঁদ, ফেরোমন ট্র্যাপ, ফল ব্যাগিং কৌশল, ধানক্ষেতে হাঁসের চাষ নিশ্চিতকরণ; ৯. সাশ্রয়ী সেচের জন্য সোলার পাম্প ব্যবহার এবং এডব্লিউডি, ফিতাপাইপ, পাকা সেচনালা, বারিড পাইপ, মিনিপুকুর ও পাতকুয়া খনন এবং সর্বোপরি ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, ১০. বসতবাড়ি; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, রাস্তার ধার, অফিসসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর আশেপাশের পরিত্যক্ত প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ; ১১. হাওর, বিল ও জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান কৃষি প্রযুক্তির বিস্তার ঘটিয়ে সবজি ও মসলা ফসল উৎপাদন করা; ১২. দেশের তিনটি পাহাড়ি ঝিলসহ অন্যান্য জেলার অসমতল ও পাহাড়ি জমিকে উন্নত কৃষি ব্যবস্থা আওতায় এনে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা; ১৩. ছাদ বাগান স্থাপনসহ নগর কৃষির উন্নয়ন; ১৪. নদীভাঙন, চরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা দরিদ্র মানুষের জন্য চাহিদাভিত্তিক জন্য একাধিক প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। চরাঞ্চলে ডাল, তেল, সয়াবিন, মিষ্টিআলু, ফেলন, সূর্যমুখী, ধনিয়া চীনাবাদাম ভুট্টা কালিজিরা, তরমুজসহ কুমড়াজাতীয় ফসল ভাল জন্মে। চরের অতি দরিদ্র মানুষের মধ্যে কৃষি খাসজমি বিতরণ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানে রয়েছে দক্ষ জনবল। জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে যাচ্ছে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একাডেমিকে আরও এগিয়ে নিতে জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি (নাটা) আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কাজ চলমান। এ লক্ষ্য পূরণ হলে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’, হবে প্রশিক্ষণ আয়োজনের একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান।
কৃষকদের উৎপাদন খরচ নিম্নপর্যায়ে রাখতে সরকার সার, সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ইক্ষুচাষে উন্নয়ন সহায়তা প্রদানের নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে ও করোনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি খাতে সরকারি প্রণোদনা ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকি দিয়ে সহজলভ্য করা প্রয়োজন।
এ ছাড়াও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শহরমুখী দ্রুত ধাবমান মানুষগুলোর স্ব-স্ব অবস্থান থেকে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা; ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষির’ কার্যক্রম জোরদারকরণ; পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদনক্ষম উত্তম কৃষি কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ; পর্যাপ্ত হিমাগার স্থাপন করে কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল, সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের ব্যবস্থাকরণ; কৃষি সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়সমূহ যেমন, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়সাধন জোরদার করা প্রয়োজন; প্রশাসনিকভাবে মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট কমিয়ে সমবায়ভিত্তিতে কৃষকের জমি থেকে কৃষিপণ্য ক্রয়, গ্রোথসেন্টার বা কালেকশন পয়েন্টে নিয়ে আসা পরে সেখান থেকে নগর বিক্রয়কেন্দ্র বা কৃষকের বাজারে অবাধে বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করা; কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয় কৃষি; বাণিজ্যিকভাবে বঃযহরপ সধৎশবঃ এ আমরা এযাবৎ ফল ও সবজি রপ্তানি করে আসছি কিন্তু ংঁঢ়বৎ সধৎশবঃ এ ঢুকতে পারছিলাম না। আশার কথা সম্প্রতি ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ংঁঢ়বৎ সধৎশবঃ এ সবজি ছাড়াও আম, চিংড়ি রপ্তানি শুরু হয়েছে; দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রথাগত চাষাবাদের পরিবর্তে ‘স্মার্ট ফার্মিং’ সংক্রান্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বাংলাদেশে কাজে লাগানো যেতে পারে; ফুল চাষ বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। এর বাণিজ্যিক বিকাশে বিদ্যমান ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে স্মার্ট প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ২০১৮, এসডিজি ২০৩০, ভিশন২০৪১ ও ডেল্টাপ্লান ২১০০ বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সব দপ্তর সংস্থা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সময়োচিত নীতি, কৌশল এবং কার্যকর কর্মকা-ের মাধ্যমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন সম্ভপর হবে।
লেখক : উপপরিচালক (এলআর), সংযুক্ত: পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আইসিটি উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৫৭৬৫৩২৭, ইমেইল : ফৎ.ৎধভরয়ঁবফধব@মসধরষ.পড়স