Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

নিরাপদ শাকসবজি সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণমুক্তকরণ

নিরাপদ শাকসবজি সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণমুক্তকরণ
কৃষিবিদ তাপস কুমার ঘোষ১ মোছা: সাবিহা সুলতানা২
শাকসবজি মানবদেহের প্রয়োজনীয় জৈবরাসায়নিক পুষ্টি উপাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনসহ মানবদেহের জন্য অপরিহার্য খনিজ পদার্থ। উন্নয়নশীল দেশের জন্য শাকসবজি শক্তির মৌলিক উৎস হিসেবে কাজ করে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন অত্যন্ত উপকারী, তেমনি খাদ্য ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্যও অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। শাকসবজি সুষ্ঠুভাবে  সংগ্রহের  মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগত মানও ভালো থাকে। এতে করে কৃষকদের শাকসবজির সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় না। তাছাড়া জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে চাষকৃত শাকসবজিতে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে থাকে। কৃষকরা মানসম্মত শাকসবজির ফলন বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের উপর ভালো লাভ পেতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে  কৃষকগণ ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন এবং সর্বশেষ স্প্রে ও ফসল তোলার মধ্যে সময়ের উপযুক্ত ব্যবধান মেনে চলেন না। যার ফলে বাজারের শাকসবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ মানবদেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকীস্বরূপ। নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে মানবদেহের বিভিন্ন অংশে কীটনাশকের দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া হয়, যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় বিভিন্ন জীবনঘাতী ব্যাধি যেমন : ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনির বিভিন্ন রোগ ইত্যাদি। ভোক্তা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে  বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে ফসল সংগ্রহ করে বাজারজাত করা প্রয়োজন। ভোক্তা নিরাপদ সবজি গ্রহণের নিমিত্ত বাজার থেকে কেনা শাকসবজি থেকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ জরুরি।
শাকসবজির ধরনভেদে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহের নিয়ম
টমেটো, বেগুন, শসা, কুমড়া এসব সবজিকে বোঁটা থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে গাছ থেকে আলাদা করে নিতে হবে। চারা গাছ পাতলা করার সময় ছোট গাছ হিসেবে লালশাক, পালংশাক এসবের শাককে সংগ্রহ করে নিতে হবে। পালংশাক, লালশাক, মুলাশাক সংগ্রহের সময় সম্পূর্ণ গাছটি শিকড়সহ উপড়ে ফেলে সংগ্রহ করতে হয়। শাক হিসাবে ব্যবহারের জন্য পুঁইশাক ও লাউয়ের ডগা প্রুনিং বা গাছের অংশ কেটে সংগ্রহ করে নিতে হবে। আবার বিভিন্ন সবজি সংগ্রহের উপযোগী সময় ও উপযুক্ত অবস্থাভেদে সংগ্রহ করতে হবে।
বেগুন : ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় তবে পরিপূর্ণ আকার এবং রঙ প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে।
চারা লাগানোর ৫০-৬০ দিন পরই ফসল সংগ্রহের সময় হয়। ফুল ফোটার ৭-১০ দিন পরই বেগুন সংগ্রহ করা যায়।
লাউ ফলের  ত্বকের লোমশ ভাগ পরিপক্বতার সাথে সাথে কমতে থাকে, ফলের লোমশ ঘনত্ব দেখেও এর সংগ্রহ উপযোগিতা নির্ণয় করা যায় এবং সংগ্রহ করতে হয়; শিম ফুল ফোটার ২০-২৫ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। শুঁটি পরিপূর্ণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে এর বীজের অংশ কিছুটা স্ফীত হওয়ার পর পরই সংগ্রহ করতে হবে। অতিরিক্ত পরিপক্ব শুঁটিতে আঁশ জন্মালে কোমলতা ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়; বরবটি শুটি পরিপূর্ণ লম্বা ও মোটা হলে এবং বীজের অংশ সামান্য স্ফীত হতে শুরু করলে বরবটি তোলা যাবে; মুলা বীজ বপণের ২০-২৫ দিন পর থেকে সংগ্রহ করা যায় শাকের জন্য ঘন করে বপন করলে ফসল ২০ দিন পর এবং মুলার জন্য ৪০ দিন পর থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে; ধুন্দল গাছে ফল ধরার ৮ থেকে ১০ দিন পরেই সংগ্রহ উপযোগী হয়। ফল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত এতে পুষ্টিমান বজায় থাকে। বেশি পরিপক্ব হলে ফলের স্বাদ ও পুষ্টিমান দুটোই কমে যায়; ঢেঁড়স কোমল ও কচি অবস্থায় ঢেঁড়সের ফল তুলতে হবে। ফল বের হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর ঢেঁড়স খাওয়ার উপযোগী হয়; টমেটো জাত ও লাগানোর সময়ের উপর নির্ভর করে ২-৪ মাসের মধ্যেই ফসল তোলার সময় হয়। ফলের নিচের ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে দাগ থাকে ঐ স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হলেই বাজারজাতকরণের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে। এরূপ ফল সংগ্রহ করলে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
সবজি সংগ্রহে সতর্কতা : হাত দিয়ে মোচড়ায়ে সবজি ফসল সংগ্রহ করা যাবে না, এতে মাতৃগাছের ক্ষতি হয়। মোচড়ানোর ফলে গাছে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেখান দিয়ে রোগজীবাণুর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্ষতি এড়ানোর জন্য ধারালো ছুরি বা ক্লিপার দিয়ে সংগ্রহ করা উচিত। ফসল সংগ্রহ করে ফসল তোলার পাত্রে রাখতে হবে। আর যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সংগ্রহ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করে শাকসবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাপকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।
যেমন : ক) মাঠে থাকা অবস্থায় সংগ্রহের সময় সবজির গায়ে ধুলাবালু লাগতে পারে। এজন্য সংগ্রহের পর পরই পরিষ্কার পানিতে সবজি ধুয়ে নিতে হবে এতে সবজি ফসল টাটকা ও সুন্দর দেখায় এবং নেতিয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে। খ) এরপর আকর্ষণ ও মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজনে সটিং এবং গ্রেডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবজিভেদে আকার-আকৃতি বর্ণ, ব্যত্তি, পরিপক্বতা অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে গ্রেডিং করে নিতে হবে। গ) রসালো সবজি সংগ্রহ করার পরও স্বসন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এজন্য ঠা-া ঘরে বায়ুশূণ্য করে অল্প সময়ের জন্য হলেও মাঠের তাপ সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি থেকে বালাইনাশক অবশিষ্টাংশ অপসারণ তথা সংক্রমণমুক্তকরণ কয়েক পদ্ধতিতে রান্নাঘরে সহজলভ্য কিছু উপাদান দ্বারা সহজেই করা যেতে পারে। উপাদানগুলো হলো খাবার লবণ, গুঁড়া সাবান, হলুদ গুঁড়া ও ভিনেগার দ্বারা সহজেই করা যেতে পারে। বেগুন, শিম, টমেটো এবং কাঁচামরিচ এবং খোসা ছাড়ানোর মাধ্যমে শসা হতে অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের যথা- ডাইমেথয়েড, ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা যায় যা নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
খাবার লবণ দ্বারা
বাজার থেকে কিনে আনা সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে লবণ যোগ করে লবণ পানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত লবণ পানিতে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে ও পরিমিত তাপে রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮৬% পর্যন্ত অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ হয়।
হলুদ গুঁড়া দ্বারা
বাজার থেকে কিনে আনা সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে হলুদ গুঁড়া যোগ করে দ্রবণ তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত হলুদ দ্রবণে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। পানিতে ১৫ মিনিট রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৭১% পর্যন্ত অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ হয় ।
 খাবার লবণ+খোসা ছাড়ানো
বাজার থেকে কিনে আনা শসা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে লবণ যোগ করে লবণপানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত লবণপানিতে শসা ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। চাকু দিয়ে শসার খোসা ছাড়াতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে খোসা ছাড়ানো শসা ধুয়ে ফেলতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮৫% পর্যন্ত ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা সম্ভব।
ভিনেগার দ্বারা
বাজার থেকে কিনে আনা কাঁকরোল ও টমেটো পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলি হারে এসিটিক এসিড বা ভিনেগার যোগ করে ভিনেগার-পানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত ভিনেগার-পানিতে কাঁকরোল ও টমেটো ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে কাঁকরোল ও টমেটো ধুয়ে নিতে হবে। পানিতে ১৫ মিনিট রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮০% পর্যন্ত ডাইমেথয়েড, ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা সম্ভব।
শাকসবজির সুষ্ঠু সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণমুক্তকরণ ব্যবস্থা যদি নিয়মিতভাবে করা হয় তবে উৎপাদনকারীর অপচয় রোধ হবে এবং কৃষক অধিক মুনাফা লাভ করতে পারবেন। আর দেশের শাকসবজির উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা অর্জনের পথ হবে সুগম। উপরোক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন সবজি কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ সংক্রমণমুক্তকরণের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি সহজলভ্য করা সম্ভব।

লেখক : ১প্রকল্প পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ২প্রোগ্রাম কমিউনিকেটর, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা; মোবাইল : ০১৭১৯৭৫৩৪৩১, ই-মেইল :sabiha.saao@yahoo.com