Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা

প্রবীণদের  স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা
মোরসালীন জেবীন তুরিন
দিন দিন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সাথে সাথে আমরা অনেকটা আত্মকেন্দ্রিকও হয়ে পড়ছি, নগরজীবন-যাপন এর কারণে আমাদের সমাজব্যবস্থা আর ততটা সুসংগঠিত হচ্ছে না এবং সম্পদ অপ্রতুলতার কারণে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বা প্রবীণ সমাজ এক প্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রবীণ বা বয়স্কদের নিয়ে সচরাচর এখন কোন আলোচনা হয় না। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আজকের এই প্রবীণরাই আমাদের পথপ্রদর্শক, তারাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার উৎস। যেহেতু এক সময় আমাদের সবাইকে এই পরিণতিতে যেতে হবে তাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে মনোযোগী ও সচেতন হতে হবে এবং বয়স হওয়ার আগেই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কিছু ব্যাপার নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। যেমন- খাদ্যাভাস, জীবনযাত্রা সঠিকভাবে মেনে চলে বয়স্কদের সমস্যা কমানো যায়। যুবক বয়সে আমাদের কোন কোন খাদ্যাভাস আমাদের ক্ষতি করে বোঝা না গেলেও পরবর্তীতে তা ক্ষতি করতে পারে। আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে চাকুরি শেষ হয়ে গেলে শক্তি শেষ মনে করা হয় । কিন্তু সঠিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে চাকরির পরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা যায়। তাই আমাদের প্রবীণ  বা বয়স্কদের বৃদ্ধাবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে।
চিকিৎসা শাস্ত্রেGeriatric, Gerontology হল মেডিসিন এর এমন একটি শাখা যেখানে বয়স্কদের বৃদ্ধাবস্থা এবং তাদের রোগসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রবীণদের লক্ষণসমূহ  : সকল বয়স্কদের ক্ষেত্রে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তাই Geriatric Syndrome।UN, ২০০১ এর রিপোর্টে দেখানো হয়েছে বিশ্বজুড়ে ষাট (৬০) বছরের অধিক বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে যেমন ইতালি, জাপান, জার্মানিতে ২০০২ সালে যেখানে ষাট (৬০) বছরের অধিক বয়স্ক মানুষের শতকরা ২৪ ভাগ সেখানেই ২০২৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে শতকরা ৩৪ ভাগ। টঘ, ২০০১ এর আরেকটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে , ষাট (৬০) বছরের অধিক বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবস্থানুপাতিক হারে আমাদের শিশু ও যুবসমাজ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ২০০০ সালের ৬.৮ মিলিয়ন থেকে ২১০০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৬৫ মিলিয়ন যেখানে জনসংখ্যা হবে দ্বিগুণ এবং কর্মঠ লোকের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন থেকে নেমে দাঁড়াবে ২ মিলিয়ন। আমাদের দেশে বর্তমানে কর্মঠ তরুণ সমাজ বয়স্ক মানুষ থেকে বেশি যা পরবর্তীতে কমে যাবে। তাই আমাদের যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। জাপান তার যুবসমাজকে কাজে লাগিয়েছিল তাই তারা উন্নত করতে পেরেছিল। আর দশ বছর পরে আমাদের কর্মঠ মানুষের সংখ্যা কমে যাবে এবং বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে তাই এই নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
বার্ধক্য  : বয়স বৃদ্ধি যা অবশ্যম্ভাবী এটা কোন অসুস্থতা নয়, ageing একটি biological phenomena; ষাট বছর এর উপরের মানুষদের বয়স্ক ধরা হয়। বয়স্কদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা হয়ে থাকে যেমন: শারীরিক সমস্যা; মানসিক সমস্যা; সামাজিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক সমস্যা।Independent Commission on Health in India এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বয়স্কদের সাধারণত দৃষ্টি শক্তির সমস্যা, হাড় এর ক্ষয়জনিত সমস্যা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, কানে কমশোনা, হজম জনিত সমস্যা, মূত্রাশয় সমস্যা ইত্যাদি নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। ৮৮% বয়স্ক লোকেরা দৃষ্টিশক্তির নানা সমস্যায় ভোগেন যেমনঃ চোখে ছানিপড়া, গ্লুকোমা, রেটিনার ক্ষয় ইত্যাদি। ৪০% বয়স্ক লোকের হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যা থাকে যেমনঃ অস্থি শুকিয়ে যাওয়া, অস্থিসন্ধি প্রদাহ ইত্যাদি। বয়স্কলোকের মধ্য ১৮.৭% লোক হাত কাপাকাপি, ভুলে যাওয়া রোগ ও উন্মাদনার মতো কিছু সমস্যায় ভোগে। বয়স্কদের হৃদজনিত রোগও দেখা যায়। বয়স্করা অ্যাজমা ব্রংকাইটিস এর মতো বিভিন্ন শ্বাস জনিত সমস্যায় ভোগে। প্রায় ৯% বয়স্কদের হজম শক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে পেপটিক আলসার এবং অনেকসময় কম চলাফেরার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য এর সমস্যায় ভোগে। এছাড়াও বয়স্কদের দাঁত পড়ে যায়, মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, ঘ্রাণশক্তি কমে যায়, ঘন ঘন টয়লেট যেতে হয় তাই পানি ও কম খায়। মোট কথা তারা ঠিক মতো খেতে পারে না, ফলশ্রুতিতে একসময় তারা চরম অপুষ্টির শিকার হয়।
বয়স্কলোকদের ৮.৫% লোক ভুলে যাওয়া রোগ, হতাশা, উদ্বিগ্নতা, ডিলিরিয়াম, উন্মাদনার মতো সমস্যায় পতিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সত্তাও নষ্ট হয়, তাদের আচরণ বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কেউই ভালো কাজ দেয় না বা তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হয় না। তারা আগে যেখানে পরিবারের কর্তা ছিল আজ সেই পরিবারে সে নিগৃহীত, তারা অনেক কাজ নিজে করতে পারে না অন্যের উপর নির্ভরশীল হয় তাই তারা চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
বয়স্কদের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা
স্যার জেমস স্টালিং এর মতে বার্ধক্যকে যবধষ করা যাবে না, এটাকে ঢ়ৎড়ঃবপঃ, ঢ়ৎড়সড়ঃব এবং বীঃবহফ করতে হবে। অনেকের শরীর ষাট বছর পার হয়ে গেলেও সিস্টেমিক ডিজিস না হতে পারে কিন্তু বয়স হলে বার্ধক্যজনিত সমস্যা হতে পারে। হার্ট, কিডনি, চোখ এইগুলো ষাটের পরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। প্রাথমিকভাবে বয়স্কদের পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম করা, ধূমপান না করা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অনেক সময় দেখা যায় পরিবারে বয়স্কদের পছন্দ  অনুযায়ী রান্না করা হয় না। তাদের পুষ্টির কথা ভাবা হয় না। বয়স্কদের খাবারে পানি থাকতে হবে ৮-১০ গ্লাস, ডায়াবেটিস না থাকলে কন্দজাতীয় খাবার তারা খেতে পারে। হজমজনিত সমস্যা এড়ানোর জন্য তারা ডালজাতীয় খাবার কম খেতে পারে এবং শাক কম খেয়ে সবজিজাতীয় খাবার ও ফল খেতে পারে। হাড় ক্ষয়জনিত সমস্যার জন্য তাদের খাবারে দুধ রাখতে হবে। চিনি, তেলজাতীয় খাবার কম দিতে হবে। বয়স্কদের দৈনিক খাদ্য চাহিদা অনুযায়ী খাবার প্রদান করা প্রয়োজন (বয়স্কদের দৈনিক খাদ্য চাহিদা সারণি দ্রষ্টব্য)। পুষ্টি চাহিদা পেতে, বয়স্কদের খাদ্য পরিকল্পনাতে শর্করা জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে, আমিষ ও ফ্যাট পরিমিত গ্রহণ করতে হবে, তাদের নিয়মিত দুধ বা দুধজাতীয় খাবার ২৫০ মিলি., সপ্তাহে ১-২ টি ডিম, শাকসবজি ১০০ গ্রাম এবং বিভিন্ন ফল ১০০ গ্রাম গ্রহণ করতে হবে।
 তাছাড়া  পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি বয়স্কদের যাতে ভালো ঘুম হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘুমের জন্য আলো বাতাস যাতে প্রবেশ করে এমন রুমে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিটেনাস ইত্যাদি রোগের ওসসঁহরুধঃরড়হ করতে হবে। তাদের চলাফেরা পথে তারা যেন কোনভাবে আঘাত না পায় সেজন্য পথের বাধা সরিয়ে ফেলতে হবে, যাতে ভালো করে দেখতে পায় তাই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, সমান আরামদায়ক জুতা দিতে হবে, সিঁড়ি দিয়ে ভালোভাবে উঠতে পারে তাই রেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্ব সহজে জ¦ালানোর জন্য নিচে সুইচ এর ব্যবস্থা ও সহজে যেন নিরাপদ পানি পান করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে এবং তৃতীয়ধাপে যখন তারা নিজের কাজ নিজে করতে পারে না তাদের জন্য ডাক্তার, সমাজকর্মী, মনোবিজ্ঞানী এদের তত্ত্বাবধানে গঠিত পুনর্বাসন এর ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও আমাদের দেশে তার চর্চা নেই। বয়স্করা সঙ্গ প্রিয়। অস্ট্রেলিয়ায় এক গবেষণায় ২০০ বৃদ্ধ লোকের উপর এই গবেষণা চালানো হয়, যাদের প্রত্যেকেরই ডায়াবেটিস, প্রেসার আছে। এখন ১০০ জনকে পরিবারের সাথে রাখা হয়েছে এবং ১০০ জনকে ওল্ডহোমে রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে যে যারা পরিবারের সাথে নাতিপুতিদের সাথে ছিল তাদের ডায়েবেটিস ও প্রেসার নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাই প্রবীণদের পরিবারের সাথে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য আগারগাঁওতে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত আছে। বিন¤্র চিত্তে আমরা বয়স্কদের সম্মান দেখালে আমাদের সন্তানও আমাদের দেখে আমাদের থেকে উত্তম শিক্ষা নিবে। সবাই যেন বৃদ্ধ অবস্থায় সুন্দর সময় কাটাতে পারে, অবহেলিত না হয়। য়

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারটান, আঞ্চলিক কার্যালয়, সিরাজগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭২৩৬৭২১৯২ ই-মেইল :turinbsmrau@gmail.com